Advertisment

ধুলামাটির বাউল: মাধুকরী ভিক্ষা

ভিক্ষার প্রথম দিনে বেলুড় বাজার পেরিয়ে যে-বাড়িটির সামনে ‘নারায়ণ হরি’ উচ্চারণ করে দাঁড়িয়েছিলাম, তার দরজা খুলে বেরিয়ে এসে একটি মানুষ আমাকে বললেন, আমরা জাতে মুসলমান।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Dhulamatir Baul

অলংকরণ- অভিজিত বিশ্বাস

তিন থেকে পাঁচ বাড়ির বেশি দরজায় দাঁড়াবে না। নদী পার হবে না। ভগবানের নাম ছাড়া আর কিছু উচ্চারণ করবে না। বলবে না, ভিক্ষা দাও। কাঁচা আনাজ দিতে চাইলে বিনীতভাবে নিতে পারবে না জানাবে, কেননা তোমার রান্না করার উপায় নেই। এ ছাড়া যে যা দেয়, নেবে। কাউকে ফিরিয়ে দেবে না। অনর্থক বাক্যবিনিময় করবে না। দ্রুত ফিরে এসে সমস্ত ভিক্ষা ঠাকুরকে আগে দেখাবে। সবার লব্ধ ভিক্ষা মিশিয়ে দিয়ে প্রভুকে নিবেদন করা হবে। তার থেকে তোমাকেও দেওয়া হবে।

Advertisment

সন্ন্যাসের পর ভিক্ষা করতে বেরোনোর আগে অতি বৃদ্ধ সন্ন্যাসগুরু এই কথা বলেছিলেন আমাদের। নিজের জাতি, কুল, পাণ্ডিত্য, মর্যাদার ভুয়ো অহংকার থেঁতলে দেওয়ার জন্যই সন্ন্যাসী ভিক্ষা করেন। কেবল ঈশ্বরের উপর নির্ভর করার জন্যই সন্ন্যাসী ভিক্ষা করেন। নির্বিচার নিঃস্বার্থ দানে কোনো কামনার কলুষ লেগে থাকে না বলে সন্ন্যাসী ভিক্ষা করেন। এ অবারিত শ্রীশম্ভুর সদাব্রত। শিব স্বয়ং ভিখারি। সন্ন্যাসী তাঁরই অনুচর। তাই ভিক্ষা। মৌমাছি বা মধুকর যেমন পাঁচ ফুলের মধু নিয়ে এসে মৌচাকে মিশিয়ে ফেলে ভুলে যায় কোন মধু কে দিয়েছে, সন্ন্যাসীও তেমনই পাঁচ বাড়ি ঘুরে যা পান, সব এনে মিশিয়ে দিয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদন করে আহার করেন। কে গরিব, কে ধনী, ভিক্ষায় তার আর কোনো বিশিষ্টতা থাকে না—ভিক্ষাকে তাই বলে ‘মাধুকরী’।

আরও পড়ুন, প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস অনাবৃত

ভিক্ষার অন্ন বড় পবিত্র, তাতে বাসনার লেশমাত্র নেই।

কিন্তু এই যে নেওয়া, এর বিপরীতে দেওয়ারও তো একটা প্রয়োজন আছে। সমাজের গৃহস্থ লোক কেন সন্ন্যাসীকে খাওয়াবেন? কেনই বা সন্ন্যাসী রিক্তহস্তে তা গ্রহণ করবেন? একথা যিনি প্রথম খুব ভাল করে বুঝেছিলেন, তিনি বুদ্ধ শাক্যসিংহ। তাই তো তিনি তাঁর অনুগামী ভিক্ষুদের বলেছিলেন, চরথ ভিকখবে চারিকং বহুজন হিতায় বহুজন সুখায় লোকানুকম্পায় অত্তায় হিতায় সুখায় দেবমনুসানং—হে ভিক্ষুগণ! দিকে দিকে যাও চলে দেবতা ও মানুষের জন্য বহুজনের হিতার্থে, বহুজনের সুখার্থে, সকলের প্রতি সমব্যথিত হয়ে সকল সত্তার কল্যাণার্থে জীবন উৎসর্গ করো। শুধু আধ্যাত্মিক উপদেশ নয়, লৌকিক কল্যাণের জন্যও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা নিয়ে যেতেন সেবা-উপচার, কখনও ঔষধ দিতেন রোগীকে, শুশ্রুষা করতেন আহতের। আমি দেখেছি, উত্তর ভারতে এখনও খুব সাধারণ মানুষ সাধুদের কাছে ওষুধ চায়। কত হাজার বছরের জাতীয় স্মৃতিসত্তা কম্পিত হচ্ছে দরিদ্রসাধারণের মধ্যে। সেই আমার প্রকৃত ভারতবর্ষ।

এ কথাটি চাপা পড়ে গেছিল ইতিহাসের চক্রনেমির নীচে। সন্ন্যাসী ভিক্ষা অবলম্বন করে জীবন ধারণ করবেন, নিজেকে উৎসর্গ করবেন ঈশ্বরের চরণে। তাঁর এই আত্মনিবেদন থেকেই উত্থিত হবে কল্যাণ, যা দশদিকে বিকিরিত হয়ে মঙ্গল করবে সবার সূক্ষ্মভাবে—এই হয়ে উঠেছিল আমাদের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের মর্মবাণী। কিন্তু লৌকিক উপায়ে সন্ন্যাসী কি সেবা করবেন না সবার? অন্তত রক্ষণশীল সমাজ থেকে এর উত্তর ছিল, না। ওরকম করা সন্ন্যাসীর পক্ষে অব্যাপারেষু ব্যাপার। ওরকম করতে গেলে সন্ন্যাসী জড়িয়ে পড়বেন সংসারে। এই ছিল সনাতনী মত। ফলত, ঈশ্বরকে আমরা পূজা করেছিলাম মন্দিরে, আর ঈশ্বরের অপর মূর্তি মানুষকে আমরা অবজ্ঞা করেছিলাম জীবনে।

বিবেকানন্দ কালের চক্রনেমির নীচ থেকে এই কথাটি তুলে আনলেন প্রকাশ্যে। বললেন, অন্যের মুক্তির জন্য তিনি নরকে যেতেও প্রস্তুত। তাঁর অনুগামীদেরও তাই তিনি পাঠালেন মানুষের নিরন্তর সেবায়। এদিক থেকে দেখলে স্বামীজীর এই বাণী আদিতে তথাগত বুদ্ধেরই বাণী। দার্শনিক প্রতীতিতে ভিন্ন হলেও মূর্খ-নারায়ণ, আর্ত-নারায়ণ, দরিদ্র-নারায়ণের সেবায় তাই বিবেকানন্দ ও তাঁর অনুগামী সন্ন্যাসীরা নিয়োজিত।

কিন্তু ভিক্ষার বিনিময়ে নয়। যদি ভিক্ষার বিনিময়ে হত, তবে তা জীবিকা-উপার্জনের বিকল্প পন্থা হয়ে যেত। সন্ন্যাসীর ভিক্ষা তাই নির্লেপ নিরঞ্জন। তার সেবা কোনো বাধ্যতা থেকে নয়, তা প্রেমে স্বতোৎসারিত।

আমাদের একটা লম্বা মোটা কাপড় দেওয়া হত। তাকে দু-ভাঁজ করে কাঁধের কাছে গিঁট দিয়ে ঝুলিয়ে নিতাম। একে বলে ‘সাপি’। এই সাপিতেই ভিক্ষা নিয়েছি আমরা। ভিক্ষা নিয়ে ফিরে এসে ভিক্ষান্ন আজাড় করে সেই কাপড় গঙ্গায় ধুয়েছি। শুকিয়ে রেখেছি পরের দিনের জন্য।

আরও পড়ুন, বাংলার সংগঠন বাংলা পক্ষ নিয়ে একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন

ভিক্ষার প্রথম দিনে বেলুড় বাজার পেরিয়ে যে-বাড়িটির সামনে ‘নারায়ণ হরি’ উচ্চারণ করে দাঁড়িয়েছিলাম, তার দরজা খুলে বেরিয়ে এসে একটি মানুষ আমাকে বললেন, আমরা জাতে মুসলমান। যদি আমরা ভিক্ষা দিই, তোমাদের ঠাকুর সে-ভিক্ষা নেবেন? আমি বললাম, আমার ঠাকুর হিন্দু-মুসলমান কিছু চেনেন না। আপনি যা দেবেন, তিনি তাই-ই খাবেন।

লোকটি বড় আনন্দ করে ভেতরে গিয়ে রান্না করা ভাত-তরকারি এনে আমার সাপিতে দিল। এই আমার প্রথম ভিক্ষাগ্রহণ।

আরেক বাড়ি। দরজায় দাঁড়িয়ে ‘নারায়ণ হরি’ বলেছি। ভেতরের ঘরে দেখছি একটি মেয়ে রেডিয়োতে ছায়াছবির গান শুনছে। আমাকে দেখে একটু বিরক্ত হয়ে তাকালো। তারপর রেডিয়োটার নব ঘুরিয়ে ভলিউম বাড়িয়ে দিল। আমি দাঁড়িয়ে আছি দেখে মেয়েটির ভাই চেঁচিয়ে তার দিদিকে বলছে, ‘ও দিদি, তোর নারায়ণ-হরি যে দরজায় দাঁড়িয়েই রইল রে!’ সেকথা শুনে মেয়েটি নীচের ঠোঁটে একটা অদ্ভুত তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করল। ভারি সুন্দর ভঙ্গিটি। আমার একটি গল্পে মেয়েটির সেই তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিটি আমি ব্যবহার করেছি। কাজেই মেয়েটির কাছ থেকে আমি অবশ্যই ওই তাচ্ছিল্যের অপূর্ব মুখভঙ্গিটি ভিক্ষা নিয়েছিলাম।

আরেকদিন। আরেক বাড়ি। সেদিন রেলকলোনির দিকে গিয়েছি। বড় গরিব। খোলার ঘর। আমার ডাক শুনে একজন মহিলা বের হয়ে এসে বললেন, আপনি কেন এখানে এখন এলেন? বাড়ির কর্তা বাজারে চাল আনতে গেছেন। রান্না হয়নি। কিছুই দেবার মতো নেই।

দেখলাম, বউটির চোখ ছলছল করছে।

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের ধারাবাহিক স্মৃতিচারণ মনে পড়ে কী পড়ে না

ফিরে আসছিলাম। হঠাৎ তিনি আমাকে পেছন থেকে ডাকলেন। বললেন, আচ্ছা, কী দিতে হয়, কিছুই জানি না। কয়েক মাস আগে আমাদের এক আত্মীয় পুরী গেছিল। সেখান থেকে জগন্নাথদেবের প্রসাদ গজা নিয়ে এসেছে। সেই একটু আছে। আপনাকে দিলে, নেবেন?

আমি খুব কঠোর স্বভাবের মানুষ। হৃদয়াবেগকে বেশি আমল দিই না। কিন্তু এই দরিদ্র রমণীর কথা শুনে পোড়া চোখে আমার বহুদিন পর জল এল। স্নায়বিক দুর্বলতা আর কি!

কিন্তু যেকথা অনেকেই জানেন না, সেই কথা এখানে বলি। জগন্নাথপ্রভুর ওই যে গজা, ওটিই জগতের একমাত্র নিবেদিত প্রসাদ, যা শ্রীরামকৃষ্ণকে পুনর্নিবেদন করা যায়। আমি তা জানতাম। কিন্তু মেয়েটি তো তা জানতেন না। না-জেনেই তিনি আমাকে ওইটি ভিক্ষা দিতে চেয়েছেন। আমি অবাক হলাম, ঠাকুর এভাবে আমার জন্য এই বউটির হাত দিয়ে ভিক্ষার ব্যবস্থা করে রেখেছেন! এ কী অচিন্ত্য লীলা মানুষঠাকুরের!

আমি বললাম, দিন, দিন। আমি নেব।

বউটি তখনই ঘরের ভিতর ঢুকে খাটের তলা থেকে মাটির সরা টেনে বার করে এনে জগন্নাথদেবের সেই গজা-প্রসাদ নিয়ে আমার ভিক্ষার ঝুলিতে দিলেন। দেখলাম, তিনি হাসছেন। হাসিতে, চোখের জলে মুখ তাঁর স্নেহকরুণায় মাখামাখি।

আজও সেই মুখ মনে পড়ে। বিজয়া-দশমীর জলে ভেজা মায়ের বিসর্জিত মুখ।

আরেকটা দিনের অভিজ্ঞতা। দরজায় দাঁড়িয়েছি ভগবানের নাম নিয়ে। একজন ঠাকুমা বেরিয়ে এসে বললেন, ভেতরে এসে বোসো, রান্না হচ্ছে।

আমি বললাম, ভেতরে বসার নিয়ম নেই।

তিনি বললেন, কীসের নিয়ম? ঠা-ঠা করছে রোদ। মুখ তোমার লাল হয়ে গেছে। আমি বলছি, বোসো ভেতরে।

ভয়ে ভয়ে দরজার সামনে একটা বেঞ্চে মাথা নীচু করে বসে আছি। কে একজন লোক বারান্দা থেকে গলা তুলে বলছে, মা গো, দ্যাখো! এই সব ছেলেরা কতো কাজ করতে পারত। তা না-করে ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে।

উত্তরে সেই বৃদ্ধা মহিলার কণ্ঠস্বর শুনলাম। তিনি তাঁর ছেলেকে বলছেন, তোমার ওসব বোঝার ক্ষমতা নেই, বাছা। ওরা কী করছে, তা তোমার মোটা মাথায় ঢুকবে না। যা বোঝো না, তা নিয়ে কথা বোলো না। বেশি বকবক না-করে রেঁধে দিইছি, খেয়ে আমাকে উদ্ধার করে অফিসে যাও।

একটু পরে দেখছি, একটা মোটা বাচ্চা ছেলে বসার ঘরেই একটু দূরে খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে খাতা পেন্সিল নিয়ে লিখছে। কী যেন লিখছে আর বারবার ইরেজার দিয়ে মুছে ঘাড় নাড়ছে। লিখছে আর মুছছে। বাচ্চাটির মুখ আষাঢ়ের আকাশের মতো থমথমে অন্ধকার।

আমি চোখ নাচিয়ে ছেলেটিকে ডেকে চাপা স্বরে বললাম, কী ব্যাপার? কী হয়েছে, ক্যাপ্টেন?

সেও আমার দিকে চোখ নাচিয়ে একই রকম চাপা স্বরে উত্তর দিল, অঙ্কের উত্তর মিলছে না। অঙ্ক না-হলে স্যার মারবে। একখুনি স্যার আসবে।

আমি বললাম, কই? দেখি।

সে ল্যাদভ্যাদ করে উঠে এসে একটু অবাক মুখে আমাকে অঙ্কটা দেখাল। দেখলাম, একটা ভ্যানিশিং ফ্যাকটর। বললাম, কোন ক্লাসে পড়ো তুমি, ক্যাপ্টেন?

সে ফিসফিস করে বলল, ক্লাস সেভেন।

অঙ্কটা সোজাই ছিল। করে দিলাম। ছেলেটি আসলে ট্রায়াল এন্ড এরর মেথডে রুটটা ঠিক করতে পারছিল না। মার খাবার ভয়ের চোটে বাচ্চারা অনেক সময় ঘাবড়ে গিয়ে সহজ অঙ্কও করতে পারে না।

একটু বুঝিয়ে দিতেই বাচ্চাটা বুঝে গেল। বললাম, এখন যাও ওদিকে।

ইতোমধ্যে সেই বৃদ্ধা ভিক্ষা নিয়ে উপস্থিত হলেন। ভাত, ডাল, আলুভাজা আর একটা ঘণ্ট। বললেন, কোথায় দেব?

আমি বললাম, এই যে সাপিতে।

তিনি বললেন, এ মা! এ যে সব মিশে যাবে।

আমি বললাম, মিশে যাক। ওভাবেই নেওয়া নিয়ম।

তিনি গজগজ করতে লাগলেন, বলিহারি নিয়ম বটে, বাপু! সব মিলেমিশে কী সোয়াদটা যে হবে!

আমি হেসে তাঁকে নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে চলে আসছি। এমন সময় শুনতে পেলাম সেই বাচ্চাটি তার ঠাকুমাকে বলছে, মাম্মাম, দ্যাখো, দ্যাখো! সাধু ভিক্ষেও নিল, আবার অঙ্কটাও করে দিল!

আমি কিছুতেই আর হাসি চাপতে পারলাম না। আপন মনে হা-হা করে হাসছি। পথের লোকজন সব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

এই কলামের সব লেখা একত্রে পড়ুন এই লিংকে

dhula matir baul
Advertisment