একজন মানুষ প্রকাশ্যে কেশেছিলেন। তাঁকে পাঁকে ফেলে মেরে ফেলা হয়েছে। ভারতে।
এরকম ঘটনা খবর হয়ে উঠছে, এখনও। হিংসার জন্য। প্রাণঘাতী ঘটনা বলে। কোভিড-১৯ কালে অনেক রকম ঘটছে, যা ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে, খবরযোগ্য হয়ে উঠছে না। খবরে আসছে না, বিভিন্ন হাউজিং কমপ্লেক্সে, পাড়ায় হেনস্থার বিভিন্ন রকম ঘটনা। এ সব ঘটনা ঘটছে, কেউ বলবেন সচেতনতা-অসচেতনতার ফারাকের কারণে। যাঁরা হেনস্থা করছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য হেনস্থা নয়, রোগ নিয়ন্ত্রণ। একে অন্য আরেকদিক থেকেও দিক থেকেও দেখা যায়। নজরদারি। নজরদারি ব্যপারটা ভারতে এখন স্বীকৃত, আইনের সরাসরি আনুকূল্য না পেলেও। স্বীকৃত যে, গোরক্ষাবাহিনী নজরদারি চালায়, ইংরেজিতে তাদের বলে ভিজিল্যান্ট। তার যে একটা বড়সড় মান্যতাও রয়েছে, সে কথাও কেউ আর অস্বীকার করতে পারবেন না।
চিকিৎসক ও সমাজ – মহামারীর দ্বিপ্রহরে
কোভিড-১৯ পরবর্তী পৃথিবী, কোনওমতেই পূর্ববৎ থাকবে না। নানা দিক থেকেই। আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক কোনও দিক থেকেই। ঠিক কী কী ঘটতে পারে, তা নিয়ে নানাবিধ বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গিয়েছে। যা যা ঘটে গিয়েছে, যেমন এক ব্যারেল অপরিশোধিত তেল কিনলে ২১ ডলারের বেশি ক্রেতা পাচ্ছেন, এমনটা অভাবিত ছিল। ঠিক এই পরিস্থিতিটা হয়ত থাকবে না, কিন্তু এ পরিস্থিতির বিভিন্ন প্রভাব থাকবে। তার মধ্যে একটা বড় জায়গা জুড়ে থাকবে স্মৃতি। আতঙ্কের স্মৃতি। ব্যক্তিগত স্মৃতি ও গোষ্ঠীগত স্মৃতি।
কালোবাজারিদের কস্মিন কালেও ফাঁসি হয়নি, বাস্তবে। তেমন একটা রোষের কথা একবার একজন বলে ফেলেছিলেন, তা স্বাভাবিকভাবেই আর কার্যকর হয়নি। মজুতদার ও কালোবাজারিদের সম্পর্কে খারাপ খারাপ কথা দেওয়ালে এক সময়ে লেখা থাকত বটে, কিন্তু সে আর এখন দেখা যায় না। এখন, কোভিড কালে প্রায় সকলেই মজুতদার হয়েছেন, কম বেশি। প্রয়োজনাতিরিক্ত হ্যান্ড ওয়াশ, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান, ডিটারজেন্ট, টু মিনিটল নুডলস, চিপস, মায় মাস্ক অবধি বাড়িতে মজুত করে রেখেছেন মানুষ। তাঁরা কোভিড পূর্ববর্তী কালে এমন করতেন না, নিশ্চিত। কিন্তু কোভিডকালে তাঁরা এরকম করেছেন, এবং অন্যেরা যখন হা পিত্যেশ করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এসব কেনার জন্য, তাঁরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন, নিজেদের দূরদর্শিতাকে নিজেরাই সেলাম জানিয়েছেন। এঁদের মজুতদার আখ্যা দিলে, বিপ্রতীপে বলা হতে পারে, অস্বাভাবিক অবস্থার সময়ে এরকম ঘটে থাকে। স্বাভাবিকতা ফিরে এলে এঁরাও আবার পুরনো অভ্যাসে ফিরে যাবেন, প্রয়োজনাতিরিক্ত দ্রব্য কিনবেন না।
হার্ড ইমিউনিটিই কি অনিবার্যতা?
ব্যাপারটা অত সহজ হওয়ার কথা নয়। কোভিড চলে যাচ্ছে, এই চলে গেল, এরকম এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। বরং উল্টোটাই জানা। এই সংক্রমণ ফের ফিরে আসবে। মারাত্মকভাবে, এমন আশঙ্কা বিভিন্ন গবেষণাপত্রে ইতিমধ্যেই ব্যক্ত হয়েছে। এবং কোভিড ১৯ সংক্রমণের কোনও প্রতিষেধক যেহেতু এখনও মান্যতা পেতে বেশ কিছুদিন দেরি রয়েছে, যে কোনও কর্তৃপক্ষের হাতেই পেন্সিলের মত পড়ে থাকবে লকডাউন। এবং লকডাউনের সময়ে প্রয়োজনীয় দ্রব্য কী আর কী নয়, তা নিয়ে কোনও তর্ক করা যায় না, কারণ তা জরুরি পরিস্থিতি। জরুরি পরিস্থিতিতে বড়দের (অর্থাৎ কর্তৃপক্ষের) কথা মানাই বিধি। সাম্প্রতিক জরুরি পরিস্থিতিতে বড়রা জোর দিয়েছেন নজরদারি ও কঠোর অনুশাসনের উপর।
যেসব জায়গাগুলি সংক্রমণ রোধে সফল বলে গণ্য, তার মধ্যে মডেল হিসেবে উঠে এসেছে কাসারাগড়, আগ্রা ও ভিলওয়াড়ার কথা। কাসারাগড় কেরালার জেলা। কেরালা যেহেতু বহু আলোচিত, ফলে সেখানে ঠিক কী কীভাবে সাফল্য এসেছে, তার কয়েকটিতে নজর দেওয়া যাক। মনে রাখতে হবে, কেরালার সাফল্যের উৎস, সেখানকার বর্তমান কমিউনিস্ট সরকারের নয়। ত্রিবাঙ্কুরের শাসকদের পরিচালনাতেও সেখানে জনস্বাস্থ্যের উপর জোর দেওয়া হত, এবং বর্তমান সরকারে, সেখানে স্বাস্থ্যখাতে খুব বেশি বাজেট বরাদ্দ করে না। এহ বাহ্য। এবারের কাসারাগড়ে সম্পূর্ণ লকডাউন পরিস্থিতি কার্যকর হচ্ছে কিনা, তার জন্য ১৪৪ ধারা তো ছিলই, সঙ্গে ছিল ড্রোন মারফৎ নজরদারি। আগ্রা-ভিলওয়াড়াতেও কঠোর অনুশাসনই একমাত্র বিধেয় বলে মনে করা হয়েছে, যা স্বাভাবিক অর্থে নির্মম বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। আবারও সেই স্বাভাবিক।
পুঁজিবাদের কবর খুঁড়তেই যেন করোনাভাইরাসের আবির্ভাব
স্বাভাবিক পরিস্থিতি এটা নয়। নয় বলেই লকডাউন, নয় বলেই নজরদারি, নয় বলেই মজুতদারি এবং কালোবাজারি।
নিজেদের নজরদার চেহারা স্থানীয় বাসিন্দারা দেখাচ্ছেন, দেখাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন, দেখাচ্ছে রাষ্ট্র। জরুরি পরিস্থিতিতে তেমনটাই স্বাভাবিক বলে স্বীকৃতিও পাচ্ছে। কিন্তু এ নজরদারির মধ্যে অহরহ হিংস্রতা পরিদৃশ্যমান, যে নজরদারি বিভিন্ন প্রান্তিক দশাগ্রস্ত মানুষকে এমন অবস্থানে ঠেলে দিচ্ছে, যাতে তাঁরা শঙ্কিত হন, কোণঠাসা। রোগ লুকোতে বাধ্য হন। মনে রাখতে হবে, এই পরিস্থিতিটা কাম্য নয়, এইমসের ডিরেক্টর বলেছেন, স্টিগমা কতটা ক্ষতিকারক হচ্ছে।
কথাটা এই নজরদারি নিয়ে। নজরদারির অভ্যাস নিয়ে। নজরদারির স্বাভাবিকতা, স্বীকৃতি ও মান্যতা নিয়ে। নজরদারির জন্য পাড়ায় দাদাদিদিরা রয়েছেন যেমন, তেমনই রয়েছে রাষ্ট্র স্পনসর্ড অ্যাপ। অ্যাপের মাধ্যমে জানা যাবে সংক্রমণ সম্ভাবনা। শুরুতে কোভিড। এর পর সেই অ্যাপের বাড়বৃদ্ধি ঘটবে নিশ্চিত, সহরোগ গুলিও ধরা পড়বে, তার যুক্তি হিসেবে কোমর্বিডিটির কথা আসবে। হয়ত অ্যাপ ও আধার সংযুক্তিকরণ হবে, আধারের মতই অ্যাপ বাধ্যতামূলক হবে, না হলে ইনশিওরেন্সের টাকা পাওয়া যাবে না, এখন যেমন আধার না থাকলে রান্নার গ্যাসের ভরতুকি বা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা পাওয়া যায় না।
শরীরের উপর অধিকার ব্যক্তিগত। তাই বলে অন্যতে সংক্রমণ ছড়াবার অধিকার নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত নয়। কিন্তু নজরদারির যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাতে কেবলমাত্র এখনও পর্যন্ত প্রতিষেধকহীন সংক্রমণ সম্পর্কিত নজরদারিতেই বিষয়টা আটকে থাকবে, এমন কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও প্যারাসিটামল কারা কিনছেন, তার তালিকাও রাখতে বলা হয়েছে দোকানে। অর্থাৎ, নজরদার রাষ্ট্র ধরে নিচ্ছে যে মানুষ আক্রান্ত হলেও হয় তা তার অজ্ঞাত, নয়ত সে গোপন করছে। রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক এখানে সন্দেহপরায়ণতার, পারস্পরিক আস্থার নয়। আস্থা এখনও পর্যন্ত খুব ফলদায়ক হয়েছে, তেমনটা বলা যাবে না। লকডাউনের মধ্যে ক্যারম, ফুটবল, চায়ের দোকানের উদাহরণ উঠে আসবেই। উঠে আসবে বাজারে ভিড়ের কথাও। কিন্তু এ প্রসঙ্গে সচেতনতায় জোর দেবার কথা উঠছে না, এটাই আশঙ্কার।
করোনা অতিমারী: লক ডাউনের উদ্দেশ্য, প্রাপ্তি এবং উত্তরণের পথ
সত্যিটা হল, যাঁরা সচেতন হতে বলবেন, তাঁদের ভিত্তিটা কত নড়বড়ে, তা কোভিড দেখিয়ে দিয়েছে। এই ভাইরাসের ব্যবহার ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও কোনও রকম সুনির্দিষ্ট আঁচ করতে পারেনি। তারা ব্যর্থ। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন গবেষণা খাতে বহু অর্থ ব্যয় করেও নতুনতম ভাইরাসের চরিত্রবদলক্ষমতা সম্পর্কে পরীক্ষায় এই সব স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষক ও গবেষকরা গোল্লা পেয়েছেন। তাঁদের ব্যর্থতার দায় চাপাবার জন্য তাঁরা নরম লক্ষ্য হিসেবে বরাবরের মতই বেছে নিয়েছেন সাধারণ মানুষকে। যারা মরছে বা সংক্রমিত হচ্ছে। আর পরিণত হচ্ছে অন্যতর মানুষে, যে আরও আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর এবং ভিজিল্যান্ট। গোরক্ষাবাহিনীর মতই নৃশংস। কোভিডের পরিণতি কী হবে, তা এ ব্যাপারে স্পষ্ট। নজরদার, নজরদারির মান্যতাদায়ী, মজুতদার, এবং ক্ষেত্রবিশেষে কালোবাজারও। কোভিড দুনিয়ার নিউ নর্মাল। কোভিড দুনিয়াই, কারণ কোভিড পরবর্তী কোনও বিশ্ব নেই আর, থাকবে না।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন