Advertisment

নয়া নাগরিকত্ব বনাম জুতা হ্যায় জাপানি, পাৎলুন ইংলিশস্তানি

দেশের অর্থনীতি নিয়ে এই মুহূর্তে বিজেপির কাছে কিছু নেই যা দিয়ে ভোটে জেতা যায়। ফলে আপাতত হিন্দু-মুসলমানের রাজনীতিই বিজেপির হাতে একমাত্র অস্ত্র।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
CAB, Modi Sarkar

পিছিয়ে যাওয়া, বাতিল হয়ে যাওয়া দর্শন এখন মোদী সরকারের কল্যাণে আমাদের দেশের নতুন আদর্শ হিসেবে চালানো হচ্ছে, তার ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছে নতুন আইন

স্বাধীনতার পর পর, ১৯৫৫ সালে শ্রী৪২০ নামে একটা হিন্দি ছবির কথা দিয়ে এবারের বেঙ্গল লাইনের লেখা শুরু করছি। ছবির নায়ক রাজকাপুরের মুখে মুকেশের গলায় একটা গান। ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি, এ পাৎলুন ইংলিশস্তানি, সরপে লাল টোপি রুশি, ফিরভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি..’। গানটা শোনেননি, এমন ভারতীয় বোধহয় নেই। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল যেদিন পাশ হয়ে গেল, সেদিন মনে হচ্ছিল, নানা বৈচিত্রের মধ্যে এই যে ‘হিন্দুস্তানি দিল’, তার মৃত্যু হল। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, খুন। বহু দিন ধরে আড়ালে অপেক্ষা করে থাকা হত্যাকারীরা অবশেষে সফল হল। আসুন আমরা ‘হিন্দুস্তানি দিল’-এর মৃত্যুতে এক মিনিট নীরবতা পালন করি।

Advertisment

গুজরাটে ২০০২ সালে নরেন্দ্র মোদীর মুখ্যমন্ত্রিত্বকালীন দাঙ্গায় কয়েক হাজার সংখ্যালঘু নারী, শিশু, পুরুষ হত্যা হয়েছিল। গত ৫০ বছরে ওই রকম কোনও সংখ্যালঘুহত্যার ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেনি। সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর যে সব অমানবিক, অন্যায় অত্যাচারের ঘটনা ঘটে, গুণে দেখলে ভারতে সংখ্যালঘু এবং দলিতের উপর অন্যায় অত্যাচারের ঘটনা কম তো নয়ই, তার থেকে বেশিই ঘটে থাকে। এই ব্যাপারে একটা সমীক্ষা প্রকাশ করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।

সাধারণ মানুষের মত না নিয়ে রাতারাতি একটা দেশকে কেটে দু’টুকরো করা হয়েছিল। ফলে নানান কারণে বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে সীমা পারাপার লেগেই ছিল। এবং সেটাই স্বাভাবিক। দেশভাগের অভিশাপ মাথায় নিয়ে কখনও কাজের খোঁজে, কখনও আত্মীয়ের টানে, কখনও অত্যাচারের ভয়ে বা অত্যাচারিত হয়ে এই পারাপার কম বেশি জারি ছিল। কম-বেশি বললাম, কারণ অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশিদের গন্তব্য ভারত থেকে অন্য দিকে সরে যাচ্ছিল।  তার অনেক কারণের মধ্যে প্রধান কারণ, সামাজিক উন্নয়নের যে আন্তর্জাতিক মাপকাঠি, তাতে অনেক দিন ধরেই দেখা যাচ্ছিল বাংলাদেশ ভারতের থেকে বেশ কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে।

লন্ডনে ইংরেজির পরই দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে যে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়া হল কিছু দিন আগে, সেটা বাংলাদেশিদের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য। বৃটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টির হয়ে যে পাঁচ জন বাঙালি সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা সবাই বাংলাদেশি। এটা সম্পূর্ণ তথ্য নয় নিশ্চয়ই তবু আন্দাজ করা যায়, বাংলাদেশিদের গন্তব্য ধীরে হলেও বদলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচার হয় না তা নয়। সেটা ছাড়াও আরও অনেক কারণ আছে তাদের এই দেশে চলে আসার। যার প্রধান কারণ আত্মীয়তা। সংখ্যালঘু-দলিতদের উপর অত্যাচারের নিরিখে বাংলাদেশ আমাদের থেকে এগিয়ে এমন তথ্য কেউ এখনও দিতে পারেনি।

নাগরিকত্ব বিলের মূল্য দিতে পারবে তো ভারতবর্ষ?

আমাদের দেশে যেখানে যেখানে মাঝে মধ্যেই সংখ্যালঘু এবং দলিতদের পিটিয়ে খুন করার খবর হেডলাইন হয়, ওই খুনে অভিযুক্তরা জামিনে মুক্তি পেয়ে মন্ত্রীর বাড়িতে হাসি মুখে মিষ্টি খাচ্ছে ছবি প্রকাশিত হয় খবরের কাগজে, তা নিয়ে আমাদের তেমন মাথাব্যথা নেই, উল্টে চিৎকার করে যাচ্ছি, হিন্দুদের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি মুসলিমও বেআইনি ভাবে আমাদের দেশে ঢুকে পড়েছে। কথাটা যে অনেকটাই মিথ্যা, তা প্রমাণ হয়ে গেল যখন দেখা গেল অসমে এনআরসি থেকে বাদ পড়েছেন যারা তাদের মাত্র তিন-চার লক্ষ মুসলিম। ঠিক মতো স্ক্রুটিনি হলে এই সংখ্যা কমে ১-২ লক্ষে দাঁড়াতে পারে। হিন্দুর সংখ্যা ১২ লক্ষ, বাকিটা অন্যান্য।

১৯ লক্ষ মানুষকে অসমে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বলা হল এনআরসি করে। এই ১৯ লক্ষ মানুষের কী বক্তব্য ছিল তখন? প্রত্যেকে নিজেদের কাছে থাকা যাবতীয় কাগজ-পত্র দেখিয়ে তাঁরা দাবি করেছিলেন তাঁরা ১৯৭১-এর আগে থেকেই ভারতে আছেন। এনআরসি কর্তারা তাঁদের কথা মানেননি। ১৯ লক্ষ নাম বাদ পড়ল জাতীয় নাগরিক পঞ্জি থেকে। এখন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হয়েছে। ওই ১২ লক্ষ হিন্দুকে এখন বলতে হবে, আগে তাঁরা মিথ্যা বলেছিলেন, ১৯৭১-এর আগে থেকে তাঁরা এদেশে নেই, তাঁরা সংখ্যালঘু হিসেবে অত্যাচারিত (পারসিকিউটেড) হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছেন ২০১৪-এর ৩১ ডিসেম্বরের আগে। কারণ নতুন আইনে বলা হয়েছে, যে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হিসেবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে অত্যাচারিত হয়ে ভারতে এসেছেন তাঁদেরকেই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে হয় ওই ১৯ লক্ষ মানুষ হয় আগে (এনআরসি কর্তাদের সামনে) মিথ্যা বলেছেন।  নয় তো নতুন আইনে আবেদন করার জন্য তাদের মিথ্যা বলতে হবে, বলতে হবে ৭১ সালের আগে থেকে তারা এই দেশে নেই, অত্যাচারিত হয়ে পরে ভারতে এসেছেন। নতুন এই আইন ১২ লক্ষ হিন্দুকে এই অস্বস্তিকর জায়গায় নিয়ে দাঁড় করাচ্ছে। এটা এই আইনের একটা বড়ো দুর্বলতা। যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা না করে শুধু ধর্মীয় বিদ্বেষের উপর নির্ভর করে কোনও বড়ো কাজ যে সুচারু ভাবে সম্পন্ন করা যায় না, এটা তার প্রমাণ।

মোদী সরকার গুরুত্ব দিতে রাজি নয়, কিন্তু এই আইন নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের মুখ খুব একটা উজ্জ্বল হচ্ছে না। প্রথম বিরূপ প্রতিক্রিয়া এসেছিল  নাগরিকত্ব বিল লোকসভায় পাস হওয়ার সঙ্গ সঙ্গে। আমেরিকার ‘ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ বা ‘ USCIRF’ সংস্থা কার্যত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের উপর  স্যাংশন বা নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনকে।

গত মঙ্গলবার ‘ USCIRF’  তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে এক বিবৃতি প্রকাশ করেছে নাগরিকত্ব বিল নিয়ে। সেখানে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের উপস্থাপনায় লোকসভায় যে নাগরিকত্ব বিল পাস হয়েছে, তা নিয়ে ‘ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ সংস্থা গভীর ভাবে বিব্রত বোধ করছে। রাজ্যসভাতেও এই বিল পাস হয়ে গেলে মার্কিন সরকারের অবশ্যই ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের উপর কিছু স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত। ওই বিবৃতিতে ‘ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ বলেছে, ‘ক্যাব’ অন্য দেশ থেকে আসা মানুষদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিল। কিন্তু এর সুযোগ থেকে মুসলিমদের বাদ দেওয়া হয়েছে। ভারতের বহুত্ববাদী, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ থেকে ক্যাব একটি ভুল দিকে বিপজ্জনক বাঁক। ভারতের সংবিধানের চোখে সকলের সমান অধিকার স্বীকৃত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ক্যাবের পর যে এনআরসি করতে চান ‘ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’-এর আশংকা লক্ষ লক্ষ মুসলিমদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে, তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের উপর স্যাংশনের বিষয়টি মার্কিন প্রশাসনের গভীর ভাবে বিবেচনা করা উচিত।

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল: উদ্বাস্তুরা প্রতারিত হলেন

প্রসঙ্গত, ধরে নেওয়াই যায়, ট্রাম্প প্রশাসন এই প্রস্তাব মানবে না। কিন্তু এর ফলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সহ  বিজেপির শীর্ষনেতাদের আন্তর্জাতিক স্তরে যে অস্বস্তি বাড়তে পারে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ব্যাপারটা কিন্তু এখানেই থেমে নেই। নির্ধারিত ভারত সফর বাতিল করেছে বাংলাদেশের দুই মন্ত্রী। সফর বাতিল করেছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র গত শুক্রবার বলেছেন,  নাগরিকত্ব বিল পাশ হবার প্রতিক্রিয়ায় যা যা ঘটতে পারে তা তারা খতিয়ে দেখছেন। ...মানবাধিকার যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় দিল্লিকে সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। গুতেরেসের উপমুখপাত্র বলেছেন, ‘ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার দফতরের তদন্তকারী আধিকারিকদের অনেকে আইনটি নিয়ে তাদর কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে’।

মার্কিন বিদেশ দফতরের এক মুখপাত্রের মন্তব্য, বিল পাশের পর যা যা ঘটে চলেছে তার দিকে কঠোর ভাবে নজর রাখা হচ্ছে। এই সব মন্তব্য সম্পর্কে ভারতের বিদেশ দফতরের স্পষ্ট বক্তব্য, এসব অবাঞ্ছিত, অযাচিত, কারণ বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। যদিও এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে ভারত সরকার যখন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের নাম করে বলছে ওই সব দেশে সংখ্যলঘুদের উপর অত্যাচার চলছে ফলে তারা প্রায় বাধ্য হয়েই এই বিল পাশ করিয়ে আইনে পরিণত করা হয়েছে। তখন সেই সব দেশ থেকে প্রতিবাদ উঠবেই, এবং তখনও বিষয়টি যে আর  অভ্যন্তরীণ বিষয় থাকে না তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

আর এই যে বলা হচ্ছে ওই সব দেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচার চলছে, তো নরেন্দ্র মোদী তো গত ছ’বছরে অতীতের সব ক’জন প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন বিদেশ সফরে, সেই সব সফরে বিদেশে, এবং ভারতেও কখনও ওই তিন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথা হয়েছে এই বিষয়ে? সেই সব গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে নরেন্দ্র মোদি কতবার হিন্দুদের উপর অত্যাচারের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন, কী বলেছেন, ওই তিন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা তার উত্তরে কী জবাব দিয়েছিলেন, এই নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হোক। কারণ দুর্জনদের সন্দেহ, বিদেশ সফরের খরচের বহর যাই হোক,  দ্বিপাক্ষিক স্তরে বিষয়টি কখনওই তোলা হয়নি। কারণএই আইনের আসল উদ্দেশ্য ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র তৈরি দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

বর্বর গরিষ্ঠতার শক্তি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল

আমাদের দেশে খুব স্পষ্ট ভাবে এমন আইন আছে যে আইনে যে কোনও ব্যক্তি নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন। হিন্দু বা মুসলিম যে কেউ। আবেদনপত্র বিচার করে ভারত সরকার চাইলে নাগরিকত্ব দিতে পারে। এই নিয়ে সরকার একটা ধর্মনিরপেক্ষ উদ্বাস্তু নীতিও তৈরি করতে পারে। কিন্তু উদ্দেশ্য যেখানে শুধু মুসলিমদের চিহ্নিত করা, সেখানে সরকার কোনও সহজ পথে হাঁটবে কেন?

১৬শো কোটি টাকা খরচ করে অসমে এনআরসি হল। যখন দেখা গেল তাতে ১২ লক্ষ হিন্দু, তখন দরকার হল ক্যাবের। বলা হল ওই এনআরসি নাকি বাজে এনআরসি, ওটা ফেলে দিয়ে নতুন এনআরসি হবে। জনসাধারণের করের ১৬শো কোটি যারা নষ্ট করল তাদের শাস্তি হবে না? কার গাফিলতিতে এমনটা ঘটল? তদন্ত হবে না? অসমে তিন কোটি মানুষের জন্য এনআরসি করতে খরচ হল ১৬০০ কোটি। সারা দেশের জন্য তাহলে খরচ দাঁড়ায় প্রায় ৭০ হাজার কোটি। যে দেশের অর্ধেক লোক পেট ভরে খেতে পায় না, অর্থনীতি রোগগ্রস্ত মুরগির মতো ঝিমোয়, লক্ষ লক্ষ মানুষ যেখানে চাকরি খুইয়েছে নরেন্দ্র মোদি জমানায়, সেখানে এই ৭০ হাজার কোটির হিন্দুযাত্রাপালা কেন? এর উত্তর কোনও দিনই মানুষ চাইবে না এই নিশ্চিন্তভাব খুব দীর্ঘস্থায়ী না-ও হতে পারে। তখন সদুত্তর দিতে না পারলে নিষ্ঠীবন ছাড়া কিছু জুটবে না।

অনেকে একটা আশংকার কথা বলছেন। যেমন রাজনৈতিক ভাষ্যকার যোগেন্দ্র যাদব বলেছেন। তাঁর মতে আজ শুধু মুসলিমদের বাদ দেওয়া হচ্ছে, হিন্দু সহ আরও বেশ কয়েকটি ধর্মের মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলা হচ্ছে নতুন এই আইনে। কিন্তু আশংকা একদিন আসবে যেদিন হিন্দু বাদে আজ যাদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে সেই সব অহিন্দুদেরও পর্যায়ক্রমে বাদ দেওয়া হবে। প্রসঙ্গত আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে স্পেন যখন ঠিক করেছিল তাদের দেশকে এক ধর্মের দেশ করতে, তখন কিন্তু এমনই ঘটেছিল। প্রথমে মুসলিম বললেও পরে অন্য ধর্মের মানুষদেরও বহিষ্কার করা হয়েছিল। বিজেপি যে ধরনের এক ধর্মের দেশের কথা বলে, এসব অতি প্রাচীন ধারণা। এসব পরীক্ষা নিরীক্ষা ৪-৫শো বছর আগেই হয়ে গিয়েছে। তার থেকে শিক্ষা নিয়েই জন্ম হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ ধারণার।

সেই পিছিয়ে যাওয়া, বাতিল হয়ে যাওয়া দর্শন এখন মোদী সরকারের কল্যাণে আমাদের দেশের নতুন আদর্শ হিসেবে চালানো হচ্ছে, তার ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছে নতুন আইন।

একদিকে যখন অর্থাভাবে মোদী সরকার শিক্ষায় বিপুল অর্থবরাদ্দ কমাতে চলেছে, টাকা নেই বলে দেশের গর্বের সব প্রতিষ্ঠানের গায়ে ‘ফর সেল’ ট্যাগ লাগিয়ে ক্রেতার খোঁজ চলছে অন্য দিকে তখন দেশের নানা প্রান্তে আগুন জ্বলছে এই নতুন আইন নিয়ে। সরকার কি চাইছে মানুষকে মূল সমস্যা থেকে দূরে রাখতে? এ খুব বিপজ্জনক খেলা। রিং মাস্টারকে বাঘ কখনও আক্রমণ করে না, এমন নিশ্চয়তা কিন্তু কেউ দিতে পারবে না।

ঠিক কীভাবে নাগরিকত্ব ‘সংশোধন’ করবে মোদী সরকার?

ধরা যাক আইন কার্যকর করা হল। কয়েক কোটি মুসলিমকে বলা হল তোমরা বহিরাগত? তার পর? বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান আগাম জানিয়ে দিয়েছে তারা কোনও লোক নেবে না, তাদের সেশের লোকজন ভারতে বেআইনি ভাবে নেই। ভারতের পক্ষে সম্ভব নয় জোর করে কয়েক কোটি মানুষকে প্রতিবেশী কোনও দেশে ঢুকিয়ে দেওয়া। তাহলে? দু’কোটি লোককে ডিটেনশন ক্যাম্পে রেখে খরচ বহন করা? যে সরকারের শিশুদের মিডডে মিলে ৫০ পয়সা বাড়াতে ঘামে জামা ভিজে যায়, তারা বছরের পর বছর মানুষের করের টাকায় এই খরচ বহন করবে? তাহলে উদ্দেশ্য কী ? হিন্দু-মুসলমানের রাজনীতি করে ভোটে জেতা? আপাতত মনে হয় সেটাই।

সামনে পশ্চিমবঙ্গের ভোট। দেশের অর্থনীতি নিয়ে এই মুহূর্তে বিজেপির কাছে কিছু নেই যা দিয়ে ভোটে জেতা যায়। ফলে আপাতত হিন্দু-মুসলমানের রাজনীতিই বিজেপির হাতে একমাত্র অস্ত্র। তাদের কাছে ওই অস্ত্রের ধার পরীক্ষার প্রথম ল্যাবরেটারি বাঙালির এই পশ্চিমবঙ্গ। দেখার আছে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের বাংলা কোন পথ বেছে নেয়!

(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)

এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে

Bengal Line Citizenship Amendment Act
Advertisment