Advertisment

করোনা খুলে দিক শিক্ষা পদ্ধতির নতুন অভিমুখ

পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে নতুন এক পদ্ধতি আয়ত্ত করতে হচ্ছে। এই সময় পরিবারের সমর্থনটা অত্যন্ত জরুরি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
coronavirus online classes

চলতি বছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার প্রথম দিনে। ছবি: পার্থ পাল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

আজ সকালেই পরিচিত এক কিশোরী ফোন করেছিল। মেয়েটি পরের বছর মাধ্যমিক দেবে। দেখলাম, খুবই হতাশ ও চিন্তিত সে। কেন? স্কুল বন্ধ হলেও অনলাইনে বা টিভির পর্দায় তো ক্লাস চলছে। মানে কিছুটা হলেও তো একটা বিকল্প ব্যবস্থা হয়েছে। সেটা কি তাহলে যথেষ্ট নয়?

Advertisment

বিষয়টা নিঃসন্দেহে আলোচনা সাপেক্ষ। তবে, তার আগে কয়েকটা কথা উল্লেখ করা জরুরি। এক, কোভিড ১৯-এর সংক্রমণ আটকাতে লকডাউন ছাড়া এই মুহূর্তে কোনও বিকল্প নেই, সে স্কুল-কলেজ বন্ধ করতে হলেও। পাশাপাশি লেখাপড়ার বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যে পদ্ধতি আপাতত অনুসরণ করা হচ্ছে, তা নিয়েও কোনও নেতিবাচক ইঙ্গিত করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। যেটা বলার, সেটা হলো, পড়ুয়ারা কিভাবে দেখছে বিষয়টা।

তার আগে একটু ফিরে দেখা। সেটা সাতের দশক। রাজনৈতিক দিক থেকে দারুণ সংকটে এই রাজ্য। কলকাতায় তখন গন্ডগোল লেগেই আছে। আমাদের পড়াশোনার ওপরও প্রভাব পড়ছে তার। মাঝেমাঝেই স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে অর্ধেক পথ থেকে ফিরে আসতে হতো। কোনও না কোনও ঘটনায় বন্ধ হয়ে গেছে স্কুল বা রাস্তার মোড়ে কারও লাশ পড়ে আছে, ফলে পুলিশের ব্যারিকেড। সেই সময় ইন্টারনেট দূর, সবার তো টেলিফোনই ছিল না। সেলফোনই নেই তো স্মার্টফোন! টিভিও আসেনি ঘরে ঘরে। সব মিলিয়ে আমাদের পোয়া বারো। স্কুলের শাসন কিছুটা শিথিল, আমরা ফাঁকিবাজরা মহানন্দে তাকেই অজুহাত করে দেদার ফাঁকি দিয়ে সময়টা পার করে দিচ্ছি। সেই সময়টা ঘিরে অনেকেরই লেখাপড়ায় যথেষ্ট ক্ষতি হয় নিঃসন্দেহে।

আরও পড়ুন: একাদশের সকল পড়ুয়া পাশ, উচ্চমাধ্য়মিকের বাকি পরীক্ষা জুনে, ঘোষণা মমতার

২০২০-র শুরু। নতুন বছর। নতুন উদ্দীপনা। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কেউ নতুন ক্লাসে উঠেছে। কেউ স্কুলশেষের দোরগোড়ায়। কেউ কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসবে। সব মিলিয়ে এটাই তো স্বপ্নগুলোকে নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়ার সময়। কিন্তু যেমন ভাবা, তেমনটা হলো না। বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো ভাইরাসের সংক্রমণ। এক ধাক্কায় ওলটপালট হয়ে গেল গোটা দুনিয়ার চিত্র। মানুষের জীবন বাঁচাতে, সংক্রমণ ঠেকাতে ঘোষিত হলো লকডাউন। আর সব কিছুর সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল স্কুল-কলেজ। কিন্তু বন্ধ হলেও থেমে থাকল না শিক্ষার রথের চাকা। সত্তরের দশকে যে সুবিধা আমরা পাইনি, তা পেয়েছে একাল। আধুনিক প্রযুক্তির আশীর্বাদ। এটা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক প্রাপ্তি। প্রশ্ন হলো, এই প্রাপ্তি কতটা জনমুখী? সত্যি কতটা ফলদায়ক?

জবাব খুঁজতে আরও কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বললাম। সে এক বিচিত্র ও জটিল অবস্থা। মূলত স্কুল স্তরেই কথা বলা। সমস্যাটা ওদেরই বেশি। কথা বলে যা বুঝলাম, এই মুহূর্তে ওরা যেন ঘোরের মধ্যে আছে। যেন কঠিন এক ধাক্কা। স্বাভাবিক, আমরা বড়রাই খাপ খাওয়াতে হিমশিম খাচ্ছি। ওদের কথা একবার ভাবুন। লেখাপড়ার চেনা পরিবেশ, পরিচিত লোকজন, শিক্ষক থেকে বন্ধুবান্ধব, কোনওটাই কাছে নেই। কোনও ভাবেই আদানপ্রদানের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। কবে পাওয়া যাবে, তাও অজানা।

কেউ উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছে, একটা পরীক্ষা বাকি, সেটা কবে হবে জানা নেই। যারা পরের বছর দেবে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক, তারাও যথেষ্ট চিন্তায়। একটু নিচু ক্লাসে পরীক্ষা না দিয়েই সরকারি সিদ্ধান্তে পরের ক্লাসে উন্নীত (এ ছাড়া উপায়ও ছিল না)। অনেকেরই মনে প্রশ্ন, এতে কি সকলে যোগ্য বিচার পেল? আচ্ছা ক্লাসে তো উঠলাম। কিন্তু নতুন ক্লাসের বই তো পেলাম না। তাহলে কী করে শুরু করব? মোদ্দা কথা, মোটেই শান্তিতে নেই বেচারারা।

আরও পড়ুন: বাংলার বেসরকারি স্কুলে বেতন বৃদ্ধি করা যাবে না: পার্থ চট্টোপাধ্যায়

পরীক্ষা ছেড়ে এবার পড়ার পদ্ধতিতে আসি। বিদ্যা গুরুমুখী, এটা হলো চিরন্তন ভাবনা। গুরুগৃহ, পাঠশালা থেকে স্কুল-কলেজে গুরু বা শিক্ষকের কাছে পাঠগ্রহণই  শিক্ষার প্রচলিত প্রথা। সেই প্রথা ভাঙতে হয়েছে আজকের লকডাউন প্রেক্ষিতে। স্কুলের শিক্ষক বা প্রাইভেট টিউটর, সকলেই ভার্চুয়াল মাধ্যমে পড়াচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের। সত্যি একটা সৎ প্রচেষ্টা চলছে, যাতে ওদের লেখাপড়ার গতিটা অব্যাহত থাকে। পাশাপাশি টিভিতেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বসে এক-একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। ছাত্ররা সরাসরি ফোন করে তাদের সমস্যা বা প্রশ্ন জানিয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে উত্তর পাচ্ছে। এটা খুবই ইতিবাচক।

তাহলে অসুবিধাটা কোথায়? অসুবিধা আত্মস্থ করায়। প্রথমত, সকলের মেধা সমান নয়। সেক্ষেত্রে মেধার সঙ্গে আগ্রহ, সঙ্গে পড়াশোনার গুরুত্ব বোঝা - এই সবকিছুর সমন্বয় ঘটিয়ে প্রয়োজনীয় মাত্রায় বিষয়কে আয়ত্তে আনার পরিণতমনস্কতা সবার থাকে না। যাদের আছে, তারা যে কোনও অবস্থাতেই শেখার জায়গাটা পোক্ত করে নেবে। যাদের নেই, সমস্যাটা তাদের। এক্ষেত্রে বিফল মনোরথ হলে, হিতে বিপরীত হতে পারে। অনেকেই আছে যারা যথেষ্ট মেধাবী, কিন্তু লাজুক বা অন্তর্মুখী, তাদের পক্ষে অচেনা পরিবেশ বা মানুষের (পড়ুন টিভিতে যে শিক্ষক বসে পড়াচ্ছেন) সঙ্গে সংযোগ স্থাপনটাই তো অত্যন্ত শক্ত। এদের পক্ষে একমাত্র স্কুলের শিক্ষকরাই হয়ে উঠতে পারেন প্রকৃত পথপ্রদর্শক। বলতে চাই, এই লকডাউন প্রেক্ষিতে সাহায্যের হাতটা আরও একটু বেশি প্রসারিত করতে হবে শিক্ষকদের। ওঁরা সেই চেষ্টাটা করছেনও নিশ্চয়ই।

তবে, সেখানেও সমস্যা আছে। কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বললাম। তাঁদের বক্তব্য, "লকডাউনের কারণেই ছাত্রছাত্রীরা নতুন ক্লাসে ওঠার পর বই পায়নি। বইয়ের (স্পেসিমেন কপি) এক-একটি পাতার ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপ করছি। তারপর কিছু নোট লিখে পাঠাচ্ছি। ওরা পড়ছে, কিন্তু বুঝছে কিনা সেটা পরিষ্কার নয়। ভিডিও করে পাঠিয়েও দেখেছি। সবাই শুনে সেটা অনুসরণ করতে পারছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।"

আরও পড়ুন: প্রবাসে, দৈবের বশে…করোনার পূর্ণগ্রাসে

সারাক্ষণ কম্পিউটার বা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে অনেকেরই বাড়তি শারীরিক সমস্যা হচ্ছে। উল্টোদিকে একজন ছাত্রী জানায়, "আর সব যেমন-তেমন, অঙ্কটা এভাবে কিছুতেই বোঝা সম্ভব না।" হতে পারে এটা ওই প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে না যাওয়ার অভ্যাসের ফল। কারণ যাই হোক, তার অসুবিধাটা তো মিথ্যে নয়! বলা বাহুল্য, তার মতো অনেকেই এই সমস্যায় ভুগছে। তাহলে উপায়?

উপায়ের ক্ষেত্রে প্রথমেই বলব অভিভাবকদের কথা। তাঁরাই সবচেয়ে ভালো জানবেন, বাড়ির ছেলেটি বা মেয়েটির শক্তি ও দুর্বলতার কথা। যদি না জেনে থাকেন, জেনে নিতে হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে নতুন এক পদ্ধতি ওদের আয়ত্ত করতে হচ্ছে। এই সময় পরিবারের সমর্থনটা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষকদের বন্ধুত্বের হাত প্রসারণের কথা তো আগেই বলেছি। এর সঙ্গে শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যেকার যোগাযোগটাও নিয়মিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ছাত্রছাত্রীরা যেন তাদের সমস্যাগুলো খুলে বলতে পারে। এটা সবসময়ই জরুরি। আর এখন তো অত্যাবশ্যক। প্রয়োজনে পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে শিক্ষাবিদদের।

সবশেষে প্রযুক্তির বিষয়ে কিছু কথা। প্রচুর অ্যাপ মেলে ইন্টারনেট ঘাঁটলেই। এর মধ্যে কিছু সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক। তারা পেশাদারি ভাবেই পরিষেবা দেয়। তবে প্রশ্ন, আর্থিকভাবে সবাই সেই পরিষেবা নিতে সক্ষম কিনা। ফ্রি অ্যাপের ক্ষেত্রে আবার যাথার্থের গ্যারান্টি বিষয়ে প্রশ্ন আছে। প্রচুর ভুয়ো সংস্থা এবং অসাধু চক্র রয়েছে। শিক্ষকদের গাইডেন্স একান্ত জরুরি এক্ষেত্রে। সরকারি স্তরে যদি এই জাতীয় অ্যাপ আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তবে ছাত্রছাত্রীরা যথার্থই উপকৃত হবে। নতুন প্রজন্মের কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা এই বিষয়ে ভালো দিশা দিতে পারেন কিনা দেখা যেতে পারে।

এই প্রয়োগ শুধু লকডাউন সময়ের জন্য নয়। এর সুফল সুদূরপ্রসারী। স্মার্টফোনের যুগ। যেখানে ভালো স্কুল নেই, সেখানেও আজ হাতে হাতে স্মার্টফোন। পড়াশোনার পদ্ধতি বদলানো যদি অবশ্যম্ভাবী হয়, তবে তাকে যতদূর পারা যায় জনমুখী তো করতেই হবে। করোনার কারণে আজকের নেতিবাচক অবস্থার প্রেক্ষিতও যদি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনও ইতিবাচক অভিমুখ খুলে দেয়, তাতে মন্দ কী?

WBBSE WBCHSE coronavirus
Advertisment