Advertisment

করোনার দিনগুলোয় বাস্তবায়িত হোক নিম্নবিত্তের সুরক্ষা 

পুরনো কিছু প্রকল্পকে খুচরো মোড়কে পুরে কৃষক পরিবারকে এককালীন হাজার দুয়েক টাকা, পাঁচ কেজি চাল আর এক কেজি ডাল ধরিয়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার হাত ঝেড়ে ফেললে চলবে না।   

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
coronavirus india migrant labourers

সোজা বাংলায়, এখন সাম্যবাদী একটি ব্যবস্থার সৃষ্টি না করতে পারলে গোটা প্রক্রিয়াটাই ঘেঁটে যাবে। ছবি: বিশাল শ্রীবাস্তব, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

পরিযায়ী শ্রমিক পথ হাঁটছেন গুজরাট থেকে রাজস্থানের দিকে, যাত্রা শুরু ২৪ মার্চ। দিদির কোলে ভাই, পেছনে বস্তা মাথায় বাবা-মা। একেবারে সংবাদমাধ্যমের লোভনীয় ছবি, যা কিনা মধ্যবিত্ত পাঠক-পাঠিকার মননে দাগ কাটে খুব সহজে। অন্য আর একটি ছবিতে বাবার কোলে আর কাঁধে দুই কচি ছেলে। হাতে মুঠোফোন, পায়ে চটি নেই। করোনার দিনগুলিতে তিন সপ্তাহের লকডাউন। মানুষ কিন্তু পথ হাঁটছেন। ছাত্র ফেডারেশনের দেওয়া হেল্পলাইনে ফোন করলে কলকাতার অসহায় মানুষ এক-আধজন বাঁচতে পারেন, কিন্তু ছবির এই মানুষগুলোকে সাহায্য করা তাদের আওতার বাইরে।

Advertisment

কোনোক্রমে ট্রেনে চেপে যাঁরা উন্নয়নশীল পশ্চিম ভারত থেকে পূর্বের পশ্চিমবঙ্গে ফিরেছেন, তাঁদের ভাগ্যে অন্তত জুটেছে গাদাগাদি করে ওঠার মতো বাস। কোনোক্রমে গ্রামে পৌঁছনো গেছে। দেশের পশ্চিম থেকে পশ্চিমের উন্নয়ন-বৈষম্য আরও ভয়ঙ্কর। সেখানে পায়ে হাঁটতে হয়। গুজরাট পুলিশ বোঝাতে চেষ্টা করেছে যে পায়ে হাঁটা নাকি মোদী সাহেবের লকডাউন ঘোষণার পরিপন্থী। কিন্তু এই মানুষগুলো থাকবে কোথায়? ভাগিয়ে দিয়েছে কারখানার মালিক, ঘর ছাড়তে বলেছে বাড়িওয়ালা। তাই আবার পথ হাঁটা। যদি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর শিখিয়ে দেওয়া সঠিক সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এই মানুষগুলো পথ হাঁটতে পারে, তাহলে অন্তত করোনা সংক্রমণে মরার ভয় নেই। বড়জোর পাঁচশো কিলোমিটার বা তার কিছুটা বেশি পাড়ি দিতে হাঁটুতে টান ধরবে, ফোস্কা পড়বে পায়ের চেটোয়। আর না খেতে পেয়ে কিংবা অন্যান্য রোগে মরা? সে তো আগেও ছিল।

আরও পড়ুন: দুটি ট্রাকে আত্মগোপনকারী ৩০০ অভিবাসী, শতাধিক মানুষ রেলের র‍্যাকে

coronavirus india migrant labourers দিল্লি থেকে ঘরমুখো পরিযায়ী শ্রমিক পরিবার। ছবি: গজেন্দ্র যাদব, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

আহমেদাবাদের এক কংগ্রেস নেতার ভীষণ প্রাণ কেঁদেছে। কিন্তু সেখানে তো তাঁরা সরকারে নেই। তাই রাজস্থানের কংগ্রেস সরকারকে অনুরোধ করেছেন যে গুজরাট-রাজস্থানের সীমানায় এই মানুষগুলোর জন্যে বাস পাঠাতে। যাতে হাঁটার দৈর্ঘ্য দু-একশো কিলোমিটার কমে। তবে বিজেপি এই বাজারেও সরকার ওলটাচ্ছে। তাই এই মানুষগুলো পায়ে হেঁটে রাজস্থানে পৌঁছনোর মধ্যেই হয়ত মধ্যপ্রদেশের ঢঙে সরকারে এসে যাবে বিজেপি।

দেশের পশ্চিমভাগে অসহায় অসংখ্য মানুষের লং মার্চ চলছে এই মার্চে, বিধায়ক কেনাবেচার সঙ্গেই। আপাতত লক্ষ্য রতনপুর বর্ডার, শামলাজি শহর, জেলা আরাবল্লী। গুজরাট পেরিয়ে রাজস্থানের ফেলে আসা ঘরে পৌঁছতে হবে তো। দিল্লিও খুব আলাদা নয়। সেখানেও চলছে পরিযায়ী শ্রমিকদের একশো মাইল পথ হাঁটার গান। এগুলো উদাহরণ মাত্র। আমাদের গোটা দেশ থেকে সারা পৃথিবী, এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে অনেক চড়াই উৎরাতে হবে নিম্নবিত্তদের।

আরও পড়ুন: খাবার শেষ, হাতে টাকাও নেই, চরম দুর্দশায় ভিন রাজ্যে বাংলার শ্রমিকরা

এর মধ্যেই ঘরে বসে ভাইরাস নিয়ে আমাদের অনেকটা শেখা হয়ে গেছে। জনগণতন্ত্রী চিন থেকে কল্যাণকামী ইউরোপ ঘুরে কোভিড-১৯ এখন পুঁজিপতি মার্কিন দেশে। সেখান থেকে আলগা করে লম্বা হাত বাড়িয়েছে ভারতের দিকেও। সাবধানী ভারত বেশ তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়েছে লকডাউনের। বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির ফানুসের লেজে আগুন লেগেছে, ধোঁয়া বেরোচ্ছে গলগল। জল ঢালতে লক্ষ কোটি ডলারের গল্প। কোনোটা বিলিয়ন, কোনোটা ট্রিলিয়ন, কোথাও ডলার, কোথাও ইউরো। আমাদের এক লক্ষ সত্তর হাজার কোটি আইএনআর-ও আছে। গরীবের দেশ হলেও লক্ষ কোটির গল্প বলতে তো আর পয়সা লাগে না।

তবে দুষ্টু লোকেরা প্রশ্ন তুলবেই। তাই বারবার প্রশ্ন আসবে যে অর্থনীতি বাঁচাতে এত যে টাকার গল্প, তা সমাজের প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছবে কী করে? কাজ কি কিছুই হচ্ছে না? কিছুটা হচ্ছে অবশ্যই। এই ধরণের ভাবনায় বামপন্থীরা যে ভারতের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকবেন, তা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই। আর সেই কারণেই মমতা ব্যানার্জী বা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের অনেক আগেই কেরালায় এই ধরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন সিপিএম-এর মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। দেশ এবং রাজ্যের সংবাদমাধ্যমকে সরকারি বিজ্ঞাপনের টাকা নিতে হয়। ফলে বিজয়নের পদক্ষেপ চটজলদি দিল্লি বা কলকাতায় না পৌঁছনোটাই স্বাভাবিক।

তবে কিছুটা স্বস্তির কথা এই যে বিজয়নের পথ ধরেই মমতা ব্যানার্জী থেকে অরবিন্দ কেজরিওয়াল বেশ কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শুরুতেই কুড়ি হাজার কোটি টাকার ত্রাণ সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভেবেছেন বিজয়ন। কিন্তু তাঁর এবং বামপন্থী দলগুলোর কাছ থেকে আরও বেশি আশা করবেন সাধারণ মানুষ। এই মুহূর্তে কেন্দ্রের কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে হবে দেশের প্রতিটি পরিবারকে সামনের এক বছর মাসে অন্তত পাঁচ হাজার টাকা আর বিনা পয়সায় চাল, ডাল, আলু সরবরাহ করার দাবি। ভোটে না জিতুন, বামপন্থীরা আজও পারেন গণআন্দোলনকে সঠিক পথে চালনা করতে।

publive-image গাজিয়াবাদে শনিবার ঘরে ফেরার হুড়োহুড়ি। ছবি: গজেন্দ্র যাদব, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

অঙ্ক কষলে খুব সহজেই দেখা যাবে যে ২৬ মার্চ দুপুরে নির্মলা সীতারমণ (ইংরিজি) আর অনুরাগ ঠাকুর (হিন্দি) দুটি ভাষায় যে এক লক্ষ সত্তর হাজার কোটির ঘোষণা করলেন তা অত্যন্ত কম বরাদ্দ। ত্রিশ কোটি পরিবারের কাছে মাসে পাঁচ হাজার টাকা মানে দেড় লক্ষ কোটি, অর্থাৎ বছরে আঠারো লক্ষ কোটি টাকা। আমাদের দেশের জিডিপি এখন ২২৫ লক্ষ কোটি টাকার মত (তিন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি)। অর্থাৎ তার দশ শতাংশেরও কম এই আঠারো লক্ষ কোটি। আর একটি পরিবারের চাল, ডাল, আলু যোগাতে যদি আবার সেই পরিমাণ টাকাই লাগে, তাহলেও মোট জিডিপির কুড়ি শতাংশতে এক বছর বলে বলে সামলানো যাবে। আর এই টাকা তো আর বিজয় বা নীরবের হাত ধরে জলে যাবে না। বরং আমজনতার হাত ঘুরে চাঙ্গা করবে দেশের অর্থনীতিকে।

ভারতে এক শতাংশ লোকের হাতে সত্তর শতাংশের বেশি সম্পদ। ফলে জিডিপির কুড়ি শতাংশ যদি সরকার টাকা ছাপার মত মোটা দাগের সিদ্ধান্ত নিয়েও জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়, তাহলেও বড়লোকদের খুব ক্ষতি হবে না। মার্কিন দেশ ঘোষণা করেছে দুই ট্রিলিয়ন ডলারের সহায়তা, যা নাকি আনুমানিক দেড়শো লক্ষ কোটি টাকা। জার্মানির ঘোষণা প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ কোটি ভারতীয় মুদ্রার সমান। সেসব দেশে কিন্তু ভারতের থেকে জনসংখ্যা অনেক কম। তাই ভারতেরও নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। পুরনো কিছু প্রকল্পকে খুচরো মোড়কে পুরে কৃষক পরিবারকে এককালীন হাজার দুয়েক টাকা, পাঁচ কেজি চাল আর এক কেজি ডাল ধরিয়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার হাত ঝেড়ে ফেললে চলবে না।

আরও পড়ুন: হেঁশেল খুলুন, বিজেপি কর্মীদের নির্দেশ সভাপতি নাড্ডার

মূল বিষয়টা একেবারে পরিষ্কার। করোনার বাজারে লোককে গাদাগাদি করে পথে নামতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু অত্যাবশ্যকীয় সমস্ত ব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে। এভাবেই চালাতে হবে আপাতত হপ্তাকয়েক। নিম্নবিত্ত ভবঘুরের পেছনে পুলিশের চেলাকাঠের বাড়ি, কিংবা বিলেতফেরত দায়িত্বজ্ঞানহীন অভিজাতদের নিয়ে তীক্ষ্ণ সমালোচনা - এগুলো উদাহরণ মাত্র। সমাজবিজ্ঞানে ছোটখাটো ব্যতিক্রম থাকবেই। তবে সাধারণভাবে আমজনতা ঘরে থাকা এবং সামাজিক দূরত্বের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন। তাহলে এখন বাকি থাকল সকলের ঘরে খাবার পৌঁছনোর কাজ।

বুঝতে হবে, যে দ্রুততায় রোগ ছড়ায়, সেই গতিতেই বন্টন করতে হবে খাদ্যসামগ্রী। এই জায়গাটাতে ধনীদের চুঁইয়ে পড়া সম্পদে গরীবের দিন আনা দিন খাওয়ার গল্প শেষ। কারণ সংক্রমণের দিনগুলিতে উদ্দাম রাত্রিবাসরে ধনী পুত্রকন্যাদের মনোরঞ্জনের সুযোগ একেবারেই নেই। সেখান থেকে তাই হোটেলকর্মী পরের দিন সকালের পুঁজি কুড়িয়ে থলিতে সবজি ভরে বাড়ি ফিরবেন, সে সুযোগ বন্ধ। অর্থাৎ সোজা বাংলায় এখন সাম্যবাদী একটি ব্যবস্থার সৃষ্টি না করতে পারলে গোটা প্রক্রিয়াটাই ঘেঁটে যাবে।

কিন্তু বহুদিন ধরে চলে আসা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নিজেকে করোনার দাপটে দু'সপ্তাহে সমাজতন্ত্রে বদলে নেবে, এমনটা তো হয় না। তবে দেওয়ালের লেখা বিনা চশমায় পড়া যাচ্ছে। আরও বেশি করে উঠে আসছে সর্বজনীন ন্যুনতম আয়ের কথা। শোনা যাচ্ছে ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় নাকি সব মানুষকে ভাগ করে দেওয়া হবে ট্রিলিয়ন পাউন্ড কিংবা ডলার। অর্থাৎ পুরোটাই বড় ব্যবসায়ীদের সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে ধারের নামে মায়াজগতে পাড়ি দেবে না। ভারতবর্ষে এই জায়গাটা ঠিক কত তাড়াতাড়ি রূপায়িত হয়, সেটা বুঝতে হবে।

coronavirus india migrant labourers দিল্লি-ইউপি গেটে বাসের আশায় অপেক্ষমান শয়ে শয়ে পরিযায়ী শ্রমিক। ছবি: প্রবীণ খান্না, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

বন্ধুত্বপূর্ণ পুঁজিবাদে বিজেপি বা কংগ্রেসের একটা দায় থাকে বৃহৎ পুঁজিপতিদের লক্ষ কোটি টাকা জোগান দেওয়ার। সেখানেও একটা যুক্তি আছে। পুঁজিপতিদের কোম্পানিতেও তো মধ্যবিত্ত মানুষ কাজ করেন, ফলে তাঁরা যদি লক্ষ কোটি টাকা সরাতে না পারেন, তাহলে নিজেরটা গুছিয়ে বাকি কর্মীদের মাইনে দেবেন কী করে? তবে বিষয়টা এখন আর অত সহজ থাকবে না। পুঁজিপতিদের হাত ঘুরিয়ে নয়, সরকারকে এবার মানুষের কাছে টাকা পৌঁছে দিতে হবে একেবারে হাতে হাতে। এককালীন নয়, এক মাসের জন্যেও নয়। দেশ বাঁচাতে গেলে বিষয়টা চালু রাখতে হবে অন্তত এক বছর।

বিভিন্ন বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার ওপরের দিকের কর্মচারিদের বেতন কমার খবর আসছে। এমন দিন এলে আমাদের দেশে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারিদের বেতন কমানোর কথাও হয়ত ভাবতে হবে সরকারকে। রেপো বা রিভার্স রেপো রেটের জটিল গল্প বাজারে ছেড়ে গুলিয়ে দেওয়া যাবে, কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হবে বলে মনে হয় না। মূল প্রশ্ন হলো বিজেপি, কংগ্রেস বা দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল গরীব মানুষের বাঁচার বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত কিনা। দিনমজুরি ১৮২ থেকে ২০২ টাকা আর্থিক বছরের শুরুতে সাধারণ নিয়মেই বাড়ার কথা। তাই এই নিয়ে বিজেপির বুক বাজানোর কোন কারণ নেই। সকলেই জানেন যে কেন্দ্রের শাসক দলের সঙ্গেও বেশ কিছু চিন্তাশীল মানুষ যুক্ত। তাঁরা এই পরিস্থিতিতে ঠিকঠাক না ভাবলে কিন্তু বিষম বিপদ, কারণ আশি কোটি নিম্নবিত্ত মানুষের হইচই চেপে রাখা এই আকালে কঠিন হবে। আসলে ভাইরাসটা চিনে তো, তাই বিশ্বজুড়ে বোধহয় এবার কম্যুনিজম লাগু করেই ছাড়বে!

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

Anyo Paksha coronavirus
Advertisment