হিমালয়ের চম্পাবতে ছয় হাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতায় উনিশ শতকের একেবারে শেষ দিকে স্বামী বিবেকানন্দ যখন মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তখন তাঁর নির্দেশ ছিল, এই আশ্রমে কোনো ঠাকুরঘর থাকবে না। কোনো দেবদেবীর ছবি বা মূর্তি পূজা করা হবে না। এমনকি নিরাকার ঈশ্বরকে দয়াময়, কল্যাণময় বলে স্তুতি বা প্রার্থনাও করা যাবে না। এই আশ্রমের আশ্রমিকরা সেই ত্রিগুণাতীত ব্রহ্মসত্তাকে কেবল নিজের সত্তা বা আত্মারূপে জ্ঞান করবেন। এই অদ্বৈতবোধই মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমের লক্ষ্যরূপে স্বীকৃত।
জায়গাটি খুব ঠান্ডা। লোহাঘাট থেকে নয় কিলোমিটার চড়াই পথ। চারিদিকে আকাশস্পর্শী পাইন, দেওদার আর রডোডেনড্রনের বন। প্রথমবার আমি গেছিলাম মার্চ মাসে। আশ্রমের গেটটি একেবারেই ছোটো। গেট ঠেলে ঢুকে দেখলাম, অনেকটা জায়গা জুড়ে কতো রঙের শুধু ফুল আর ফুল। পরে জেনেছিলাম, একজন জাপানি সন্ন্যাসী, নাম তাঁর আকিরা মহারাজ, এই এতোরকম ফুলের চাষ করেছেন।
ছোট্টো আশ্রম। কাঠের ঘর চারিদিকে। মাঝখানে একটি লাইব্রেরি। লাইব্রেরির মেঝে কার্পেটে মোড়া। ঘরের এক কোণে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে। এই ঘরেই স্বামী বিবেকানন্দ এসে বাস করেছিলেন এক পক্ষকাল। তাঁর তখন খুব শরীর খারাপ। হাঁপানির টান। সেখানে বসলেই মনে হয়, স্বামীজী যেন এখনও এই ঘরেই আছেন। ঘাড় ঘুরোলেই তাঁকে দেখতে পাবো।
আরও পড়ুন, প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস অনাবৃত
আমাকে একটি ছোটো ঘরে থাকতে দেওয়া হল। দুপুরবেলা গিয়ে পৌঁছেছি। সারা শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে আছে। ভাবলাম, স্নান করব। জনৈক স্বামীজী আমাকে বললেন, আমি যেন গিজার থেকে গরম জল নিয়ে ঠান্ডা জলের সঙ্গে মিশিয়ে স্নান করি। কিন্তু কী যে খেয়াল চাপল, টয়লেটে ঢুকে ঠিক করলাম, ঠান্ডা জলেই স্নান করব। বালতিতে ট্যাপের জল ভরে এক মগ ঠান্ডা জল মাথায় ঢালতেই মনে হল, আমি আর নেই। একেবারে ব্রহ্মজ্ঞান হয়ে গেছে। হাত-পা সব অসাড়। মালুম হল, কেন আমাকে গরম জল মিশিয়ে নিতে বলা হয়েছিল।
খুবই সাধারণ সাত্ত্বিক আহার। সাধুরা খাবার সময় গল্পগাছা, হাসিঠাট্টা করছিলেন। বেশ একটু জোরে জোরেই কথা বলছিলেন। আমি এটা লক্ষ করেছি, খুব নির্জন জায়গায় মানুষ জোরে জোরে কথা বলতে চায়। নৈঃশব্দ্যকে মানুষ ভয় করে। নীরবতার জঠর ভরিয়ে দিতে চায় শব্দ দিয়ে।
খাওয়াদাওয়া হয়ে যাওয়ার পর সব একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল। সাধুরা যে যার কাজে বা ঘরে ফিরে গেছেন। একটিও আওয়াজ নেই। একেবারে থমধরা নিথর নৈঃশব্দ্য। একটু পরে মনে হল, কীসের যেন ডুব-ডুব আওয়াজ হচ্ছে। বেশ স্পষ্ট অথচ গম্ভীর। খাট থেকে উঠে দরজা খুলে বারান্দায় এদিকে ওদিকে খুঁজলাম। শব্দের উৎস খুঁজে পেলাম না। অথচ যেখানেই যাই, শব্দটা একইরকমভাবে হচ্ছে। একটুও বাড়ছে না, কমছেও না। ডুব-ডুব, ডুব-ডুব। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, শব্দটা কীসের। আমারই হার্টবিটের শব্দ। ডাক্তারবাবুরা যাকে বলেন, লাব-ডুব সাউন্ড। হৃৎপিণ্ডের কপাটিকাগুলি খোলা ও বন্ধ হওয়ার আওয়াজ। সমতলে আমরা যখন থাকি, তখন বাতাসে এতোরকম শব্দ মিশে থাকে যে, এই শব্দটি আমাদের শ্রুতিগোচর হয় না। মায়াবতী আশ্রমের নির্জনতায় বাতাসে এতদূর শব্দের অভাব, নিজের হৃৎশব্দও অতর্কিতে শোনা যায়।
আশ্রমের সামনে বাগানে এসে দাঁড়িয়ে চারিদিকে মুখ তুলে তাকালে দেখা যায়, আকাশস্পর্শী ঘনবনসমাবিষ্ট উত্তুঙ্গ গিরিশিরোদেশ। বাগানের উল্টোদিকে পাথরের তৈরি একটি দোতলা বাড়ি—অদ্বৈত আশ্রমের মুখপত্র ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকার অফিস। সেই অফিসের পেছন দিয়ে একটা শীর্ণ পথ উঠে গেছে পাহাড়ের গায়ে। ওই পথ ধরে আরও উপরে নানাদিকে চলে যাওয়া যায়।
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন মনে পড়ে কী পড়ে না
সেদিনটা কাটল। পরের দিন সকালে আমি ঠিক করলাম, ওই পথ দিয়ে উঠব। শুনেছি, আরও হাজার ফিট উপরে পুরোনো লোহাঘাট বলে একটা জায়গা আছে। বড় বড় পাথর ছড়ানো সেই জায়গাটি পাহাড়ের উপর একটি সামতলিক স্থান। শুনেছিলাম, ওইখানেই স্বামীজী প্রথম আশ্রম স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কাছাকাছি কোনো জলের উৎস পাওয়া যায়নি বলে সেই পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়। পরে ক্যাপ্টেন সেভিয়ার ও মিসেস সেভিয়ার—স্বামীজীর অনুরাগী বৃদ্ধ দম্পতি আজকের মায়াবতী আশ্রমের জমিটি কিনে ইংল্যান্ড থেকে পাকাপাকিভাবে চলে এসে আশ্রম স্থাপন করে থাকতে আরম্ভ করেন।
আমি ঠিক করলাম, হাজার ফিট উপরের সেই পুরোনো লোহাঘাট জায়গাটিতে যাব। সেখানে নাকি স্বামীজীও গিয়েছিলেন। বিশ শতকের প্রথম বছরটি তখন। ১৯০১। আর মাত্র এক বছর তিনি বেঁচে থাকবেন। বিবেকানন্দ তখন অত্যন্ত অসুস্থ। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে বসেছিলেন পথের পাশে একটি পাথরের উপর।
সব সাধুরা আমাকে সেখানে একা যেতে বারণ করলেন। বললেন, কয়েকদিন পর তাঁরাই আমাকে নিয়ে যাবেন। পথ দীর্ঘ, দুরারোহ, পিচ্ছিল। তা ছাড়া এ অঞ্চলে বাঘের ভয়ানক উৎপাত। আশ্রমের গোশালা থেকে কয়েকদিন আগেই বাঘ গোরু তুলে নিয়ে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করেছে। দুদিন আগেই আশ্রমের সামনে বাঘের শ্রীচরণের ছাপ পাওয়া গেছে। সেই ছাপ তাঁরা আমাকে দেখালেন। এ অবস্থায় পুরোনো লোহাঘাট একা একা যাওয়া ঠিক নয়, বারবার তাঁরা আমায় বোঝালেন। আমি ভালো ছেলের মতো চুপচাপ তাঁদের কথা শুনলাম।
পরের দিন দুপুরবেলায় সবাই যখন নানাদিকে কর্মনিরত, আশ্রম শুনশান, আমি চুপি পায়ে বেরিয়ে এলাম। হাতে একটা লাঠি নিয়েছি। বাঘ তাড়ানোর জন্য নয়। কেননা, বাঘের সুন্দর চেহারা দেখলে আমি এতোটাই মুগ্ধ হয়ে যাবো যে, হাত থেকে লাঠি খসে পড়ে যাবে। তাহলে লাঠি নেওয়া কেন? লাঠিটা আগে ঠুকে ঠুকে মাটি কতটা পিছল পরীক্ষা করে তারপর পা ফেলব, এই আর কি! তাছাড়াও কিঞ্চিৎ রোমান্স! হাতে লাঠি, বেশ একটা পরিব্রাজক পরিব্রাজক ভাব হচ্ছে।
কিশোরী মেয়ের সিঁথির মতো অস্পষ্ট, অসংজ্ঞায়িত হিমালয়ের সেই সব পথ। একটু এগোলেই এক পথ থেকে দুটো করে ফ্যাঁকড়া বেরোয়। কোনটা অধিক পায়ে চলার পথ, না-বের করতে পারলে ভুল পথ দিয়ে হাঁটার সম্ভাবনা। সেক্ষেত্রে এ ভুলভুলাইয়ার ভিতর ঘুরেফিরে বারবার একই জায়গায় ফিরে আসা ছাড়া গতি নেই। দু-চারবার আমারও সেরকম হল। সরু পথের দুপাশে পাইনের জঙ্গল। মসৃণ, তৈলচিক্কণ পাইনের পাতা পড়ে সেই পথ একেবারে পিছল। তার উপর গাছ থেকে ঝরে পড়ছে ‘শীত আর শিশিরের জল’। ফলত, পা পিছলোলেই একেবারে মুখব্যাদানকারী হাজার হাজার ফিট গভীর খাদে গিয়ে পড়ব। নাহ, আর বাঁচানো যাবে না তখন কোনোমতেই। দেহটিও পাওয়ার সম্ভাবনা অল্প।
আমি সাবধানে এগোতে লাগলাম। দুয়েকবার কয়েক হাত পেছনদিকে গড়িয়েও পড়লাম পা পিছলে। সৌভাগ্যক্রমে খাদে পড়িনি। আশ্চর্য নৈঃশব্দ্য! একটা পাখিও ডাকছে না। পথ ক্রমশ উপর দিকে উঠছে। হঠাৎ এক জায়গায় হাজার ফিট গভীর খাদের নীচ থেকে প্রচণ্ড একটা ডাক শুনতে পেলাম। ভাবলাম, গোরুর ডাক। কিন্তু তার পরক্ষণেই আবার সেই প্রলয়ঙ্কর গর্জন পাহাড়ের উপত্যকাকে কাঁপিয়ে দিল। এবার আর বুঝতে অসুবিধে হল না, কীসের ডাক ওটা।
চিড়িয়াখানার নেশাতুর বাঘ নয়, সার্কাসের চাবুক-খাওয়া মানুষের পোষ-মানানো বাঘ নয়, অরণ্যের বিভীষিকা সেই কুমায়ুনখ্যাত বন্য হিংস্র শার্দুল। গনগনে হলুদ আগুনের মতো, চকিত বিদ্যুতের মতো যে দেখা দেয় তার বিরাট আকার ও সজীব রোমশ উচ্ছ্বাস নিয়ে। আবার, আবার সেই গর্জন। এবার আরও একটু কাছে। চোখ বুঝলাম। আওয়াজ শুনে মনে হল, রাজকীয় বিক্রম তো একেই বলে। এ গর্জন শুনলেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়।
ভাবলাম, যাই হোক না কেন, ফিরে যাবো না। এই পথ দিয়েই তো স্বামীজী গিয়েছিলেন। একা। নির্ভয়। হয়ত এখনও তিনি পুরোনো লোহাঘাটের সেই পাথরটার উপর বসে বিশ্রাম করছেন। আমি তাঁর কাছে যাবো। বাঘ আমার কিছু করতে পারবে না। যাবোই আমি তাঁর কাছে। তিনিও নিশ্চয়ই আমারই জন্য সেখানে বসে আছেন। যাবো আর তাঁর কোলের উপর গিয়ে লুটিয়ে পড়ব। মেরে পেয়ারিলাল, তুমি কোথায়? আর কতদূরে বসে আছ, মেরে লালা, মেরে জান, আমারই জন্য অনন্ত প্রতীক্ষায়?
এই সব ভেবে মনে আরও জোর এনে হাঁটতে লাগলাম।
কিন্তু সেই পথ অত্যন্ত শ্রমসাধ্য। আমি সুস্থ মানুষ। আমারই সারা শরীর ঘামে ভেসে যাচ্ছে। কামারের হাঁপরের মতো আমার বুক উঠছে, পড়ছে। প্রচণ্ড হাঁপ ধরেছে। ভাবছিলাম, স্বামীজীর তো প্রচণ্ড অ্যাজমা ছিল। তাহলে কতোই না কষ্ট হয়েছিল তাঁর এই পথে। আমার মাথা ঘুরছে, ভীষণ জলতেষ্টা পাচ্ছে। হাতের লাঠি বারবার পথের উপর ছড়ানো পাইনের পাতায় স্লিপ করছে। বুঝতে পারলাম, সাধুরা কেন আমাকে একা এ-পথে আসতে বারণ করেছিলেন।
কিন্তু এখন আর ফেরারও কোনো অর্থ হয় না। এতটা এলাম, আর যাবো না? শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে। কোথায় সেই পুরোনো লোহাঘাট? ভুল পথে এসেছি নাকি? ক্লান্ত, অবসন্ন, হতাশ হয়ে পথের পাশে একটা উঁচু জায়গায় খানিক বিশ্রাম নেবার জন্যে বসে পড়লাম।
কিন্তু শরীরে তখন শেষ শক্তি ফুরিয়ে গেছে। হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। আর সেই শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাহ্যসংজ্ঞা হারিয়ে ডুবে গেলাম এক মুহূর্তে অতল ঘুমের ভিতর।
কতোক্ষণ ওইভাবে ছিলাম, জানি না। কিছুক্ষণ পর যখন জ্ঞান ফিরল, দেখলাম চারিদিকে অরণ্যপরিবেষ্টিত পাহাড়ি পথের পাশে একটা পাথরের চাতালের উপর আমি শুয়ে আছি। শিয়রের কাছে আরেকটা চওড়া পাথরের স্ল্যাব। এখানে এমন পাথরের স্ল্যাব কোথা থেকে এল? অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেই চওড়া আনুভূমিক পাথরটার গায়ে ইংরেজিতে কীসব লেখা আছে। পড়তে পড়তে শিহরিত হয়ে উঠলাম। পাথরটায় গায়ে যা লেখা আছে, বাংলায় তাকে তর্জমা করলে দাঁড়ায়-
এই সেই পবিত্র প্রস্তর, যার উপর ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ ক্ষণতরে বিশ্রাম করেছিলেন।
ধুলামাটির বাউলের সব পর্ব পাবেন এই লিংকে