৫
সুলেখা দাস। গৌরী নয়, সাবিত্রী নয়, স্নেহলতা নয়, সুলেখা। সে-যুগে এমন একটা আধুনিক নাম সুলেখার মা-বাবা কোত্থেকে যে পেয়েছিলেন, বলতে পারি না। অথচ, কী আশ্চর্য, এই একই মেয়ের ডাকনামটি বড়ই অসুন্দর। কচি। মা বলত কচিকাকি। আর সেই সুবাদে সে আমার কচিদিদা।
আমাদের পাশের বাড়ির বউ হয়ে এসেছিল সে আমার জন্মেরও আগে। খুব ছোটোবেলার স্মৃতি যা মনে ভাসে, ফরসা লাবণ্যময়ী চেহারা, এক মাথা চুল আর বড় বড় চোখ। স্নান সেরে সিঁদুর পরে ঘরে এসে ঢুকলে ঘর আলো হয়ে যেত।
গরিব ঘরের বউ, কিন্তু যতটুকু শুনেছি, আদরযত্নের অভাব হয়নি। অন্তত যতদিন তার বর বেঁচেছিল। একটি ছেলেও হয় বিয়ের কয়েক বছর বাদে। শ্বশুর মারা গেছেন আগেই। শাশুড়ি আছেন। শাশুড়ি, স্বামী আর ছেলেটিকে নিয়ে কচিদিদার ভরভরন্ত সংসার তখন।
এর বেশি আমি কিছু জানি না। কচিদিদা স্বামীসুখ কতটা পেয়েছিল, তার শাশুড়ি তাকে কতটা ভালোবাসতেন, এসব আমার জানার কথা নয়। যা জানি না, তা বানিয়ে বানিয়ে লিখে সাহিত্য করা যায়। কিন্তু তা করতে গেলে, কচিদিদা সম্পর্কে যা আমি জেনেছি, সেই বিস্ময়কর কাহিনি আমার লেখার মার্জিনের বাইরে চলে যাবে। অথচ সেই কথাগুলোই বেশি বলা দরকার।
কচিদিদা আমার দিদিমাকে ঘরের কাজে সাহায্য করত। বাসনমাজা, কাপড়কাচা, ঘরমোছা এরকম ঘরগেরস্থালির নানারকম কাজ আর কী। আমরা তাকে আরেকটা দিদা বলেই জানতাম। আমার ছোটোবেলার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল কচিদিদা।
আমি তখন ক্লাস সিক্সে, হঠাৎ কচিদিদার বর মারা গেল। মারা যাওয়ার বয়েস হয়নি। কচিদিদারও তখন বয়স অল্প। তারই বছরখানেকের মধ্যে শুনলাম এক মর্মান্তিক খবর। কচিদিদা পাগল হয়ে গেছে।
দিনের পর দিন স্নান নেই, সারা গায়ে রাজ্যের শাড়িজামা, গোবরমাখা চট জড়িয়ে রাখে। মাথাটা ঢেকে রাখে বিশ্রী নোংরা দুর্গন্ধওলা গামছা দিয়ে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, ঘরে আসে না। হাতে একটা মাছধরার ছিপ। পুকুরের পাড়ে ছিপ ফেলে বসে থাকে। সে নাকি মাছ ধরছে। পাশ দিয়ে যাওয়া যায় না। গায়ে এত দুর্গন্ধ!
রাত্রেও ঘরে আসে না। শুনলাম, রাস্তার একপাশে পড়ে নাকি ঘুমোয়। তাকে সর্বক্ষণ পাহারা দেয় রাস্তার চারটি কুকুর।
কচিদিদার শাশুড়ি চেষ্টা করেছিলেন, কচিদিদাকে ঘরে নিতে। শাশুড়ির সঙ্গে ঘরে এসেছিল। দুয়েকদিন ছিল। তারপর আবার বেরিয়ে পড়ল পথে। কচিদিদার কতো রূপ ছিল, সেসব তখন ইতিহাস। কদাকার চেহারা হয়ে গেছে কচিদিদার। ফিরে তাকাতেও ইচ্ছে করে না।
আরও পড়ুন, প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস অনাবৃত
কচিদিদাকে নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি। গ্রামের ইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে কলেজিয়েট ইস্কুলে উচ্চমাধ্যমিক পড়ছি তখন। টিউশনি পড়তে যেতাম নানা দিকে। শহরের কোথায় যে আমি কচিদিদাকে দেখিনি! যেন মাটি ফুঁড়ে সে হাজির হত। রাজাবাজারে, কর্নেলগোলায়, বার্জটাউনে, জর্জকোর্টে, ভাদুতলায়, বড়বাজারে, মল্লিকচকে, যখন-তখন, যেখানে-সেখানে। আর অদ্ভুত তার কার্যকলাপ! কখনও দেখি, নর্দমার ধারে কুকুরগুলোর সঙ্গে বসে আস্তাকুড় ঘেঁটে কী যেন বের করছে। কখনও দুপুরবেলায় গৌড়ীয় মঠের দালানে কুকুর-পরিবৃত হয়ে ঘুমোচ্ছে। কখনও কোনো বিয়েবাড়ির পান্ডেলের একপাশে কলাপাতায় কে যেন তাকে খেতে দিয়েছে; সে খাচ্ছে আর কুকুরগুলোকে মিষ্টি ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে। কখনও পুকুরধারে বসেছে মাছ ধরতে; এক হাতে কুকুরের কান, আরেক হাতে ছিপটা ধরা। মোট কথা, কুকুরগুলো চব্বিশ ঘণ্টা সঙ্গে আছে।
মা বলত, ‘আহা! স্বামীর মৃত্যুশোক পেয়ে কচিকাকি পাগল হয়ে গেল!’
আমি কিন্তু কচিদিদার হাবভাবে কখনও শোকদুঃখের লেশমাত্র দেখিনি। সবসময়েই আনন্দ। অতো আনন্দের কী আছে, তখন তা বুঝে উঠতে পারিনি।
কচিদিদার ছেলে গ্যাঁড়া। গ্যাঁড়াকে তার ঠাকুমাই মানুষ করেছেন। কচিদিদা তো পথে পথেই ঘুরত। ছেলের প্রতি তার কোনো টানই নেই। মাতৃত্বটাতৃত্ব্ব—ওসব কিছুই আমি তার দেখিনি।
আমার মায়ের বাবা, অর্থাৎ আমার দাদু ছিলেন ডাকসাইটে লোক। কোনো কিছুকে উপর উপর ছেড়ে দেওয়ার লোক ছিলেন না। একদিন মামার বাড়ি গেছি, দাদু বিকেলবেলা কোত্থেকে যেন এলেন। পুকুরের ঘাটে কচিদিদা মাছ ধরছে। সঙ্গে কুকুরগুলো। আবার কোঁচড় থেকে আমসত্ত্ব বের করে মাঝে মাঝে খাচ্ছে। আমসত্ত্ব কীভাবে পেল, কে জানে। পুকুরের ঘাটে কচিদিদাকে দেখে দাদু তার কাছে গেলেন। তারপর গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘হ্যাঁ রে কচি, তুই কি পাগল? নাকি সাজা পাগল? ’
কচিদিদা ঘাড় ঘুরিয়ে হেসে বলল, ‘আমি ভাল। বাকি সব পাগল।’
দাদু শুনে বললেন, ‘পাগলেরা সকলেই সেকথা বলে, কচি! তবে তোর কথার অর্থ আলাদা, আমি তা জানি।’
চব্বিশ বছর বয়সে আমি বাড়ি ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে চলে যাই। তাই, দাদু কী জানতেন, জানা হয়নি। তাঁকেও আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি। তবে এখন কিছুটা বুঝতে পারি।
এরপর বাইশ বছর কচিদিদা-কাহিনি আমার জানার বাইরে। এই বাইশ বছর আমার সঙ্গে বাড়ির যোগাযোগ ছিল না। দেশের নানা প্রান্তে থেকেছি। কতো অভিজ্ঞতা, কতো মানুষ, জীবনের বিচিত্র উত্থানপতন! কতো শাস্ত্রপাঠ, তীর্থবাস। তখন কে কচিদিদা?
বাইশ বছর পরে মনে হল, একবার বাড়ি যাই। মঠে আর থাকার ইচ্ছে নেই। ঘুরে বেড়াব স্বাধীনভাবে। আর লিখব এতদিন যা দেখলাম, জানলাম।
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন মনে পড়ে কী পড়ে না
বাড়ি এলাম। সে-বাড়ি পালটে গেছে। ভাইরা বিয়ে-থা করেছে। তাদের সন্তানাদি হয়েছে। দাদু মারা গেছেন আগেই। দিদাও কিছুদিন হল, গিয়েছেন। তাঁরা আমার মা-বাবাকে ঘরবাড়ি সব দিয়ে গেছেন। মা-বাবাও বুড়ো হয়েছেন।
এই পাল্টে-যাওয়া মেলার ভিড়ে আমি ভবঘুরে বাউল ফিরে এলাম। সব দেখেশুনে কৌতুকই বোধ হল। কারা সব ছিল এখানে। কারা এল। কারা আবার চলে গেল। আবার কারা এসেছে। ব্যাপারটা ভীষণ মজার! মেলা ভাঙছে, মেলা জমছে, আবার মেলা ভাঙছে, আবার জমছে।
যাই হোক, সকালবেলা বারান্দায় বসে আছি, এমন সময় কে এক সুবেশা ভদ্রমহিলা সেজেগুজে বাড়ির গেট ঠেলে ঢুকে উঠান দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। মা রান্নাঘরে। ভাবলাম, ইনি আবার কে? আমার এমন অবস্থা হয়েছে, বাড়ির অনেক আত্মীয়স্বজনকেই চিনতে পারি না। কে যে কার বাবা, কে যে কার মেয়ে বা মা, সব গুলিয়ে যায়। পৃথিবীর মানুষ আলোর সমান গতিবেগযুক্ত রকেটে চড়ে মহাকাশভ্রমণে বেরিয়ে পৃথিবীর হিসেবে বহুযুগ পরে ফিরে এলে যেমন কাউকে চিনতে পারবে না, অনেকটা সেরকম। টাইম-ডাইলেশন না কী যেন বলে ওকে।
কিছুক্ষণ পর সেই মহিলা আমার সামনে এসে বললেন, ‘কী? আমাকে চিনতে পারছ?’
মহিলার বয়স হয়েছে, চুলে পাক ধরেছে, মুখে দাগ, কিন্তু কমবয়সে যে বেশ সুন্দরী ছিলেন, বোঝা যায়।
আমি বেকুবের মতো তাঁকে না-চিনতে পেরে বসে আছি। তিনি হেসে বললেন, ‘চিনতে পারলে না? আমি তোমার কচিদিদা!’
অ্যাঁ? বলে কী? ভাল করে খুঁটিয়ে দেখলাম। তাই তো! কচিদিদাই তো বটে!
আমি যদি বঙ্কিমবাবু হইতাম, তাহা হইলে এমত পরিস্থিতিতে বলিতাম, এ ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নি এতদিন কোথায় লুক্কায়িত ছিল?
বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না-কাটতে মা রান্নাঘর থেকে এসে বলল, ‘কচিকাকি বাড়ি ফিরে এসেছে। কচিকাকির মাথার ব্যারাম সেরে গেছে।’
মায়ের সামনে আর কথা বাড়ালাম না। ক-দিন পর আবার কচিদিদাকে দেখতে পেলাম। চারিপাশে আর কেউ নেই দেখে কচিদিদাকে জিগগেস করলাম, ‘মাথা সারল কী করে?’
কচিদিদা খিলখিল করে হেসে বলল, ‘মাথা খারাপই হয়নি কোনোদিন, তা সারবে কি?’
‘সে কী! তাহলে অমনভাবে ঘুরতে কেন?’
‘লোকের জ্বালায়। বর মরে যাওয়ার পর লোকগুলো ছিনে জোঁকের মতো পেছনে লেগেছিল। রাতের বেলায় দরজা ধাক্কাত। বুড়ি শাশুড়ি চোখে দেখতে পেত না। তা ছাড়াও অসৎ লোকের কতোরকমের কুপ্রস্তাব। শেষে দেখলাম, এই এক উপায়। নোংরা মেখে, চান না-করে, গায়ে চট জড়িয়ে এখানে ওখানে বিগড়ে বিগড়ে দিন কেটে গেল বেশ। আমার শরীরটার উপর তখন আর কারুর লোভ হয় না। পোড়া রূপ জ্বলে গেল। আমাকে দেখে সবাই ঘেন্না করত। কেউ কাছে ঘেঁষত না।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু তোমার যে কতো কষ্ট হল? ’
কচিদিদা বলল, ‘কষ্ট না ছাই! দারুণ মজা। রান্না করতে হবে না, বাসন মাজতে হবে না, ঘর নিকোতে হবে না। সংসারের কোনো ঝঞ্ঝাট নেই! কুড়িয়েবাড়িয়ে খাও আর পথের পাশে নির্ভয়ে কুকুরদের সঙ্গে ঘুমাও। অভিজ্ঞতাও যে হল কতো!’
আমি বললাম, ‘কীরকম?’
কচিদিদা বলল, ‘সংসার-সমাজের বেশিরভাগ লোক দিনে একরকম, রাতে আরেকরকম। সামনে থেকে দ্যাখো, কী নিপাট ভদ্রলোক! কতো ভালো ভালো, মিষ্টি মিষ্টি কথা, কতো সাজগোজ, কতো প্রতিপত্তি! অথচ রাত্রে সেই লোকগুলোরই মুখোশ খসে পড়ে। বেরিয়ে আসে তাদের আসল মুখ। ঘেন্না, ঘেন্না! কুকুরবেড়ালেরও অধম! এইসব মজা দেখে দেখেই তো দিব্বি ফুর্তিতে জীবনটা কাটিয়ে দিলাম।’
‘তো আবার ফিরলে কেন?’
‘গ্যাঁড়াটা বড় হয়ে বে-থা করে আমাকে ডাকল যে! ওর ঠাকুমা পটল তুলল। আমারও বয়স হচ্ছে। ভাবলাম, যাই। মাথার ‘অসুখ’ সারিয়ে ফেললাম। সাবান দিয়ে চান করে পরিষ্কার-ঝরিষ্কার হলাম। বাড়িতে এসে উঠলাম। গ্যাঁড়া, গাঁড়ার বউ খুবই যত্নআত্তি করে আমাকে, তা বলতে নেই। তবে আমি আলাদা খাই। নিজের মতো থাকি। ভিক্ষেশিক্ষে করে যা জমিয়েছিলাম, সেই টাকাতেই দিন চলে যায়।’
তারপর একটু থেমে আমাকে বলল, ‘তা তুমি যে ফিরলে? এখন আবার সংসার করবে বুঝি?’
আমি বললাম, ‘নাহ। আবার চলে যাব।’
কচিদিদা খুব খুশি হয়ে বলল, ‘ঠিক। সংসারে থেকো না। ও আমি অনেক দেখেছি। সংসারে বেশিরভাগই মুখোশ পরে আছে। আমার সব্বাইকে জানা হয়ে গেছে। থেকো না এখানে। চলে যাও। চলে যাও।’
ধুলামাটির বাউলের সব পর্ব পাবেন এই লিংকে