ছোটবেলায় 'বিজ্ঞান - আশীর্বাদ না অভিশাপ', এই রচনা লেখেন নি, এমন বাঙালি হাতে গোনা। বিজ্ঞান রচনায় সাধারণভাবে শুরুতে আশীর্বাদ বেশি লেখা হয়, তারপর শেষের দিকে একটি অনুচ্ছেদ থাকে অভিশাপের। করোনার ভালোমন্দে আপাতত মন্দ বেশি, তবে মঙ্গলও কিছু জুটছে।
করোনা বা COVID-19 চিনের গবেষণাগারের বিজ্ঞানসম্মত আবিষ্কার, নাকি জীবাণুদের বিবর্তনের ফসল, সেই নিয়ে আলোচনা চলবে বহুদিন ধরে। আতঙ্কমারীর অভিশাপ নিয়ে বেশি আলোচনা বাড়িয়ে লাভ নেই। ট্রাম্প সাহেব যখন ভাইরাসকে চিন দেশের নাগরিকত্ব দেন, তখন চটজলদি বোঝা মুশকিল যে শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে কী ধরণের বাণিজ্যিক এবং অন্তরাষ্ট্রীয় আদানপ্রদান ঘটছে। চিনে জন্মালো ভাইরাস, নাকি কানাডার গবেষণাগার থেকে চিনে গুপ্তচর ব্যাপারটা কাচের শিশিতে করে উহানে এনে বোতল ফাটাল, এ নিয়ে সঠিক খবর কোনোদিনই জানা যাবে না।
আরও পড়ুন: করোনা সতর্কতা জারি করা মৃত চিকিৎসকের পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইল চিন
তবে বিভিন্ন দেশের শেয়ার বাজার ধ্বসে পড়ল, আর সেই ফাঁকে চিনে বিনিয়োগকারী কম পয়সায় প্রচুর শেয়ার বাগিয়ে বিশ্ববাজারের মালিকানা পেল, এমন হলে অবশ্যই করোনা এক পক্ষে আশীর্বাদ। মার্কিনিরা যদি ব্যবসাটায় যুক্ত থাকে, তাহলে তাদেরও লভ্যাংশ জুটবে। সাধারণভাবে ভাইরাস হানাদারির পর অন্তত বছরখানেক সময় লাগে তার টিকা বানাতে। ট্রাম্প সাহেবের গবেষকরা যেভাবে সেই টিকা এর মধ্যেই আবিষ্কার করে লোকজনকে ছুঁচ ফোটাতে শুরু করেছেন, তাতে তাঁর কাছে আগে খবর ছিল, এমন সন্দেহ আমজনতা করবেই। অন্তর্জালের বাজারে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব লোকে খায় ভালো। সেই অঙ্কে চিন আর আমেরিকার মধ্যে কে কতটা লাভ করল তার ওপরই আশীর্বাদ আর অভিশাপের মূল হিসেব নির্ধারিত হবে।
আমেরিকার পাশে তুলনায় বেশ শান্তিপূর্ণ দেশ ক্যানাডা। কিন্তু রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাসে তারাও ফেঁসে গেছে। যতই ক্যানাডার গবেষণাগার আর চিনা গুপ্তচরের গল্প ছড়াক না কেন, জীবাণু ব্যবসা করে মুনাফা লোটার মতো উৎসাহ তাদের খুব আছে বলে মনে হয় না। আপাতত করোনার ভয়ে সেদেশের সঙ্গে মার্কিনিদের সীমানা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে বহু জায়গায়। এই জায়গায় ট্রাম্প সাহেবের প্রতিবেশীরা বেঁচে যেতেও পারেন।
আরও পড়ুন: করোনা-আক্রান্ত দেশগুলির মধ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবার নিরিখে ভারত কোথায় দাঁড়িয়ে?
ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্র্যুডোর বয়েস কম। তাঁর স্ত্রী সম্ভাব্য করোনা সংক্রমণ থেকে সম্ভবত সুস্থও হয়ে উঠেছেন। নিজের সংসার সামলালেও, ট্রাম্পের মতো একাধিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং একটা গোটা দেশ সামলে নেবেন, এতটা আত্মবিশ্বাস তাঁর নেই। তাই বেশ ভয়ে ভয়েই তিনি জানিয়েছেন যে, এমনও হতে পারে যে কয়েকমাস সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করে ঘরে অন্তরীণ হয়ে থাকতে হবে বহু মানুষকে। এরকমটা হলে ভীষণ বিপদ, সেকথা তিনি বুঝেছেন।
অর্থনীতির সাড়ে সর্বনাশ যে জনগণের ঘাড়ে কতটা ধাক্কা দেবে সে অনুমানে অভ্রান্ত দিকনির্দেশ করা শক্ত। তবে বুঝতে একেবারেই অসুবিধে হয় না যে মোটের ওপর সবথেকে ক্ষতি হবে ইউরোপের। এখানকার অনেকগুলো দেশ গণতন্ত্রের পীঠস্থান। মানবাধিকারের তালিকায় একেবারে ওপরের দিকে। এই দেশগুলো আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তাই যথেষ্ট বেশি, আর ঠিক তাই হচ্ছে।
মানবাধিকারের সঙ্গে অধিক করোনা সংক্রমণের সম্পর্ক কী? অগ্রণী গণতন্ত্রে অত্যন্ত কঠিন পদক্ষেপ খুব সহজে নেওয়া যায় না। ফলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত চটজলদি আটকে দিলাম, নিজের দেশের মানুষকে বাজারহাটে বেরোতে দিলাম না, এই ধরণের সিদ্ধান্ত লাগু করা বেশ শক্ত। অবশ্য বাস্তবে যদি রসদ কমে যায়, সেক্ষেত্রে কিছু অমানবিক সিদ্ধান্ত আপনা থেকেই লাগু হয়। যেমন ইতালিতে এখন সংক্রমিতের সংখ্যা এতো বেশি যে রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগটাই দেওয়া যাচ্ছে না। তবে এখানেও কি আশীর্বাদ নেই? ভেনিসের নালায় নাকি জলযানের চলাফেরা এতো কমে গেছে যে যেখানে সেখানে ডলফিন ঘুরে বেড়াচ্ছে। পরিবেশপ্রেমীরা আহ্লাদে আটখানা।
আরও পড়ুন: করোনা আতঙ্ক: বিরোধীদের আর্থিক প্যাকেজের দাবি খারিজ মোদী সরকারের
আগের অনুচ্ছেদেই লিখেছি, মানবাধিকার সূচক ঊর্ধ্বমুখী থাকলে সংক্রমণ বাড়ে। যুক্তিবাদীরা ক্যাঁক করে চেপে ধরবেন। চিনে কি গণতন্ত্র আছে? তাহলে চিনেই বা করোনা ছড়ালো কী করে? এর উত্তর, চিনে তো অন্য কোনও দেশ থেকে জীবাণু উড়োজাহাজে চড়ে অভিবাসন দপ্তর অতিক্রম করে পৌঁছতে পারে নি। হয় চিন নিজের থেকে ছড়িয়েছে, নয়তো চিন সত্যিই ছড়িয়েছে। শুরু দিকে সে দেশের চিকিৎসকেরা যখন তাঁদের সরকারকে বারবার সাবধান করছিলেন, তখন সম্ভবত তা চিনের চেয়ারম্যানের কানে পৌঁছয় নি। আর সত্যি যে চিনে কী হয়েছে আর কী হচ্ছে, তা জানার উপায় খুব কম।
আজকের দিনে মানবতাবাদী চিন নাকি ইউরোপে বিশেষজ্ঞ পাঠাচ্ছে চিকিৎসায় সাহায্য করার জন্যে। বামপন্থীরা আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলছেন, উহান প্রদেশে অসুস্থ মানুষদের বাড়ি বাড়ি নাকি খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল কম্যুনিস্ট সরকার।
কিন্তু সে খবরের সত্যতা মেনে নিতে গেলে চিনে যে অসুস্থদের গুলি করে মারা হচ্ছে, সে ধরনের খবরকেই বা মিথ্যে বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় কী করে? যে দেশে মানবাধিকার বারবার লঙ্ঘিত, যে দেশ কড়া হাতে যে কোনও সমস্যার সমাধানে পটু, যে দেশে অন্তর্জালের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা, সেই দেশ তো পলিটব্যুরোয় সিদ্ধান্ত নিয়ে শুরুর দিকে ভাইরাসকে ধমকে দিলেই পারত। ধরে নেওয়া যাক, উদ্ভট প্রাণীর মাংস বিক্রির বাজার থেকে আপনিই ছড়িয়েছে এই ভাইরাস। সেক্ষেত্রে জানুয়ারির ২৫ তারিখে ইঁদুরের যে চৈনিক বছর শুরু হলো, সেখানে বাইবুটিং অঞ্চলে কিভাবে উৎসব উদযাপনের অনুমতি পেলেন চল্লিশ হাজার মানুষ?
আরও পড়ুন: করোনাভাইরাস: ব্যক্তি স্বাধীনতা ও জনস্বাস্থ্য
প্রশ্ন উঠবেই যে কোন খবরটা ঠিক আর কোন খবরটা ভুল। কিন্তু একথা তো সকলেই জানেন যে চিন বা উত্তর কোরিয়ায় কী ঘটছে, সে খবরের সত্যতা যাচাই প্রায় অসম্ভব। তাই দু'পক্ষের কথাতেই ভালমন্দের মতই সত্য-মিথ্যে মিশে থাকবে। তবে চিনের মুক্তি সেনাদল ইউরোপে সাহায্য করতে গিয়ে হাততালি পেলে নিজেদের দেশে করোনার উৎপাত শুরু করার প্রেক্ষিতে বাঁকা কথাও ঝরে পড়বে যথেষ্ট।
সবশেষে আমাদের দেশের কথায় আসতে হবে। গণতন্ত্রের সূচকে মোদী সরকার দেশকে খুব এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এমনটা নয়। তবু আমরা যে চিনের থেকে অনেকটা বেশি খোলা হাওয়ায় বাস করি, একথা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। রাজ্যে তৃণমূল কিংবা কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের প্রশংসা না করলে সংবাদমাধ্যমে সরকারি বিজ্ঞাপন পেতে অসুবিধে হয়, এই অভিযোগ আছেই। সরকারের তীব্র বিরোধিতা করলে ধমক খাওয়া থেকে কারাবাসের উদাহরণ আমাদের দেশেও মিলবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও একথা একেবারে সত্যি যে সরকারের বিরুদ্ধে চেঁচানোর অনেকটা জায়গা আমাদের গণতন্ত্রে এখনও জারি আছে।
আরও পড়ুন: COVID-19: ভাইরাস ও মানুষ
তাই রাজ্য সরকারের আমলা করোনা ছড়ানোর অংশীদারি নিলে মুখ্যমন্ত্রীকে গণমাধ্যমের সামনে হুঁশিয়ারি দিতে হয়। কেন্দ্রের স্নেহধন্য রাজনৈতিক দলের নেতারা গোচোনা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে গণমাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়ে, চুপ করে বসে থাকা ছাড়া হিন্দু চিন্তনদলের বেশি কিছু করার থাকে না। আর সবথেকে আশার কথা, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী করোনা সামলানোর জন্যে প্রচুর সময় দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। মমতা ব্যানার্জীর বক্তব্যে সহমর্মিতার আভাস মিলছে বারবার। নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতায় উঠে আসছে সমাজের প্রান্তিক মানুষের কথা। করোনার থাবায় তাঁদের কাজে আসতে অসুবিধে হলে যেন মাইনে কাটা না হয়, সেই বার্তা দিচ্ছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। দেশের নেতানেত্রীরা সংবেদনশীল হলে জনগণের মঙ্গল, আর সেখানে বিষয়টিকে অবশ্যই করোনার আশীর্বাদের অনুচ্ছেদে জুড়তে হবে।
এখন প্রশ্ন উঠবে, দেশজোড়া এই সতর্কতা আর কয়েকদিন আগে নেওয়া উচিৎ ছিল কিনা। সে উত্তর পেতে অপেক্ষা আগামী দু-এক সপ্তাহের। ২০ মার্চ ভোরবেলা পর্যন্ত এদেশে করোনায় মৃত্যু চারজনের, ফাঁসিতেও চার। এটাই বিশ-বিশের হিসেব। আপাতত রবির বিকেলে চা খাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশমতো হাততালি আর ঘণ্টা দোলানোর অপেক্ষা।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)