Advertisment

এনআরসি তালিকাছুটদের নিয়ে কী করবে সরকার?

একবিংশ শতাব্দীতে ভারতে নতুন ধরণের দাস তৈরি করার প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকছে। এ শতাব্দীতে যখন ভারত বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার কথা বলছে তখন বুদ্ধ ও গান্ধীর দেশে নাগরিকপঞ্জি ইস্যুতে মানবিক সমাধান না করে কি অমানবিক সমাধান দেশকে মানাবে?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NRC

সংবাদমাধ্যমের আলোচনা থেকে জানা যাচ্ছে যে অন্তত ১২ লক্ষ হিন্দু বাঙালি ও ১ লক্ষ গোর্খা সম্প্রদায়ের মানুষের নাম নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত খসড়া থেকে বাদ গেছে

৩১ অগাস্ট ২০১৯। অসমে নাগরিকপঞ্জি থেকে ১৯ লক্ষ ছয় হাজারের কিছু বেশি লোক বাদ পড়লেন যা ওই রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৬ শতাংশ। এই বাদ পড়া সংখ্যাটি জুলাই ২০১৮ তে ছিল ৪০ লক্ষ আর জুন ২০১৯এ ছিল ৪১ লক্ষ। অন্যদিকে গত ৩১ অগাস্ট, ৩.১১ কোটি মানুষের নাম নাগরিকপঞ্জির সর্বশেষ ও চূড়ান্ত খসড়াতে ঠাঁই পেল। এই সংখ্যাটি ডিসেম্বর ২০১৭তে প্রকাশিত প্রথম খসড়ায় ছিল ১.৯০ কোটি যা অসমের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের কম। চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জিতে যে ১৯,০৬,৬৫৭ জন মানুষের নাম বাদ পড়ল তাঁরা ১২০ দিনের মধ্যে বিদেশি ট্রাইবুনালে আপিল করতে পারেন। সেখানে তাঁদের কোনো সুরাহা না হলে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন তাঁরা।

Advertisment

কিন্তু মোদ্দা প্রশ্ন সামনে আসছে দুটো। প্রথমত বিদেশি ট্রাইবুনালে যাঁরা যাবেন তাঁদের আর্থ-সামাজিক পরিচিতি কী? দ্বিতীয়ত এই বিপুল সংখ্যার মানুষ কে নিয়ে ভারত সরকার কী করবে? প্রথম প্রশ্নের উত্তরে সংবাদমাধ্যমের আলোচনা থেকে জানা যাচ্ছে যে অন্তত ১২ লক্ষ হিন্দু বাঙালি ও ১ লক্ষ গোর্খা সম্প্রদায়ের মানুষের নাম নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত খসড়া থেকে বাদ গেছে। অন্যদিকে ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে অধিকাংশ গরিব ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ যাঁদের পক্ষে বিদেশি ট্রাইবুনাল থেকে কোর্ট পর্যন্ত আরও দৌড়-ঝাঁপ করা বেশ কঠিন। অথচ তারা বহু দশক ধরে ভারতে বসবাস করেছে এবং অনেকে সরকারি চাকরি করেছেন। এমনকি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ছিলেন বা এখনও আছেন এমন কয়েকজনের নাম বাদ পড়েছে নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত খসড়া থেকে। বহুক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে একই নথিপত্রের ভিত্তিতে একই পরিবারের কিছু সদস্যের নাম নাগরিকপঞ্জিতে আছে আর অন্য সদস্যদের নেই। ১৩০০ কোটি টাকা সরকারি খরচ করার পর যে নাগরিকপঞ্জি নির্ভুল হয়েছে তা কেউ বলছে না। উল্টে এই গোটা প্রক্রিয়াতে সরকারি স্তরে একদিকে অদক্ষতা ও অপটুতা ও অন্যদিকে বাংলাভাষী হিন্দু, বাঙালি এবং অসমীয়া মুসলিম দের বিরুদ্ধে সরকারি বিরূপতার অভিযোগ উঠছে ভুরি ভুরি। কিন্তু নাগরিকপঞ্জি তৈরি করার পর একটি কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে। তা হল অতীতে বিভিন্ন সময়ে ৪০ লক্ষ বা ৫০ লক্ষ থেকে ১ কোটি এমনকি দুকোটি মানুষ ভারতে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ করার যে গাল-গল্প শোনানো হতো তা একটা মিথ ছিল যা কয়েক দশক একটা মিথ্যা প্রচারের ফলে তৈরি হয়েছিল।

আরও পড়ুন, এনআরসি তালিকাছুটদের পরিচিতি আসলে কী? কোথা থেকে আসছে পরিসংখ্যান?

২০১৮ সালে করা একটি তথ্য অধিকার আবেদনের জবাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক স্বীকার করেছে যে ভারতে থাকা অবৈধ পরিযায়ী সম্পর্কে ভারত সরকারের কাছে কোনো সঠিক তথ্য নেই। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করার জন্য সরকার কোনো ব্যাপক বা নিদেনপক্ষে কোনো নমুনা সমীক্ষাও করেনি। অথচ ১৪ই জুলাই ২০০৪ সালে, ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগের তৎকালীন রাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন যে ভারতে ১ কোটি ২০ লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশি পরিযায়ী আছেন, যার মধ্যে ৫০ লক্ষ নাকি অসমে থাকেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নিয়ে যে মত দেয় তাতে উক্ত সংখ্যাটির উল্লেখ আছে। ২০১৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগের তৎকালীন রাষ্ট্রমন্ত্রী আবার দাবি করেন যে সঠিক তথ্য না থাকলেও বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরে জানা যায় ভারতে নাকি প্রায় দুই কোটি অবৈধ বাংলাদেশি পরিযায়ী মানুষ বাস করেন।

২০০৪ সালের যে সরকারি নথি থেকে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের তৎকালীন রাষ্ট্রমন্ত্রী ১ কোটি ২০ লক্ষ সংখ্যাটি উল্লেখ করেছিলেন সেই নথিতেই একটা ব্যাখ্যা ছিল যে উক্ত সংখ্যাটি কোনো সামগ্রিক জরিপ বা নমুনা সমীক্ষার ফল ছিল না। বরং তা লোকমুখে শোনা এবং তার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হল যারা এই বিষয়ে অধিক আগ্রহশীল (অর্থাৎ অবৈধ পরিযায়ী নিয়ে যারা গেল গেল রব তোলে) তাঁদের কাছে থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে উক্ত সংখ্যাটি বলা হয়েছিল। অসম ও পশ্চিমবঙ্গে তাই বাংলাদেশ থেকে আগত কত অবৈধ পরিযায়ী মানুষ আছে তার কোনো সঠিক ও নির্ভুল তথ্য ভারত সরকারের কাছে নেই। ২০০৪ সালে ভারত সরকার ওই নথিতে পরিষ্কার স্বীকার করেছিল এই বিষয়ে যা অনুমান তা অনির্ভরযোগ্য ও ভুল। এই সত্য কথা জনসমক্ষে তেমন একটা উচ্চারিত হয়নি। বরং দশকের পর দশক ধরে চলতে থাকা পূর্ব ধারণার ভিত্তিতে একটা পক্ষপাতমূলক ও বিদ্বেষমূলক প্রচার চালানো হয় যে লক্ষ লক্ষ মানুষ নাকি অবৈধ ভাবে ভারতে বাস করছে।

আরও পড়ুন, নাগরিকপঞ্জি বাস্তবায়নে মোদী-শাহের সামনে বাধা হতে পারে বাংলাদেশ

১৯৭১এর ২৪ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব বাংলা থেকে আগত বাঙালি মুসলিম ভারতে আসার সম্ভাবনা কম। বরং ১৯৫০ ও ১৯৬০এর দশকে নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের বহু মানুষ ভারতে আসেন উদ্বাস্তু হিসেবে। ১৯৭১এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিরাপত্তাজনিত কারণে এবং কর্মসংস্থানের জন্য হিন্দু বাঙালির ভারতে আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ঐতিহাসিক গবেষণা থেকে এখনও পর্যন্ত সেই দিকেই ইঙ্গিত আছে। আবার বহু মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় নথিপত্র হয় হারিয়ে গেছে বা বন্যা ও কর্মসূত্রে ভ্রাম্যমাণ থাকার কারণে বহু গরিব মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় নথি নেই। অসমের নাগরিকপঞ্জির প্রক্রিয়া থেকে এখনও পর্যন্ত মোটা দাগে এই কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার হচ্ছে।

কিন্তু দ্বিতীয় প্রশ্নটি অর্থাৎ ১৯ লক্ষের উপরে এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিয়ে ভারত সরকার করবে কী এর জবাব পাওয়া যাচ্ছে না। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রী জানিয়েছেন যে অসমের নাগরিকপঞ্জি নিয়ে তারা বিশেষ চিন্তিত নয় কারণ তারা ভারতের বিদেশমন্ত্রীর কাছে আশ্বাস পেয়েছে যে নাগরিকপঞ্জি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু অধিক সতর্কতার জন্য বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের সীমান্ত আরও জোরদার করা হয়েছে কারণ তা অসমের নিকটবর্তী অঞ্চল। অর্থাৎ বাংলাদেশের পক্ষে এই বিপুল সংখ্যার মানুষ কে নিজেদের দেশের নাগরিক বলে বিবেচনা করার সম্ভাবনা কম। অন্যদিকে অসম ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের আঞ্চলিক দলগুলি এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াবে না। তাহলে এই বিপুল সংখ্যার মানুষের জন্য কি কোনো মানবিক সমাধান করা যেতে পারে? একটা সমাধান হল এই মানুষগুলোকে এমন কিছু রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পুনর্বাসন দেওয়া যেখানে জাতীয় গড়ের তুলনায় গত এক দশকে সেই রাজ্য বা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে জনসংখ্যা বেশ কম হারে বেড়েছে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারতের চার রাজ্য, বাংলা, ওডিশা, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাবের সঙ্গে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ও লাক্ষাদ্বীপের কথা ভাবা যেতে পারে। এতগুলো রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ওই মানুষগুলোকে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সূত্র ধরে ভাগাভাগি করে পুনর্বাসন দেবার বন্দোবস্ত করলে ওই সব রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলগুলোয় বিশেষ সামাজিক ও আর্থিক প্রভাব পড়বে না।  এছাড়া আরেকটা মানবিক সমাধান হল এই পুরো প্রক্রিয়াটাই বাতিল করা যেটা সম্ভবত বর্তমান কেন্দ্রের সরকার করবে না।

আরও পড়ুন, নাগরিকপঞ্জি: হিন্দু না ওরা মুসলিম…

কিন্তু তাছাড়া যেদিকে এই সমস্যা এগোচ্ছে তার থেকে দুটি সম্ভাবনা আছে। এক, জনগণের করের টাকায় গঠিত হবে বিরাট মাপের সব বন্দিশালা। সেখানে ওই বিপুল সংখ্যার মানুষ কে আটক করে রাখা হবে। সেই বন্দিশালা চালাতে আরও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ হবে আপনার এবং আমার করের টাকায়। অথচ ওই টাকা কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিকাঠামো তৈরি করতে খরচ হতে পারতো। আর দ্বিতীয় সম্ভাবনা হল ওই মানুষগুলোকে টাকা অপচয় করে জেলবন্দি না করে রাষ্ট্র তাদের ভোট এবং অন্যান্য নাগরিক অধিকার কেড়ে নিল। এহেন কথা ভারতের উগ্র-দক্ষিণপন্থীরা মাঝে মধ্যে বলেই থাকে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং নাগরিকদের কাছে ওই মানুষগুলো যেহেতু অসুরক্ষিত তাই তাদের দিয়ে অতি সস্তায় বা বিনা পয়সায় শ্রম আদায় করার সম্ভাবনা থাকছে। অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীতে ভারতে নতুন ধরণের দাস তৈরি করার প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকছে। এ শতাব্দীতে যখন ভারত বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার কথা বলছে তখন বুদ্ধ ও গান্ধীর দেশে নাগরিকপঞ্জি ইস্যুতে মানবিক সমাধান না করে কি অমানবিক সমাধান দেশকে মানাবে?

(মইদুল ইসলাম সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস কলকাতায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত)

nrc Assam
Advertisment