যার শুরু আছে, তার শেষ আছে।
এই কথাটা বুঝতে ভারতীয়দের বেশি বেগ পেতে হয়নি। গ্রীষ্মপ্রধান দেশ, বছরের বেশিরভাগ সময় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তকালে কুয়াশা পড়ে না, চোখ আটকায় না কোনো কুহেলিধূসর ঘোমটায়। সকালের সূর্য কেমন বেলা বাড়লে টলতে টলতে মাথার উপর দিয়ে আকাশের মাঠ পার হয়ে দিনান্তে পশ্চিম দিগন্তে মুমূর্ষু বৃদ্ধের মতো ঢলে পড়ে, চরাচর অন্ধকারে ঢেকে যায় আর সায়াহ্নের তমসায় একটি একটি করে স্মৃতির ক্ষতচিহ্নের মতো তারা জেগে ওঠে নৈশাকাশে, আরেকটি প্রভাতের ইশারার অপেক্ষা করে বিশাখা, জ্যেষ্ঠা, শ্রবণা, ভাদ্রপদ, কালপুরুষ, লঘু সপ্তর্ষিমণ্ডল কেমন করে—ভারতীয়রা সেসব তাদের অস্তিত্বের আদিপর্ব থেকে দেখে আসছে।
ফলত, খুব সহজেই এই যে দেহ, যা মায়ের গর্ভ থেকে আরম্ভ হয়েছে, তা যে একদিন মাটিতে মিশে যাবে, সেই কথাটা ভাবতে, তাকে জীবনের অমোঘ সত্য হিসেবে নিরাবেগ মেনে নিতে অসুবিধে হয়নি ভারতীয়দের।
এবং দেহটাই সেই খোলস, সেই নির্মোক, যা ভেঙে যায়, ছিঁড়ে পড়ে। একে স্থায়ী করে তোলার প্রয়াস শুধু রঙজ্বলা একটা মুখোশের গায়ে নতুন করে রঙ, মোম, পালিশ, জরি লাগানোর মতোই ক্লান্তিকর আর অর্থহীন—কেউ কেউ একথা জেনেছিলেন। সেই অর্থহীন কারুবাসনাকে সানন্দে পুঁটুলি পাকিয়ে কালের নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যাঁরা হা হা করে হেসে উঠে আজাদ হয়ে গেছিলেন, তাঁরা সন্ন্যাসী। বৈদিক যুগে সন্ন্যাসীরা নগ্ন থাকতেন তাই। খোলসের উপর খোলস জড়াতেন না আর।
তাঁরাই ঠিক ঠিক কবি। নগ্নসুন্দর সত্যকে তাঁরা স্তবমন্ত্রে আহ্বান করেছিলেন নিজেদের জীবনে। সেসব কথা তাঁরা লিখে রাখতেন না কোনো রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। চিনতেনই না কোনো রাজারাজড়াদের। আপন মনে নিজের খেয়ালে উচ্চারণ করে উঠতেন কোনো তন্ময় মুহূর্তে, তারপর ভুলে যেতেন। কাছে কেউ থাকলে শুনে শুনে মনে রাখত সেসব আলোকিত উচ্চারণ, এক মুখ থেকে আরেক কানে ছড়িয়ে পড়ত কবিতার পরম্পরা—সেসব কবিতাই যূথবদ্ধভাবে আকলিত হয়ে মন্ত্রপুষ্পের মালা গাঁথত—আবিষ্কৃত হত মুণ্ডক, মাণ্ডুক্য, ছান্দ্যোগ্য, বৃহদারণ্যক।
আরও পড়ুন, প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক উপন্যাস অনাবৃত
তাঁরা সমাজের কেউ ছিলেন না, থাকতেন গিরিগুহায়, বনপথের পাশে, ঝরণার ধারে, নদীতটে, বালুচরে, নির্মুক্ত আকাশের নীচে নির্ভয়। কখনও বা কৌতুকের উপাদান খুঁজতে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়তেন রাজার সভায়—জনক কিংবা জানশ্রুতির রাজত্বে। নৃপতি নেমে এসে বসতেন সিংহাসন থেকে তাঁদের পায়ের কাছে ধুলার মধ্যে। করপুটে অঞ্জলি পেতে রাজা সন্ন্যাসীর কাছে ভিক্ষা করতেন ব্রহ্মজ্ঞান, ব্রাহ্মীকবিতার উজ্জ্বল সারাৎসার।
ধীরে ধীরে এই চর্যাই, কবিতাযাপনের এই টান উপনিষদের কবিসন্ন্যাসীদের একত্রিত করতে লাগল। তাঁরা ঠিক করলেন একসঙ্গে থাকবেন। এ ওর কবিতা শুনবেন। এ ওর জীবন দেখবেন। একসাথে কবিতা হয়ে উঠবেন তাঁরা। ততদিনে তাঁদের কবিতা থেকে ঝরে গেছে নিশ্চয়তার প্রসাদ, অনিশ্চয়তার আধুনিকতা তাঁদের কবিজীবনে এনেছে উত্তুরে বাতাস আর খোলা মাঠের উদাসীনতা। এই সব কবিদের শীর্ষনায়ক এক প্রসন্নগম্ভীর ক্ষত্রিয় যুবাপুরুষ, যিনি রাজ্য ভুলে পথের ধুলা মেখেছেন সর্বাঙ্গে, তাঁর নাম শাক্যপুত্র গৌতম। সত্যকে জানার অনিবার্য চিহ্ন ছিল তাঁর প্রসন্ন আননে, সবাই তাই তাঁকে ‘বুদ্ধ’ বলে ডাকত।
তিনিই সবাইকে ডেকে বললেন, এসো আমরা সকলে মিলে কবিতাযাপন করি। প্রথম প্রথম নগ্নই থাকতেন সবাই, শীতগ্রীষ্ম থেকে বাঁচতে গাছের বাকল টেনে গায়ে জড়াতেন, কিন্তু তারপর যখন ভিক্ষায় যেতে হল পার্শ্ববর্তী কোনো গ্রামে কিংবা নগরীর কোনো পন্থায়, তখনই প্রয়োজন পড়ল কাপড়ের।
কিন্তু কোথায় পাবেন কাপড়? কে কবে দেবে, তার জন্যে বসে থাকবেন কতদিন? সন্ন্যাসীর চোখ সহজেই চলে যায় শ্মশানে, যেখানে চিতার আগুনে পুড়ে যাচ্ছে শরীরের ধূপ। জীবনের এই তো অন্তিম সত্য। চিতায় তুলে দেবার আগে মৃতের দেহ থেকে পুরোনো কাপড় খুলে নিয়ে মাটিতেই ফেলে রেখে যেত শ্মশানবন্ধুর দল। সেই কাপড় বৌদ্ধ শ্রমণরা দিনের পর দিন মাটির উপর ফেলে রাখতেন। খড়ে শিশিরে জলে ভিজে মাটির রঙ ধরত তাতে। তখন তুলে এনে সামান্য জলে ধুয়ে অঙ্গে পরতে লাগলেন তাঁরা উদাসীন সেই চীরবাস। বুদ্ধ যাকে বলতেন চীবর।
কাপড়ে মাটির রঙের ছোপ লেগেছে, গায়ে পরলেই মনে পড়ে যায় শরীরের অন্তিম পরিণতির কথা। এ শরীর মাটি হয়ে যাবে একদিন। এবং শরীর—মাটিতেই সেও মিশবে। সন্ন্যাসীর উপযুক্ত আবরণ এ ছাড়া আর কীই বা হতে পারত?
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতি-সত্তা থেকে তুলে আনা কলাম মনে পড়ে কী পড়ে না
সন্ন্যাসীই তো শুধু নয়, ততদিনে সন্ন্যাসিনীরাও এসেছেন। বৈদিক যুগে তাঁরা ছিলেন ব্রহ্মবাদিনী। প্রথম ঊষার আলোকশিখার মতো ছিল তাঁদের উচ্চারণ, ঊষাপ্রতিম উজ্জ্বল, বিশদ জ্যোৎস্নার মতো ছিল তাঁদের মন্ত্রায়ত রূপ। বৌদ্ধ যুগে তাঁরাই হলেন শ্রমণা। শ্রমণদের থেকে পৃথক সঙ্ঘারামে তাঁরাও থাকতে শুরু করেছেন তখন। শাক্যসিংহের ফেলে আসা জীবনের ছায়ামানবী তাঁরা। পালিকা মাতা গৌতমী, সিদ্ধার্থবধূ যশোধরা, কেউ বা আবার ভ্রাতৃবধূ, কেউ দূরতর আত্মীয়া, কেউ অনাত্মীয়া। তাঁদের জন্য বস্ত্রের বিশেষ প্রয়োজন ছিল।
প্রথমে একটি, পরে দুটি, তারও পরে তিনটি চীবর রক্ষার অনুমতি মিলল। সেই চীবর বস্ত্রে শুকনো ঘাসের হলুদ, মাটির ধূসর, সূর্যের সোনালি আর সূর্যাস্তের গেরুনিম রঙ।
দিন গেল। শত শতাব্দীর সূর্য অস্ত গেল যুগান্তে। এল সম্প্রদায়। কবিতা হয়ে উঠতে লাগল অনুশাসন। কবি হয়ে উঠতে লাগলেন ভাষ্যকার। বৈদিক সন্ন্যাসীরা এতদিনের সুপ্তি ভেঙ্গে বৌদ্ধযুগের উপান্তে উঠে আসতে লাগলেন দুই ধারায়। একদল গুহায়িত সাংখ্যযোগীর দল। অন্যদল তীর্থবাসী বৈদান্তিক। কাশীর ঘাটে উজ্জ্বল গৈরিক বসন পরে এসে বসলেন এক লব্ধপ্রজ্ঞার তাত্ত্বিক। বয়স তাঁর তখনও কৈশোর পেরোয়নি। সেই মেধাপ্রখর মুণ্ডিতমস্তক গৈরিকবাস ষোড়শবর্ষীয় তার্কিক দ্রবিড়কিশোর আচার্য শঙ্কর। কাশীর গঙ্গার পীতাভ স্রোতোধারায় তাঁর অঙ্গের অস্তাভাবিহ্বল গেরুনিম বসনের রঙ মিশে গিয়ে রচনা করল ঔপনিষদ প্রজ্ঞার আলোকিত ভাষ্যবার্তিক।
আরও পড়ুন, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প: গয়ানাথের হাতি
বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সঙ্ঘ ভেঙ্গে যেতে লাগল কালের নিয়মেই। অন্য সব কারণ নিমিত্ত কারণ মাত্র। একে একে নিভে যেতে লাগল নালন্দা, তক্ষশিলা, বিক্রমশীল, জগদ্দল, ওদন্তপুরী বিহারের দেউটি। একটি করে ঘিয়ের প্রদীপ হাতে করে নিয়ে সুদূর তিব্বতে্র কুয়াশাচ্ছন্ন স্তূপমূলে গিয়ে জ্বালালেন পদ্মসম্ভব, শান্তরক্ষিত, কমলশীল, অতীশ। বোধিপথপ্রদীপের আলো ছড়িয়ে পড়ে রইল তাঁদের সেই চলে যাওয়ার পথের উপর।
শূন্যবাদী বৌদ্ধ মাধ্যমিক, বজ্রযানী তান্ত্রিক, সহজযানী কাপালিক, কালচক্রযানী বজ্রযোগী বজ্রযোগিনীর দল সঙ্ঘের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন পথে। আউল-বাউল-সাঁই, তাহার উপর নাই। বৌদ্ধযুগের অন্তিম দশায় কোনো কোনো শ্রমণ ও শ্রমণা একত্রে একাভিপ্রায়ে থাকতেন। বাঁধা পড়তেন প্রেমে, মুক্তি খুঁজতেন কবিতায়। চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের যুগে নগরবাহিরে ডোম-ডোমনি পরিচয়ে সমাজপরিত্যক্ত জীবনে তাঁরাই ‘বুদ্ধনাটক বিসমা’ করেছেন। আরও অনেক পরে তাঁরাই হয়েছেন বাউল-বাউলানী কিংবা ভৈরব-ভৈরবী। পরনের কাপড় কখনও গেরুয়া থেকে হয়েছে হলুদ, কখনও বা সিঁদুরের মতো লাল।
তবু এই গেরুয়া কাপড় বোধহয় অপেক্ষা করছিল কাঁচা গলানো সোনার মতো একটি শরীরকে আলিঙ্গন করার জন্য। বাঙালির হিয়া-অমিয় মথিয়া তাই কায়া ধরলেন নিমাই। কবিতার মুক্তি হল গানে। কঠিন ভাষ্য গলিয়ে নামল প্রেমের সুরধুনী। বাজল খোল, করতাল। কাঁপল পৃথিবী নৃত্যরত মঞ্জুল পদপাতে। উঠল গান অস্ত-আকাশের সীমানায়। সেই আকাশ—যার রঙ মাটির মতই বিহ্বল গৈরিক।
সন্ন্যাস চলে গিয়েছিল তারপর বাঙলার মাটি থেকে। বিবেকানন্দ সেই ত্যাগ বৈরাগ্যের রঙের সঙ্গে মেশালেন আগুনের লোহিতাভা। বিপ্লবের আগ্নেয়সত্তা, কর্মযোগীর রৌদ্রবর্ণ এসে মিশল সন্ন্যাসীর পরিধানে। কবিতা থেকে মন্ত্র, মন্ত্র থেকে গাথা, গাথা থেকে ভাষ্য, ভাষ্য থেকে সঙ্গীত হয়ে এইবার সঙ্গীত থেকে জাগল অভয় বজ্রনাদ। সন্ন্যাসী এবার অভয়ের প্রতিমূর্তি, দশদিকে প্রধাবিত হল অভয়ের বাণীরূপ।
আরও পড়ুন, মৃত্তিকা মাইতির ছোট গল্প: হারমোনিয়াম
কিন্তু কবিতার কী হল? কী হল সেই মৃদুমঞ্জুল উচ্চারণের? একান্ত নিভৃতে জনান্তিক উচ্চারণে যা প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল কোনো গুহাগর্ভে একদিন? সে কি ঘুরে মরে সন্ধ্যার বাতাসে, ভোরের আলোয় সে কি ঝরে পড়ে উদাসী অপরাজিতার মতো? গঙ্গার হাওয়ায় হাওয়ায় সে কি কাঁপে ভেজা আঁচলে আগলানো ভীরু প্রদীপশিখার মতো? নাকি সে চলে গেছে নাগরিক সায়াহ্নের পাশে জনযুদ্ধকলরবক্লান্ত মানুষের ভিড়ে, আমাদের স্বেদ-রক্ত-রণ-বিফলতার মধ্যে, আমাদের উল্লম্ফমান বাজারদরের হিসেবের খাতায়, আমাদের বর্ণিল বিনোদনের পেছনে লজ্জায় লুকিয়ে থাকা সঙ্কুচিত খর্বুটে মুখচোরা শিশুর চোখের ভিতর, ক্ষয়াটে যৌবনের ভিতর কিংবা পরিত্যক্ত জরতী জননীর প্রতীক্ষমাণ দৃষ্টির ভিতর? কবিতা কোথায় গেছে? ঠিকানা কী পলাতকার? কীভাবে কবিতার ছবি ছাপব হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশের অস্পষ্ট ঘোষণায়? নাগরিক-পঞ্জীতে নাম নেই তার?
কনখলে আর রাজামহেন্দ্রীতে দুটো অদ্ভুত পাহাড় ছিল, জানেন? সেখান থেকে পাথর আসত। দুটো শক্ত পাথর দুই হাতে ধরে বালতির জলের মধ্যে ঘষলে তার গেরুয়া কষ বেরিয়ে এসে জলে মিশত। এমনি করে আমরা পেতাম গেরুয়া রঙ। সেই রঙে কাপড় ডুবিয়ে আমিও আমার কাপড় গৈরিক করেছি। মাটির রঙ, অন্তিমতার রঙ, চলে যাওয়ার রঙ, বৈরাগ্যের রঙ, ত্যাগ ও সেবার রঙ। এক দশক আগে কনখল আর রাজমহেন্দ্রীর সেই পাহাড়ের নীচে কপারের খনি পাওয়া গেল। পাহাড় ভেঙে ফেলা হল ক্রেন দিয়ে। খনিগর্ভে নামল মানুষ কপারের লোভে। হারিয়ে গেল সেই গেরুয়া মাটির পাহাড়।
তাই মাটি দিয়ে আর কাপড় রাঙানো হয় না আমাদের। বাজারের কেমিক্যাল আছে; চটজলদি জলে মিশে উজ্জ্বল গৈরিক রঙ তৈরি হয়ে যায়। কাপড় রাঙানোও খুব সহজ। পাকা গেরুয়া রঙ। যেমন গরম, তেমনি আরাম!
যার শুরু আছে, তার শেষও আছে। আমাদের উত্তরপুরুষেরা একদিন অবাক হয়ে ভাববে, গেরুয়া রঙ—কী আশ্চর্য বর্ণিল রূপকথা!
এই কলামের সব পর্ব একত্রে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে