দুপুরবেলা কোথায় কোন ছাদের আলসেতে বসে তিলে ঘুঘু ঢাকছে।
ওই ঘুঘুর ডাকে কেন জানি মনে পড়ে বিশ-বাইশ বছর আগেকার মাদ্রাজ শহরের আমন্থর দ্বিপ্রহরগুলির কথা। ঘর ছেড়ে প্রথম পথে নেমে চলে গেছিলাম বহু শতাব্দী প্রাচীন সেই শহরটিতে। সেখানে ছিলাম বছর চারেক। মায়লাপুরে। এমন সব দুপুরবেলায় দারুণ রোদে একটা বড়ো ঘাট-বাঁধানো পুকুরের ধার দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম কপালীশ্বর মন্দিরের ছায়ায়।
তমিড় ভাষায় মন্দিরকে বলে ‘কোয়েল’। কপালীশ্বর কোয়েল। মন্দির তো নয়, যেন দুর্গ। উত্তর ভারতের মন্দিরের মতো নয় একেবারেই। অনেকটা জায়গা—তা হবে বোধহয় কয়েক বিঘা জমি—উঁচু প্রাকার দিয়ে ঘেরা। মন্দিরের প্রবেশপথে বিশাল গোপুরম। সেই গোপুরমে শিব-সতী, গণেশ-কার্তিকের পুরাণকথার বিচিত্র সব দক্ষিণ-ভারতীয় রূপাবয়ব—উজ্জ্বল নীল, সবুজ, হলুদ রঙের নানা মূর্তি সেই গোপুরমে স্তরে স্তরে উঠে গেছে।
সাহিত্য অকাদেমি ঠিক কোন ভাষার জন্য?
মন্দিরের বাইরে রৌদ্রমলিন রাজপথ। পথের একদিকে তুলসীপাতা, বেলপাতা, জুঁইফুলের মালা, মিষ্টি—এইসবের দোকান। পথের অন্যপাশে চা-কফির দোকান। দোকানের সাইনবোর্ডে জড়ানো জড়ানো তমিড় অক্ষর, দেওয়ালে দেওয়ালে সিনেমার ছবিছাবাওলা বিজ্ঞাপন; প্রায়শই রজনীকান্তের নানা ভঙ্গিমার ছবি। মানুষের অবিরত আসাযাওয়া, দুর্বোধ্য তমিড় ভাষায় কথাবার্তা, বাদানুবাদ, আলাপসালাপ—এইসব পেরিয়ে ঘুমঘুম চোখে হাঁটতে হাঁটতে গোপুরম দিয়ে মন্দিরে এসে ঢুকতাম।
ময়ূরকে তমিড় ভাষায় বলে ময়ীল। লোককথা এইঃ পার্বতী এখানে নাকি ময়ূরের বেশে এসে শিবের জন্য তপস্যা করেছিলেন। সেই থেকেই এ জায়গার নাম মায়লাপুর।
মন্দির চত্বরে মূল মন্দিরকে কেন্দ্র করে অনেকগুলি ছোটো ছোটো মন্দির। সব মন্দিরগুলিই পাথরের তৈরি। কোনোটি পার্বতীর, কোনোটি গণপতির, কোনোটি বা মুরুগা বা কার্তিকের। মূল মন্দিরটি বিশাল। চারিপাশে পাথরের দেওয়াল। ভেতরে গর্ভমন্দির এবং গর্ভমন্দিরের চারিপাশে স্বল্পপরিসর প্রদক্ষিণ করার পথ। সেই সব পথ স্বল্পালোকিত। পথের পাশে দেওয়াল ঘেঁষে ক্ষুদ্রাকৃতি তেষট্টি জন নায়ানমার শৈব সাধকদের মূর্তি। এক ফুট, দেড় ফিট...অনেকটা আমাদের রাসপূর্ণিমার বারোয়ারি পুতুলের মতো। তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট হচ্ছেন তিরুজ্ঞানসম্বন্ধর, মাণিক্যবাসগর এবং সুন্দরর। মূর্তিগুলি সবই কালো কষ্টিপাথরে নির্মিত ও সিন্দুর-চন্দনে চর্চিত। প্রত্যেকের গায়েই দক্ষিণভারতীয় ক্ষৌম বস্ত্র এবং গলায় সাদা ফুলের মালা।
ছাপা বই বনাম পিডিএফ, বাংলার হাল ও হকিকৎ
আমি এঁদের নাম ছাড়া আর কিছুই জানতাম না। দক্ষিণ ভারতীয় শৈব-পুরাণ পড়িনি। শুনেছিলাম, এঁরা সাধক-কবি। দুয়েকজন সাধিকার মূর্তিও দেখেছি শাড়ি পরা। তাঁদের কথা জানি না বলেই খুব সহজে তাঁদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। কারও লম্বা চুল। কারও মাথায় মুখে জটা-দাড়ি। কারও বা দাড়ি-গোঁফ কামানো। কেউ বেশ স্থূলাকৃতি। কেউ শীর্ণ। কারও মুখে বালকের মতো হাসি, কেউ বা বিষম গম্ভীর। একজন ছিলেন ঠিক ঋষির মতো দেখতে। পাথরের পুথিতে পাথরের কলম দিয়ে কী যেন লিখছেন মন দিয়ে। তাঁর নাম কবি তিরুভাল্লুভার। শুনেছিলাম, তাঁর লেখা কাব্যগ্রন্থের নাম তিরুক্কুরল। পরে সে বই অনুবাদে পড়েছি। অনেকটা সংস্কৃত ভাষার কবি ভর্তৃহরির ‘নীতিশতক’-এর মতো কাব্যখানি। সুভাষিতসংগ্রহ।
তাঁদের মাহাত্ম্যকথা জানি না, তাই তাঁদের সঙ্গে আমার কোনো সম্ভ্রমজনিত দূরত্ব তৈরি হয়নি। এইটুকু জানতাম, এঁরা সব কবি, সব সাধক-সাধিকা। আমার মনে হত, এঁরা খুব ভালো মানুষ। একটা আত্মীয়তা তৈরি হয়ে গেছিল তাঁদের সঙ্গে। মনে হত, কেউ আমার ছোটোকাকা, কেউ জ্যাঠামশাই, কেউ বুলুপিসি, কেউ মিঠুদিদি, কেউ রাঙাদাদু। আমার এই লেখা পড়ে ধর্মভাবুকেরা দয়া করে আমার উপর রাগ করবেন না। আত্মীয়স্বজনহীন মানুষ আমি—ঘর নেই, বাড়ি নেই, আপনার বলতে কেউ নেই, গৃহপরিবেশহীন অভাজন অকিঞ্চিৎকর চালচুলোহীন লোক—এই পাথরের মানুষগুলিকে আমি নিজের আপনার জন মনে করতাম, তাঁদেরই মায়ায় পড়েছিলাম আরকি! রোজ একবার দেখা না করলে মন ফসফস করত। কে মহাকবি সুন্দরর, কে সিদ্ধ সাধক মাণিক্যবাসগর—আমি কি ছাই জানি? আমার মনে হত, তাঁরাও রোজ কাপড়চোপড় মালাটালা পরে আমার জন্যে অপেক্ষা করতেন। সেখানে গেলেই ‘আয়, আয়’ বলে হেসে উঠতেন সবাই। ঘিয়ের প্রদীপের আলোয় তাঁদের মুখ যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠত। আমি তাঁদের সঙ্গে কতো কথা বলতাম, তাঁরাও যেন উত্তর দিতেন। কখনও ছড়া কেটে, কখনও গান গেয়ে। সেই স্তিমিত প্রদীপের আলোয় বসত তাঁদের কবিতাপাঠের আসর। আমি যার মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা।
বাংলা বানান দেখে রেগে যাবেন না
কবিতা পড়া শেষ হলে পুথিতে বাঁধন দিতে দিতে মাণিক্যবাসগর হেসে বলতেন, ‘তোকেও এবার লিখতে হবে।’
আমি বলতাম, ‘দূর! তুমিও যেমন! আমি লিখব কথা-কবিতা? আমি তো শব্দের শিল্প জানি না।’
সুন্দরর বলতেন, ‘সে তো আমিও জানতাম না। পার্বতীপতির কৃপা হলে মূর্খের কলমেও মুক্তো ঝরে।’
দেবী কারাক্কাল আম্মাইয়ার সুমিষ্ট স্নেহসিক্ত স্বরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতেন, ‘রূপের তৃষ্ণা ছাড়ো। অরূপের আখর এমনিই তখন এসে ধরা দেবে তোমার কাছে।’
মন্দিরের ছাদে অনেক উপরে কোথা থেকে সুর করে টেনে টেনে একটা ঘুঘু ডাকত ঘু-উ, ঘু-উ!
কেন্দ্রে প্রস্তরনির্মিত গর্ভমন্দিরের ভিতর নিকষ অন্ধকার, শুধু ছাদের থেকে বড়ো বড়ো পেতলের শিকলে ঝোলানো বৃহদাকৃতি প্রদীপের আলো সেই অন্ধকার দূর না করে যেন আরও ঘনিয়ে তুলেছে। গর্ভমন্দিরের দরজা লোহার তৈরি যেন রাক্ষসের বুক। কর্পূর-অগুরুর সুগন্ধে মধুর হয়ে রয়েছে সেই রহস্যময় তমিস্রা। প্রদীপের চকিত আলোয় দেখা যায় পার্বতীপতির মুখশ্রী।
বাংলা ভাষা ও ভাবনায় ইংরেজি আধিপত্য
জোরে ধাক্কা দিলে তবেই নাড়ানো যায় এমন সব প্রাচীন পিত্তলের ঘণ্টায় গমগম করে বেজে ওঠে সেই সুপ্রাচীন অন্ধকার। কপালীশ্বর মন্দিরের নহবতখানায় সারাদিন দক্ষিণভারতীয় বাদ্যযন্ত্র নাদস্বরমের সঙ্গে বেজে চলে ঈষৎ কম্পিত, দীর্ঘলয়িত সামুদ্রিক তরঙ্গের মতো মার্গসঙ্গীত। সেই অত্বরিত সুরলহরী, গন্ধমধুর অন্ধকার, উদাত্ত-অনুদাত্ত-স্বরিত উচ্চারণে নিবেদিত বৈদিক মন্ত্র, ধূপধুনার ঘন ধোঁয়া—এইসব মিলে আমার মনের মধ্যে যেন গড়ে উঠত স্মৃতি, কল্পনা ও পুরাকথার প্রাচীন একটি জগৎ।
বিকেলের দিকটায় মন্দিরে ভক্ত দর্শনার্থীদের ভিড় জমত খুব। মুক্তকচ্ছ বস্ত্র ও ফতুয়া পরা পুরুষেরা আসতেন। অলংকৃত নকশা পাড়ের শাড়ি পরা মেয়েরা, নাকের দুই পাটায় নাসাভরণ, বিনুনীতে বেলিফুলের মালা, মুখমণ্ডল হরিদ্রাচূর্ণে চর্চিত। সকলেই পুজো দিতেন, প্রসাদ পেতেন। প্রায় প্রত্যেকেই দীর্ঘক্ষণ শিবস্তোত্র, ললিতাসহস্রনাম আবৃত্তি করতেন সুস্বরিত উচ্চারণে। দুটি কর দিয়ে আড়াআড়িভাবে কর্ণমূল ধরে ওঠবোস করে দেবতাকে প্রণাম জানাতেন।
মন্দিরের পূজারী ষণমুগলিঙ্গম্ স্বামী আমাকে খুব ভালোবাসতেন। বেঁটেখাটো, স্থূলবপু মানুষটি। বছর পঞ্চাশেক বয়স। পরনে একটি মোটা পাড়ের বস্ত্র। আদুল গা। গলায় অনেকগুলি মালা; কোনোটি রুদ্রাক্ষের, কোনোটি বা স্ফটিকের। কানে তাঁর মাকড়ির মতো কর্ণাভরণ। কপালের সামনের দিকটা অনেকখানি কামানো ও ভস্মলিপ্ত। মাথার পেছনের দীর্ঘ চুলগুলি খোঁপা করে বাঁধা। খোঁপাটি আবার বেলিফুলের মালা দিয়ে সাজানো। চোখে তাঁর গাঢ় কাজল টানা। তাঁর চলনবলন সব নারীর মতন। তিনি নিজেকে ভাবতেন শিবের দাসী, পার্বতীর সহচরী।
শুনেছিলাম, তিনি স্থানীয় বিবেকানন্দ কলেজের স্নাতক। খুব ভালো সংস্কৃত জানেন। আমি সেই অলিন্দে নায়ানমার সাধক কবিদের সঙ্গে প্রতিদিন আমার কবিতার কনফারেন্স সেরে মন্দিরের দরজার সামনে এসে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কিছুক্ষণ পর তিনি বেরিয়ে আসতেন। আমার সামনে এসে সুললিত ভঙ্গিমায় দুটি হাত নৃত্যচ্ছন্দে সংযুক্ত করে নমস্কার জানিয়ে অতি সুমধুর কণ্ঠে রোজ জিজ্ঞাসা করতেন, ‘অপি কুশলী ভবান্?’
আমি মৃদুস্বরে সম্মতি জানালে তিনি আমার দু-হাত ভর্তি করে ফলমিষ্টি প্রসাদ দিয়ে খুব সুন্দর করে হাসতেন। এমন সত্যিকারের নম্র, মিষ্টভাষী সুন্দর মানুষ আমি জীবনে আর বেশি দেখিনি।
আমি প্রসাদ হাতে নিয়ে পুকুরের ধারে মন্দিরের ছায়ায় গিয়ে বসতাম। যেই প্রসাদ খেতে শুরু করতাম, একটা লাল রঙের কুকুর আমার কাছে এসে বসত। লেজ নাড়ত। আমিও খেতাম, কুকুরটাকেও খাওয়াতাম। দুজনে মিলে প্রসাদ খাওয়া চলত রোজ কিছুক্ষণ।
মন্দিরের নহবতখানায় সুরের পরিবর্তন হত। বিকেলের রাগ বেজে উঠত। পুকুরের উপরের আকাশে অস্তায়মান সূর্যের আভায় মেঘগুলি হালকা রাঙা উত্তরীয়ের মতো ভেসে যেত সমুদ্রের দিকে। পায়রারা পুকুরের উপর গোল হয়ে উড়ে গোপুরমের উপর দিয়ে এসে ঢুকত মন্দিরের আলিশায়। ভারি আর্দ্র বাতাস এসে লাগত গায়ে। বসে থাকতে থাকতে সন্ধ্যা আসত পুকুরে স্নান সেরে নিয়ে ঘাটের উপর সিক্ত চরণচিহ্ন ফেলে অন্ধকার গায়ে জড়িয়ে। পায়ে পায়ে মন্দিরের সামনের আলোজ্বলা রাজপথ দিয়ে আমিও হেঁটে যেতাম আমার রাত্রি-আবাসের দিকে।
ঘুঘুপাখিরা ঘুমিয়ে পড়ত তখন নিশ্চয়ই। আর ডাকত না।
এই কলামের সব লেখা একসঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে