সাগ্নিকের উত্তেজনা দেখে বসন্ত সাহা একটু অবাকই হলেন। বললেন, ‘আগে বোস। তারপর বল।’
সাগ্নিক বলল, ‘স্যার, হৈমন্তীর ফোনের কললিস্টে কলকাতার দুটো ল্যান্ডলাইনের নম্বর পাওয়া গিয়েছে। ঘটনার দিন সকালে এই ফোন নম্বরগুলো থেকে তাকে ধরা হয়। হৈমন্তী তখন কলকাতার হোটেলে পৌঁছে গিয়েছে। ল্যান্ডলাইন বলে আমি ইগনোর করি। আজ একটু আগে আবার সেগুলো চেক করতে গিয়ে থমকে যাই। কাছাকাছি সময়ের মধ্যে ফোনগুলো এসেছে। একটা নম্বর পোস্টাপিসের, অন্য একটা এসেছে জেরক্সের দোকান থেকে। এরকম অদ্ভুত দুটো জায়গা থেকে ফোন আসবার কারণ কী হতে পারে স্যার ঠিক ধরতে পারছি না। খটকা লাগল। আজকের দিনে ল্যান্ডলাইন থেকে কে ফোন করবে? তাও যদি কোনও বাড়ি বা অফিস থেকে হত। যিনি কলকাতার বাইরে থেকেন, শহরে এসছেন, তাকে ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন কেন? আপনার কি কিছু মনে হচ্ছে?’
বসন্ত সাহা সোজা হয়ে বসে চাপা গলায় বললেন, ‘ওয়ান্ডারফুল! একটা কাজ করলে সাগ্নিক। একজনই ফোন করেছে... একজনই...।’
সাগ্নিক বলল, ‘ঘুরে ঘুরে ল্যান্ডলাইন থেকে!’
বসন্ত সাহার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। হিসহিসে গলায় বললেন, ‘যে ফোন করেছিল, সে মোবাইল নম্বর গোপন করতে চেয়েছে। শুধু মোবাইল নম্বর নয়, সে দুটো আলাদা জায়গা থেকে ফোন করে একধরনের বিভ্রম তৈরি করতে চেয়েছে। ধরেই নিয়েছিল, বিষয়টা একসময়ে পুলিশের কাছে আসবেই অথবা যদি আসে পুলিশ যেন বুঝতে না পারে। গুড, ভেরি গুড। আমরা ঠিক জায়গায় চলে এসেছি সাগ্নিক। এবার আমাদের দেখতে হবে, এই লোকটি কে? আমাদের সন্দেহের লিস্টের একজন কি?’
আরও পড়ুন, ‘সই’ থাকবে, কিন্তু সইদের মহীরুহ যে আর নেই
সাগ্নিক বলল, ‘কী করে বুঝব ?’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘এবার আর শুধু মাথায় হবে না, ফিজিকালি চেষ্টা করতে হবে। গায়ে গতরে খেটে। গিয়ে দেখতে হবে। পোস্টাফিসে হবে না, সেখানে কেউ বলতে পারবে না। ওই জেরক্সের দোকানে যেতে হবে। সেদিনের গেস্টদের ফটো তোমার কাছে রয়েছে না? ওই ছবি নিয়ে জেরক্সের দোকানে যে থাকবে দেখাতে হবে। জিগ্যেস করতে হবে চিনতে পারছে কিনা। বেশি নয়, পাঁচজনের ছবি। যদি চিনতে পারে, তাহলে কিছু করবার নেই, যদি না পারে... আমাদের চান্স নিতে হবে।’
সাগ্নিক বলল, ‘স্যার, আমার কাছে ফটো নেই।’
বসন্ত সাহা একটু ভেবে বললেন, ‘দাঁড়াও আমি দেখছি।’
বসন্ত সাহা মোবাইল টেনে নিয়ে নম্বর টিপলেন। ওপাশ থেকে ছন্দা বিরক্ত গলায় বললেন, ‘আজও তুমি ফল খাওনি! এতো করে বললাম। দই নিয়ে যেতেও ভুলে গিয়েছ। আগে তো কখনও এরকম করওনি। খুনের তদন্ত তো আগেও বহু করেছো।’
স্ত্রীর ধমক খেয়ে বসন্ত সাহা আমতা আমতা করে মাথা চুলকে বললেন, ‘সেই জন্যই তো তোমাকে ফোন করলাম। আমি ফল আনিয়ে খেয়ে নিচ্ছি।’
ছন্দা একটু শান্ত হয়ে বললেন,‘রোজ রোজ এরকম কোর না।’
আরও পড়ুন, সন্মাত্রানন্দের আধ্যাত্মিক জীবন-পথের কথা ধুলামাটির বাউল
বসন্ত সাহা স্বস্তির গলায় বললেন, ‘নানা, আর ভুল হবে না। ছন্দা তোমার কাছে মুকুরের পার্টির কিছু ফটো আছে না? সেদিন আমাকে দেখাচ্ছিলে।’
ছন্দা বললেন, ‘আছে কয়েকটা। একটা ভিডিও ক্লিপিংসও রয়েছে। দিশা মেয়েটি সেদিনই পাঠিয়েছিল। নেমপ্লেট উদ্বোধন, কেক কাটা সব আছে। সুনন্দ অসুস্থ হবার আগে পর্যন্ত। হোয়াটস্অ্যাপে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
বসন্ত সাহা তাড়াতাড়ি বললেন, ‘ওসব ভিডিও টিডিও লাগবে না। তুমি আমাকে একটা গ্রুপ ফটো পাঠাও। যেখানে সবাই থাকবে। এখনই পাঠাও।’
তিন মিনিটের মধ্যে ফটো চলে আসে। সেই ফটো সাগ্নিকের মোবাইলে পাঠিয়ে দেন বসন্ত সাহা। সাগ্নিক উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আমি যাচ্ছি স্যার। খুব চেষ্টা করব। আর একটা কথা। হৈমন্তীর মোবাইলে আরও দুটো নম্বর ফ্রিকোয়েন্টলি পেয়েছি স্যার। দুজনেই মেয়ে। একজনের নাম পূরবী মাথুর। সে পুনের বন উইদো কোম্পানির ল্যাবরেটরিতে কাজ করে। পরিচয় গোপন করে এই নম্বরে আমি ফোন করেছিলাম। ভান করেছিলাম, ভুল নম্বর হয়ে গিয়েছে। ততক্ষণে মেয়েটির নিজের নাম আর পরিচয় বলে ফেলে। অ্যাপারেন্টলি সরল মনে হয়েছে। আর একজনের নাম রায়না। সেও পুনের মেয়ে। জানতে পেরেছি শি ইজ অ্যান আর্টিস্ট। স্যার, আমার বিশ্বাস এই রহস্যের জট যেমন কলকাতায় তেমন পুনেতেও রয়েছে। সুনন্দ প্রায়ই পুনেতে যেত।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘আমিও তাই মনে করি।’
সাগ্নিক বলল, ‘মেহুলও ফ্রিকোয়েন্টলি মুম্বাই যেত। পুনে যেত কিনা জানি না। তবে পুনেতে ওর ঘন ঘন ফোন কল হয়েছে। মোবাইলের সার্ভিস প্রোভাইডার গতকাল এই ইনফরমেশন দিয়েছে। তন্ময়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর সে কলকাতার বাইরে কাজ খুঁজছিল।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘পুনেতে যেতে পারলে হত। কিন্তু সে সময় হাতে নেই। পুনের লিঙ্ক কাদের রয়েছে তোমার মনে আছে?’
সাগ্নিক বলল, ‘অবশ্যই স্যার।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘আমি পুনের পুলিশের সঙ্গে কথা বলব। এই অ্যাড্রেসগুলোতে গিয়ে একবারে দেখলে হত। কোনও না কোনও ক্লু বের হতো। তোমার কাছে হৈমন্তী আর সুনন্দর অ্যাড্রেস আছে?’
সাগ্নিক বলল, ‘আছে স্যার। তবে কোর্টের অর্ডার ছাড়া সার্চ কী করে হবে?’
বসন্ত সাহা হেসে বললেন, ‘সব আইন মেনে চললে আইনরক্ষক হওয়া যায়, গোয়েন্দাগিরি করা যায় না। এই যে আমরা সবাইকে কলকাতায় ডিটেন করিয়েছি, এটা কি আইন মেনে? এই যে সকলের পিছনে লোক লাগানো রয়েছে এটা কি আইন মেনে?’
সাগ্নিক বলল, ‘সরি, এটা ভাবিনি স্যার। অ্যাড্রেসদুটো মেলে দেওয়া রয়েছে।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘দেখি আমি ওখানকার পুলিশের সঙ্গে কথা বলে কী করতে পারি। তুমি আর দেরি কোর না। ফোনবুথের দোকানের ইনফর্মেশন খুব জরুরি হয়ে যেতে পারে। অবশ্য যদি পাওয়া যায়। হৈমন্তী সঙ্গে কে লুকিয়ে কথা বলেছে?’
সাগ্নিক বলল, ‘পূরবী এবং রায়ানের ফোন নম্বর দুটো কাগজে লিখে আপনার কাছে রেখে গেলাম। যদি প্রয়োজন মনে করেন।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘রেখে যাও। তুমি কিছু পেলে আমাকে জানিও।’
সাগ্নিক বেরিয়ে যাওয়ার পর কন্ট্রোলরুমকে দিয়ে পুনের পুলিশ হেড কোয়ার্টারে কথা বললেন বসন্ত সাহা।
‘তালা ভেঙে ঢুকতে না চাইলে বাইরে থেকে যতটা পারেন খবর জোগাড় করে দিন। আর অবশ্যই এই দুই জায়গাতেই পুলিশ পোস্টিং করবেন। মেইলে অফিসিয়াল চিঠি আর ঠিকানাগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
এখন অপেক্ষা করতে হবে। সাগ্নিক খবর পাঠাক। যদি না পারে, তাহলে চারজনকে আবার জেরায় বসাতে হবে। আর সেটা আজই করতে হবে। দরকার হলে গোটা রাত নিতে হবে। হার্ড হতে হবে। হাতে আরও কিছু প্রমাণ নিয়ে হার্ড হলে সুবিধে।
বসন্ত সাহা বাড়ি থেকে যখন বেরোন, অফিসের কাগজপত্রের সঙ্গে বই রাখেন। আজও রেখেছেন। এতদিন রাখছিলেন ছবি বিষয়ে, বিষয় আজ বদলেছে। আজকের বিষয় খুবই ইন্টারেস্টিং। ‘বিষ’। বিষের সঙ্গে রোমান্সও জড়িয়ে আছে। চটি বই। আজ সকালে নিজের লাইব্রেরির তাকে বই খুঁজতে গিয়ে জীর্ণ মলাটের বইটি চোখে পড়ে। হয়তো চিত্রকলা থেকে একবারে উলটো দিকে থাকবেন বলেই আজ ‘বিষ’ বেছে নিয়েছেন বসন্ত। আবার এমনও হতে পারে, সুনন্দ–মেহুল রহস্য তাকে অবচেতনে এই বই নিতে বলেছে। হতে পারে না?
লাইব্রেরিতে দাঁড়িয়েই বইটা খুলে উলটেপালটে দেখেছিলেন। বইটা তো আগে পড়াই হয়নি! নিশ্চয় আলমারিতে গা ঢাকা দিয়েছিল। এরকম কত বই কেনবার পর গা ঢাকা দিয়ে থাকে। তবে এই বই কারও লেখা নয়। ‘মেমোরিয়াল লেকচার’ বই হিসেবে ছাপানো হয়েছে। নাম ‘পয়েজন এন্ড পয়েজনিং—দেয়ার হিস্ট্রি এন্ড রোমান্স এন্ড দেয়ার ডিটেকশন ইন ক্রাইম।’ বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘বিষ এবং বিষ প্রয়োগে প্রণয়, ইতিহাস এবং অপরাধের ঘটনায় তাকে খুঁজে পাওয়া।’ একটু বড়, তবে অনুবাদ হিসেবে মন্দ নয়। ১৯৬৪ সালে কালকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছ’দিন ধরে একটি ‘নামাঙ্কিত ভাষণ’ –এর আয়োজন হয়েছিল। ‘ক্ষান্তমণি–নগেন্দ্রলাল মেমোরিয়াল লেকচার’। ১৯৬৪ অক্টোবরের তিন অক্টোবর থেকে আট অক্টোবর ধরে এই ভাষণ দেন প্রফেসর কে.এন. বাগচী। তিনি ছিলেন বায়োকেমিস্ট্রির অধ্যাপক। একসময়ে ‘ক্যালকাটা ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট’–এর প্রিন্সিপাল ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাসায়নিক পরীক্ষকও হন। ১৯৬৯ সালে এই ছ’দিনের ভাষণ বই আকারে প্রকাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
সকালেই অনুকূলবাবুকে ফোন করেন বসন্ত সাহা।
‘স্যার, আপনাদের সাবজেক্টের ওপর একটা বই পড়ছি।’
বইটার কথা শুনে অনুকূলবাবু তো অবাক।
‘আরে! এই বই পেলেন কোথায়! আমিও পড়েছি। তবে ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে।’
বসন্ত সাহা হেসে বললেন, ‘তবে বলুন স্যার। শুধু গান আর ছবি নয়, এইধরনের বইও আমার নিজের স্টকেও থাকে। মনে হয় কোনও সময় ফুটপাথ থেকে কিনেছিলাম। পড়া হয়ে ওঠেনি।’
অনুকূলবাবু উৎসাহ বললেন,‘এক্সেলেন্ট বই। মনে আছে। বিষের কী নেই ওখানে? সব আছে। ইতিহাস, প্রেম, প্রয়োগ, অ্যানাটমি। ধুতরো, আর্সেনিক, মতো নানা ধরনের বিষের কথাও পাবেন। যতদূর মনে পড়ছে, এই প্রফেসর বাগচী লেকচারে মেয়েদের বিষ ব্যবহার নিয়ে অনেকটা বলেছিলেন। একটা সময় তো মেয়েরা বিষ দিয়েই খুন করত। অস্ত্র যেমন গোপন করা যেত, আবার বল প্রয়োগেরও প্রয়োজন হয় না। পড়ে ফেলুন। গোয়েন্দা গল্পের মতো।’
বসন্ত সাহা খুশি হয়ে বললেন, ‘ধন্যবাদ। এই জন্যই আপনাকে ফোন করে জানালাম।’
বসন্ত সাহা সুনন্দ হত্যা রহস্যের কাগজ সরিয়ে বই খুললেন।
(পরের পর্বে শেষ)
——————
এই উপন্যাসের সব পর্ব একত্রে পড়তে পারবেন এই লিংকে