রামজন্মভূমি, নাথুরামের থেকে আসুন চোখ ফেরাই গয়ারামের দিকে
রাম এখন রাজনীতির কেন্দ্রে। রামজনমভূমি, নাথুরাম ইত্যাদি নানা রকম রাম ছেড়ে এবারের লেখায় আমরা একটু অন্য রামের খোঁজ করি। তাকাই গয়ারামের দিকে। হরিয়ানার গয়ারামের নাম (আসল নাম গয়া লাল) এখন অনেকেই ভুলে গিয়েছে। ১৯৬৭ সালে হাসানপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জয়ের পর ১৫ দিনের মধ্যে গয়ারাম কংগ্রেসে যোগ দিয়ে বার তিনেক দল বদল করে ফের ফিরে এসেছিলেন কংগ্রেসে। তখন রোজই প্রশ্ন করা হত গয়ারাম আজ কোন দলে! ১৫ দিন পর হরিয়ানার কংগ্রেস নেতা রাও বীরেন্দ্র সিং সাংবাদিক সম্মেলন করে ঘোষণা করেছিলেন, ‘গয়া রাম এখন আয়া রাম’। তিনি ফের কংগ্রেসে ফিরে এসেছেন। সেই থেকে দল বদল নিয়ে এই আয়ারাম-গয়ারাম শব্দের ব্যবহার রাজনীতিতে।
প্রসঙ্গটা কেন এল? মাত্র কয়েক মাস আগে দেশের শীর্ষ আদালত, কর্নাটকের দল বদল,দল বদলে বিজেপি সরকারের জন্ম, কংগ্রেস সরকারের পতন প্রসঙ্গে সাধারণ ভাবে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের স্পিকারদের ভূমিকা নিয়ে খুব কঠোর মন্তব্য করেছিল। প্রশ্ন তুলেছিল স্পিকারদের নিরপেক্ষতা নিয়ে। দল বদলানো বিধায়কের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া উচিত কি না, প্রশ্ন তুলেছিল তা নিয়েও। কারণ দল বদলানোয় যখন শাসকদল লাভবান হয়, তখন সেই বিধায়ককে আইন মেনে বহিষ্কারের বিষয়টি বছররের পর বছর ঝুলিয়ে রাখা হয়। কারণ কত দিনে ওই সিদ্ধান্ত নিতে হয়ে তা দল-বদল সংক্রান্ত আইনে বলা নেই। পশ্চিমবঙ্গেও এই জিনিস চলছে। অন্য দল থেকে শাসকদলে যোগ দেওয়া বিধায়করা কোনও শাস্তির মুখে পড়ছেন না। পড়ছেন না কারণ স্পিকার কোনও সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। বছর গড়িয়ে যাচ্ছে এই ভাবে।
বাজেটের এক সপ্তাহ পার, এখনও বোঝা গেল না প্রয়োজনীয়তা
সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুলল। কিন্তু তা নিয়ে সেভাবে কোনও চর্চা হল না। সম্ভবত কোনও রাজনৈতিক দলই চায় না দল বদলের খেলা বন্ধ হোক। একেকটা বিধানসভার ভোট হচ্ছে আর কুৎসিত ছবি দেখা যাচ্ছে, বাস বোঝাই বিধায়কদের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে হোটেল বন্দি করে রাখার।
প্রত্যেকটি প্রথম সারির রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছে টাকা দিয়ে বিধায়ক কেনার। অর্থাৎ কাজটা যে হয় শুধু নয়, রাজনীতিতে এই কাজ এখন স্বীকৃতও বটে। রাজীব গান্ধী ১৯৮৫ সালে এসব আটকাতে প্রথম আইন করেন। অটলবিহারী বাজপেয়ীও তাতে কিছু পরিবর্তন করেন। কিন্তু এসবে কিছুই আটকানো যায়নি। তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি এই দল বদলকে গত ৬-৭ বছরে এক হাস্যকর জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। কয়েক বছর আগেও প্রতিদিন দেখা যেত অন্য দল থেকে তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন হাসি মুখের বিধায়ক, কাউন্সিলর, পঞ্চায়েত প্রতিনিধি। যে সব বিধায়করা অন্য দল ছেড়ে তৃণমূলে এসেছেন, আইন অনুযায়ী তাঁদের বিধায়ক পদ চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু যায় না। কারণ স্পিকার কোনও সিদ্ধান্ত নেন না। না নেওয়ার সুযোগ প্রচলিত আইনে আছে। ফলে কাজটা চোখে যতই লাগুক, বেআইনি বলা যাবে না।
একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার স্পিকার, মানে অধ্যক্ষ, বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে একটি ‘অভিযোগ’ তুলেছিলেন সিপিএম বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য। ২০১৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিধানসভার ‘জিরো আওয়ার’-এ, তন্ময় বলেছিলেন, ‘দলবদল নিয়ে যার কাছে আমাদের অভিযোগ জানানোর কথা, তাঁরই উপস্থিতিতে দল বদল হচ্ছে’।
তন্ময় এবং অন্য বিরোধীদের বক্তব্য ছিল, ২০১৬-এর ১১ ডিসেম্বর, রবিবার, অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে বারুইপুরে এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় হরিহরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সিপিএম উপপ্রধান-সহ চার জন সিপিএম নেতা দল বদল করে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তন্ময় প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘এই ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছি আমরা। এর পর দলবদল নিয়ে ওঁর কাছে অভিযোগ জানানোর আস্থা থাকবে কি কারও’? স্পিকার অবশ্য তন্ময়কে থামিয়ে দিয়ে বলেন, এটা জিরো আওয়ারে আলোচ্য বিষয় হতে পারে না। এই নিয়ে কোনও আলোচনা চলবে না’। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হোক বা নাই হোক, কেউ তো জানতে চাইতেই পারে, দলবদলে উৎসাহ দেওয়ার কাজটা ‘স্পিকারোচিত’ কাজ হল কি না?
স্বাস্থ্য পরিষেবার সংকট ও সরকারের ভূমিকা
স্পিকার কী করবেন আর কী তাঁর করা উচিত নয়, তার অনেকটাই নির্ভর করে রীতির উপর। বহু আগের কথা। ইংল্যান্ডে তখন হাউসের(house) ইচ্ছের কথা রাজাকে জানানো বা বলার যিনি অধিকারী হতেন, তাঁকে বলা হত স্পিকার। অন্য কেউ রাজাকে এই বিষয়ে কিছু বলতে পারতেন না। তার পর জল অনেক গড়িয়েছে। তবু ব্রিটিশ সংসদে এখনও এক বার স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার পর সেই ব্যক্তি তাঁর দলের সঙ্গে সমস্ত ধরনের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এবং পরবর্তী নির্বাচনে তিনি যদি প্রতিযোগিতা করেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোনও দলই প্রার্থী দেয় না। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি জয়ী হন। এবং যে দলই ক্ষমতায় আসুন, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণ ভাবে তিনিই ফের স্পিকার নির্বাচিত হন।
আমেরিকায় অবশ্য স্পিকার সম্পূর্ণ দলীয়। তিনি এমনকী বিতর্কে যোগদানও করতে পারেন। তবে ইংল্যান্ডে যেমন স্পিকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করা যায় না, তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, আমেরিকায়, সংসদ চাইলে স্পিকারের সিদ্ধান্ত খারিজ করে দিতে পারে।
বিজয় ব্যানার্জির কথা মনে পড়ে? নির্দল হিসেবে রাসবিহারী থেকে ভোটে জিতেছিলেন বামপন্থীদের সমর্থনে। ১৯৬৭ সালের চতুর্থ সাধারণ নির্বাচন ছিল কংগ্রেসের কাছে এক বিরাট ধাক্কা। ১৭টি রাজ্যে বিধানসভা ভোট হল। তার মধ্যে ৭টি রাজ্যে কংগ্রেস নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেল না। উত্তরপ্রদেশ, কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, পাঞ্জাব, মাদ্রাজ। কংগ্রেসকে বাইরে রেখে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এল প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার। মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়। উপমুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। সরকারের মধ্যে তেমন বনিবনা হচ্ছিল না। সেই সুযোগে কংগ্রেস, খাদ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষকে মুখ্যমন্ত্রী করে নতুন সরকার গড়তে তলে তলে এগোতে থাকল। তারই ফলশ্রুতিতে হঠাৎ পদত্যাগ করলেন প্রফুল্ল ঘোষ। দাবি করলেন, তাঁর সঙ্গে আরও ১৭ জন বিধায়ক আছেন।
ছাপা বই বনাম পিডিএফ, বাংলার হাল ও হকিকৎ
অজয় মুখার্জি সরকারকে আস্থা ভোট নিতে বললেন রাজ্যপাল ধরমবীর। জ্যোতিবাবুরা বৈঠক করে ঠিক করলেল ১৮ ডিসেম্বর আস্থা ভোট নেওয়া হবে। কিন্তু রাজ্যপাল অত দিন সময় দিতে রাজি নন। তাই তিনি ২১ নভেম্বর প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করলেন। কংগ্রেসের সমর্থনে নতুন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হলেন প্রফুল্ল ঘোষ।
এইবারে আমরা দেখব স্পিকারের ভূমিকা। ২৯ নভেম্বর স্পিকার বিজয় ব্যানার্জি অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতুবি করে দিলেন বিধানসভা। রাজ্যপাল নির্দেশ দিলেন ১৯৬৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিধানসভার অধিবেশন ডাকতে। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিধানসভা অধিবেশন ফের বসল। হাউসে স্পিকার এসে বললেন, ’৬৭-র ২৯ নভেম্বর বিধানসভার অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবি করে দেওয়ার পর আমার প্রাথমিক রুলিংয়ের ক্ষেত্রে অবস্থার কোনও পরিবর্তন না হওয়ায় আমি পুনরায় বিধানসভা অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবি ঘোষণা করলাম।’
ফলে নতুন সরকার কাজই শুরু করতে পারল না। রাজ্যপাল ধরমবীর বিধানসভায় ভাষণ দিতে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু পারলেন না। ফিরে গেলেন। সভায় তুমুল হট্টগোল, ধাক্কাধাক্কি হল। অবশেষে তিন মাস পর হতাশ হয়ে ২৯ ফেব্রুয়ারি বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করল সেই প্রফুল্ল ঘোষ মন্ত্রিসভা। পশ্চিমবঙ্গে রুজু হল রাষ্ট্রপতি শাসন।
ফের ভোট হল ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ২৮০-র মধ্যে ২১৪ আসন নিয়ে ক্ষমতায় এল দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট। কংগ্রেসের আসন কমে হল ৫৫টি । রাজ্যপালের সাহায্য নিয়ে কৌশলে কংগ্রেসের সরকার গঠনের যে চেষ্টা হয়েছিল, তা আটকে দিয়েছিলেন স্পিকার বিজয় ব্যানার্জি। কারণ তাতে সাধারণের ইচ্ছার প্রতিফলন হত না। নতুন করে ভোট নেওয়ায় তা প্রমাণও হল। কংগ্রেসের পক্ষে জনমত ছিল না। তাই স্বাধীন ভাবে বিবেকের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিজয় ব্যানার্জি। এই কারণেই স্পিকার হিসেবে বিজয় ব্যানার্জি একটি উজ্জ্বল নাম। গৌরবের সেই ধারাবাহিকতা কোথায় আজ?
এবার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কথা। ২০০৮ সালে যখন বামেরা প্রথম ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিল, তখন পার্টি বলা সত্ত্বেও সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় স্পিকারের পদ ছেড়ে রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন না। বললেন, তিনি সাংবিধানিক দায়িত্বে আছেন, নিরপেক্ষ ভূমিকাই তাঁর কর্তব্য। সোমনাথ কি ভুল করেছিলেন? পরবর্তী সব ক’টি নির্বাচনে সিপিএমের যে ছবি দেখা যাচ্ছে তাতে প্রমাণিত, সিপিএমের ওই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। সোমনাথবাবু ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সিপিএম এখনও সে কথা বলছে না।
আমাদের রাজ্য বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় দলবদলের অনুষ্ঠানে থেকে ভুল করেছিলেন না ঠিক করেছিলেন, তাঁর বিবেকই এর উত্তর দিতে পারে। একই সঙ্গে সিপিএম বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য, সুজন চক্রবর্তীরা যদি মনে করেন সোমনাথবাবু অন্যায় করেছিলেন, তাহলে বিমানবাবুকে এ নিয়ে প্রশ্ন করার খুব একটা নৈতিক অধিকার তাঁদেরও থাকে কি?
(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)
এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে ক্লিক করে