বসন্ত সাহা আবার কাগজপত্রে মন দিলেন। এবার প্রতীকের স্ত্রী। এই মেয়েটির জবানবন্দির একটি অংশ গোলমেলে। তবে গোলমালটা সরালে মজাই পাওয়া যাবে।
মন্দার— আমি আমার স্বামীকে বিশ্বাস করি না। ও বিজনেসের জন্য সবকিছু করতে পারে। পুরীতে পার্টনারশিপে হোটেল কেনবার চেষ্টায় আছে। সবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে বেড়ায়। আমার বাবার কাছ থেকেও নিয়েছে। হাড় কঞ্জু্স। একটা পয়সা আমাকে দেয় না। খুন করতে পারে কিনা জানিনা। ফ্রিতে হলে একটা কথা ছিন, খরচাপাতি বেশি হয়ে গেলে করবে না।
হৈমন্তী— মুকুর আমার কলেজ জীবনের সহপাঠিনী। চমৎকার মেয়ে। কলেজে পড়বার সময় সে আমার কিছু উপকারও করেছে। মাঝখানে বেশ কিছুদিন যোগাযোগ ছিল না। পরে আবার হয়। বেশিরভাগ সময়ে তার সঙ্গে ফোনে, হোয়াটস্অ্যাপে বা ফেসবুকের ইনবক্সে কথা হয়েছে। আমি কলকাতায় এসে তার নতুন ফ্ল্যাটে গিয়েছি। সে আমাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। সুনন্দর সঙ্গে আমার পুনেতে দেখা হয়েছে। সাকুল্যে দু’বার। মৃত্যুর পর বলা ঠিক নয়, তারপরেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই লোকটি সম্পর্কে আমার এক্সপিরিয়েন্স বিটার। যে সব পুরুষ একা থাকা মহিলাদের সহজলভ্য বলে মনে করে আমি তাদের পছন্দ করিনা। এই বিষয়ে আমি অবশ্য মুকুরকে কিছু বলিনি। গোপনই রেখেছি। এরপর থেকে আমি সুনন্দকে অ্যাভয়েড করি। পুরুষমানুষ নিয়ে এর আগেও আমার বিটার এক্সপিরিয়েন্স হয়েছে। সম্ভবত সেটা আমার রূপের কারণে। আমি একজন কেমিস্ট। আমি ল্যাবরেটরিতে কাজ করি সেখানে কেমিক্যালস্ সব সময় লাগে। তবে মানুষ মারবার জন্য নয়, কসমেটিকস্ তৈরির জন্য। আমি রিসার্চ করি। মুকুর আমাকে যখন ওর ফ্ল্যাটের জন্য একটা নাম ভাবতে বলে, আমার মজা লাগে। এরকম সচরাচর হয় না। ফ্ল্যাটে নম্বর থাকে। নাম থাকে এই প্রথম শুনলান। আমি তখন ওর পার্টতে নিজে থেকেই আসব বলি। তবে সঙ্গে অফিসের কাজও ছিল। ইস্টার্ন জোনের মার্কেটিং হেডের সঙ্গে কথা হয়েছে। হোটেলেই মিটিং করেছি। চাইলে ম্যানেজারের ফোন নম্বরও দিতে পারি। মুকুরকে একটা ক্রকারি সেট দিয়েছি। ঠিক ক্রকারি নয়, স্পুন, ফর্ক, নাইফ। নতুন ফ্ল্যাটে এগুলো খুব দরকার হয়। একবার পুনের ফ্ল্যাটে হাতের কাছে ছুরি না পেয়ে একটা ডাঁশা পেয়ারা কামড়ে খেতে যাই। আমার দাঁত ইনজিওরড্ হয়েছিল। আর হ্যাঁ, কেকটা আমার। তবে আমি হাতে করে নিয়ে যায়নি। ওদের ঠিকানায় অর্ডার দিয়েছি।
আরও পড়ুন, সন্মাত্রানন্দের কলাম ধুলামাটির বাউল
দিশা—ওদের সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছু জানি না। বেড়াতে গিয়ে সুনন্দদা আর মুকুরদির সঙ্গে আলাপ। ঘনিষ্ঠতা কিছু হয়নি। মাঝেমধ্যে মুকুরদি টেলিফোন বা হোয়াটস্অ্যাপে যোগাযোগ রাখত। তবে মুকুরদি সঙ্গে ওর হাজব্যান্ডের রিলেশন খুব ইজি ছিল না। সুনন্দদার নাকি আগে একটা বিয়ে ছিল। মু্কুরদি সেই কারণে নানা ভাবে উইল টুইল করে রেখেছে প্রোটেকশন নিয়ে রেখেছিল। আবার এটা সত্যি নাও হতে পারে। পলাশ বলেছে। সে ওদের খবর বেশি রাখে। একসময় এক পাড়ায় থাকত কিনা। তবে আমি এসব জানি না। পুনেতে চলে যাবার পর কলকাতায় আমার বেশি আসা হয় না।
কিশোর—সুনন্দদার সঙ্গে আমার খুবই অল্প আলাপ। ওরা যে আমাকে নেমন্তন্ন করেছে এটাই একটা সারপ্রাইজ। দিশা আর আমার সম্পর্কটা ভেরি সফট। যখন একসঙ্গে থাকি তো থাকলাম, যখন থাকলাম না কেউ কাউকে মনেও রাখি না। কারও স্পেসে এন্ট্রি নেওয়ার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। উই আর ফ্রি বার্ড। এর মধ্যে কারও অন্য কোনও রিলেশন হল কিনা তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। উই ডোন্ট বদার। বদার করব না বলেই তো বিয়ের মতো পাকাপোক্ত কোনও রিলেশনে যাইনি। যাবও না। দিশা যদি অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্কে যায় তো যাবে। যাই হোক, সুনন্দদা এবং দ্যাট লেডি, কী যেন নাম? ওনাদের মৃত্যু খুব শকিং। মনে হচ্ছে, আমাকে এই পার্টিতে কেন নেমন্তন্ন করা হল? না হলেই ভাল হত।
তন্ময়- মেহুলের সঙ্গে আমার বিচ্ছেদের কারণ তো আপনারা জানেন। আমাদের কনজুগাল লাইফ স্যাটিসফ্যাক্টরি ছিল না। আমরা দুজনেই মনে করেছিলাম, দিস্ ইজ নট ফেয়ার। যে কোনও কাপলের কাছে সেক্স ইজ ইমপর্টান্ট। সেটা যদি মনের মতো এবং শরীরের মতো না হয়, তাহলে একসঙ্গে থাকবার কোনও মানে হয়
না। আমার বলতে কোনও দ্বিধা নেই, আমি মেহুলতে বাদ দিয়ে একাধিক নারীর কাছে গিয়ে স্যাটিসফায়েড হয়েছি। চরিত্রহীন বা লম্পট এই দুটি শব্দ আমার ডিকশনারিতে একটু অন্যরকম স্যার। আমার কাছে তারাই চরিত্রহীন বা লম্পট যারা শরীর খুশি না হলেও দাম্পত্য জীবনকে টিঁকিয়ে রাখবার ভান করে। হিপোক্র্যাট। মেহুলের মৃত্যুতে আমি খুবই ধাক্কা খেয়েছি। আমাদের ভালবেসে বিয়ে হয়েছিল। তাছাড়া একটি মানুষের সব পরিচয়টাই তো আর শরীর নয়। মেহুলের অনেকগুলো ভাল জিনিস ছিল। আমি তাকে বেড পার্টনার হিসেবে মেনে নিতে না পারলেও বন্ধু হিসেবে পছন্দ করতাম। সেপারেশনে থাকবার পরও দুজনে মিলে আমরা শপিং মল, সিনেমা, পার্টি অ্যাটেন্ড করেছি। মেহুলকে খুন করবার কোনও মোটিভ আমার নেই। ওর প্রতি আমার কোনও রিভেঞ্জ অ্যাটিটিইড নেই। সে আর আমি একমত হয়েই আলাদা হয়েছি। সেপারেশনের পর স্ত্রীর সম্পত্তির ওপর আমার কোনও দাবি নেই। করে লাভ হয় না। মনে হয় আইন পারমিট করে। তবে হ্যাঁ, যে ফ্ল্যাটটায় মেহুল থাকত, সেটা এখনও আমার নামেই করা।
বসন্ত সাহা এবার পাতা উলটে উপহারের তালিকায চোখ বোলালেন—
কঙ্কণা এবং পলাশ— মাইক্রোভেন এবং এতে ব্যবহার করা যায় এমন বাসনপত্র
উজ্জ্বল এবং নয়নিকা—মুকুর এবং সুনন্দর জন্য পারফিউম, আফটার সেভ লোশনের সেট। একাট মিনের কাজ কার বক্সের মধ্যে অনেকেগুলো শিশি
প্রতীক এবং মন্দার— পর্দা এবং বেডকভার।
দিশা—একটা ওয়াইনের বোতল সঙ্গে একটা মেটাল ওয়াইন র্যাক। ওয়াইনের বোতলটা খোলবার কথা ছিল।
কিশোর— ওয়াল ক্লক। ঘড়িটা দেখলে মনে হবে অ্যান্টিক।
অনুকূলবাবু এবং তাঁর স্ত্রী— কাপডিশের সেট।
তন্ময়—ফুলের তোড়া
মেহুল— মুকুরের জন্য একটা হাউজকোট। যার অনেকগুলো পকেট।
হৈমন্তী— ছুরি কাঁটার সেট। আর কেক।
বসন্ত সাহা এবং তাঁর স্ত্রী— টেবিল ল্যাম্প।
তালিকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন বসন্ত সাহা। শিশি বোতল এনেছে দুজন। একজন পারফিউম, একজন শ্যাম্পেন। অবশ্য বিষ উপহার হিসেবে আনতে হবে তার কোনও মানে নেই। একটা ছোটো শিশি শার্ট প্যান্টের পকেটে বা শাড়ির ভাঁজে রাখা যাবে অনায়াসে। তবে ওইদিক থেকে ভাবলে হবে না। অন্যভাবে দেখতে হবে। এতজনের মধ্যে কার কার বয়ানে অসংগতি রয়েছে? আজ আবার নতুন করে একটা–দুটো পাওয়া গেল। ছোটোখাটো গোলমাল। সেসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামালে চলবে না। রোজ একবার করে পড়লে এরকম ছোটোখাটো গোলমাল একটা না একটা পাওয়া যাবে। তবে একজন বেশি গোলমাল করেছে। সে কে? গোলমালটাই বা কী? গলায় বিঁধে যাওয়া কাঁটার মতো খচখচ করছে কিন্ত তাকে দেখা যাচ্ছে না।
মোবাইল তুলে সাগ্নিকের নম্বর ধরলেন বসন্ত সাহা।
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘রাত কি খুব বেশি সাগ্নিক?’
‘না স্যার, মোটে সাড়ে ন’টা।’
‘তুমি একটা কাজ করচতে পারবে।’
‘পারব স্যার। কোথাও যেতে হবে?
‘না কোথাও যেতে হবে না। টেলিফোনে করবে। গেস্টদের সকলকে জিজ্ঞাসা করবে। অবশ্যই আমাদের এবং অলুকূলবাবুদের বাদ দিয়ে। অগুস্ত র্যনোয়ার নামে কাউকে চেনে কিনা?’
‘কী নাম বললেন স্যার?’
‘অগুস্ত র্যনোয়ার’
‘স্যার, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আপনি কি ফরাসি শিল্পীর কথা বলছেন?’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘গুড। আমি জানতাম, এবার জানতে মুকুরের গেস্টেদের মধ্যে কে কে জানে?’
‘স্যার, শুধু এইটুকই প্রশ্ন?’
‘হ্যাঁ, আগে পিছে বলে তৈরি হবার সময় দেবে না। প্রশ্নটা হবে সাডেন। যেন তুমি পাড়ার মন্টুর কথা জানাতে চাইছো। গলার আওয়াজও খেয়াল করবে।’
সাগ্নিক বলল, ‘ওকে স্যার। আপনাকে আধঘন্টার মধ্যে জানাচ্ছি।’
আধঘন্টা লাগল না। বাইশ মিনিটের মাথায় ফোন এলো।
বসন্ত সাহা আগ্রহ নিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কী হল সাগ্নিক ?’
সাগ্নিক বলল, ‘তন্ময় বাদ দিয়ে সবাই ফোন ধরেছে স্যার। বেশিরভাগই অবাক হয়েছে। নামটা বুঝতেই পারেনি। একজন তো আমাকে রীতিমত ধমক দিল। পুলিশ বলে নাকি ঠাট্টা করছি।’
‘কেউ পারল না? র্যনোয়ার যে একজন আর্টিস্ট সেটুকুও না!’
সাগ্নিক একটু থেমে বলল, ‘না স্যার, একজন পেরেছেন। তিনি শুধু চিনতে পারেননি, হেসে বলেছেন, ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের মধ্যে হি ওয়াজড মোস্ট সাকসেসফুল ওয়ান। পুরো নাম পিয়ের অগুস্ত র্যনোয়ার। তার ছবির সবথেকে বড় দিক, জীবনের সেলিব্রেশন। প্রাণশক্তি আর উজ্বল আলোয় ভরা পৃথিবী। ও আরও বলেছে স্যার। বলেছে, এই শিল্পীর আঁকা ন্যুড নাকি অ্যামেজিং। তার নাম স্যার...।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘গুড। ওয়েল ডান সাগ্নিক। এই কাজ সবাইকে দিয়ে হত না। তোমাকে এবার যা বলছি মন দিয়ে শোনো।’
ডিনারে বসে চুপচাপ খাচ্ছিলেন বসন্ত সাহা। ঠিক খাচ্ছিলেন না, খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। খুব অন্যমনস্ক।
ছন্দা সাহা স্বামীর খাবার নাড়াচাড়া দেখে নিচু গলায় বললেন, ‘তুমি শরীরের দিকে নজর দিচ্ছো না। কদিন অফিসে দই পর্যন্ত নিচ্ছো না। ফল খাওয়ার ব্যাপারে নেগলেক্ট করছো। টেবিলে যেমন ভাবে রেখে দিই, সেভাবেই পড়ে থাকে। জানি, মুকুরের পার্টির ঘটনা তোমাকে খুব আঘাত দিয়েছে। তোমার মতো পুলিশ অফিসারের সামনে খুন হয়ে গেল... আমারও খারাপ লাগছে। তাবলে শরীরের দিকেও তো খেয়াল করতে হবে। ফলটা অন্তত খেও।’
বসন্ত সাহা মুখ তুলে বললেন, ‘আচ্ছা, ছন্দা পাকা পেয়ারা ছুরি দিয়ে কেটে খাওয়া যায়, কিন্তু ডাঁসা পেয়ারা? যাকে আমার আধপাকা বা কাঁচা বলি, সেটা কি কখনও ছুরি দিয়ে কাটা যায়? শুনেছো কখনও?’
ছন্দা হেসে বললেন, ‘কেন? তুমি ডাঁসা পেয়ারা খাবে? ছুরি দিয়ে কেন ওই ফল করাত দিয়েও কাটা যাবে না। খেতে হয় কামড় দিয়ে। দাঁতে জোর লাগে। এই বয়সে আর পারবে না। এই ঠাট্টা তোমার সঙ্গে কে করল?’
বসন্ত সাহা খাওয়ায় মন ফিরিয়ে খানিকটা নিজের মনেই বললেন, ‘একজন করেছে। কিন্তু কেন করল? কথাটা চেপে গেলেই তো হত।’
ছন্দা বললেন, ‘মনে হচ্ছে, রহস্য সমাধানের কাছাকাছি চলে এসেছো।’
বসন্ত সাহা খানিকটা আপনমনেই যেন বললেন, ‘খুন কে করছে সেটা বড় কথা নয়...কীভাবে করেছে সেটাই! হাউ ডান ইট। সেটা বুঝতে পারলে সব স্পষ্ট হবে। এতক্ষণ বিষ নিয়ে ভাবছিলাম, এবার একটা ছুরি সমস্যায় ফেলছে।’
এই ধারাবাহিক উপন্যাসের সব পর্ব একত্রে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে