দিল্লি তে আছি তিন দশকেরও অধিক সময়। এমন অশান্ত দিল্লি কবে দেখেছি মনে পড়েছে না। ১৯৮৪ সালের দাঙ্গার পর আমি দিল্লি এসেছি। তাই সেই ভয়ংকর দিন আমি সামনাসামনি দেখি নি। কিন্তু এবার উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে যা হলো, তার আগুন এখনও, অর্থাৎ এ লেখা যখন লিখছি তখনও, নেভে নি।
মৌজপুরে আমার পরিচিত এক ছাত্রী থাকে, আজ চার-পঁ৷চ দিন ধরে গৃহবন্দী, জানলা দিয়ে দেখেছে হাতে তরোয়াল নিয়ে কীভাবে মানুষ দস্যু হয়ে গিয়ে একজন আর একজনকে হত্যা করেছে। মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। এই দৃশ্য দেখে তার মনের ওপর প্রচন্ড চাপ পড়ে গেছে। কঁঁ৷দছে, বমি করছে, ভীত-সন্ত্রস্ত।
সমাজতাত্ত্বিক দীপঙ্কর গুপ্ত লিখেছিলেন, 'mistaken modernity'. মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর বৈঠক। কত আধুনিক প্রযুক্তি, যাকে বলা হয় ডেটা ব্যবসা, সে সব নিয়ে ভারত-আমেরিকা অদূর ভবিষ্যতে বানিজ্য চুক্তি করবে। আমরা নাকি আরও আধুনিক হব। নতুন নতুন মোবাইল আমরা ব্যবহার করছি। কত নতুন নতুন অ্য৷প। নতুন নতুন ফ্যাশন। আর এই সমস্ত আধুনিকতার মধ্যেই সাম্প্রদায়িকতার আগুন? এই আধুনিকতাকেই বলে 'mistaken' আধুনিকতা।
আরও পড়ুন: দিল্লি হিংসা: স্থানীয় অপরাধীরাই অস্ত্র জুগিয়েছে বলে দাবি পুলিশের
দিল্লি হাইকোর্ট কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর এবং পরবেশ ভার্মার মত বিজেপি নেতাদের ভর্ৎসনা করেছে। কপিল মিশ্র বলেছেন, তিনি যা করেছেন তা জঙ্গী আচরণের প্রতিবাদে। মুসলিম মৌলবাদ প্রতিহত করতে। এখনও তিনি তাই ক্ষমাপ্রার্থী নন, বিজেপির পক্ষ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়নি। সাসপেন্ড করা হয়নি।কোনও শাস্তি দেওয়া হয়নি। বলা হচ্ছে, কপিল মিশ্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বঁঁ৷চাতে এসব কথা বলেছেন। আমি দু'পক্ষেরই সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা করছি। উগ্ৰ হিন্দু এবং উগ্ৰ মুসলিম, দু'ধরনের সাম্প্রদায়িকতাই নিন্দনীয়। রাজনীতিতে সবসময় চলে দায় চাপানোর খেলা। সেটা দেখে আরও খারাপ লাগছে।
কে এই ঘটনার জন্য দায়ী, তা তদন্ত হওয়ার আগেই বলতে চাই না। বিজেপি নেতারা তো অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, এ ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত সফরে থাকার সময় কেন এ ঘটনা হলো? এতে বিজেপির লাভ কী হলো? এখন তো কোনও ভোট নেই। দিল্লির ভোটও হয়ে গেছে। কপিল মিশ্র নিজেও তো ভোটে হেরে গেছেন। বিজেপি নেতারা বলেছিলেন, এর পিছনে পাকিস্তান ও আইএসআই-ও থাকতে পারে। গোয়েন্দা অফিসাররা অবশ্য বলছেন, পাকিস্তান এ কাজ করেছে এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এ কাজ যে বা যারাই করে থাকুক, কিছু বাস্তববাদী প্রশ্ন তোলা যায়। প্রথমত, এখনও পর্যন্ত এই দাঙ্গায় যতজন নিহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি-ঘরদোর-দোকানও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনের। এটা কেন হলো?
আরও পড়ুন: রক্তাক্ত দিল্লি, সরলেন পুলিশ কমিশনার অমূল্য পট্টনায়ক
গত শনিবার ঘটনার সূত্রপাত। ওই এলাকায় নাগরিকত্ব বিলের বিরুদ্ধে নতুন করে অবস্থান ধর্না শুরু হয়। বলা হয়, শাহিনবাগের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হলো। আর তখনই কপিল শর্মা ওখানে গিয়ে বলেন, ট্রাম্পের সফরের পরই যদি ওখান থেকে বিক্ষোভকারীরা সরে না যান, তবে সকলকে জোর করে সরানো হবে। কপিল বলেছেন, একথা তিনি বলেন যাতে আবার রাস্তা অচল না হয়ে যায়। কিন্তু তাঁর বক্তৃতাই প্ররোচনার কারণ, এমনটা তো বলছে দিল্লি হাইকোর্ট। কপিল মিশ্রকে এজন্য সর্তকও করেছে হাইকোর্ট। আদালতে তাঁর বক্তব্যের ফুটেজ দেখানো হয়। এমনকি অনুরাগ ঠাকুর, পরবেশ ভার্মার দিল্লি ভোটের সময়কার কট্টরবাদী মন্তব্যকেও যথেষ্ট দোষারোপ করেছে আদালত।
আরও প্রশ্ন, শনিবারের ঘটনার পর যখন হাঙ্গামা শুরু হয়ে যায়, তখন সঙ্গে সঙ্গে কেন পুলিসকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হলো না? ট্রাম্প এসেছেন বলে কেন অপেক্ষা করা হলো, এবং ট্রাম্প বিদায় নেওয়ার পর কেন মধ্যরাতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল আসরে নামলেন?
অজিত ডোভালের উপদ্রুত এলাকায় যাওয়া, কারফু জারি করা, এসবই আমি সমর্থন করি। যদিও আইনশৃঙ্খলার অবনতি নিয়ন্ত্রণ করার কাজ দিল্লি পুলিশের, খোদ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার নয়। অটল বিহারী বাজপেয়ীর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র এভাবে কোনোদিন রাজপথে নামেন নি, তা কাশ্মীর হোক আর দিল্লির জনপথই হোক। তবু বলব, এক্ষেত্রে অজিত ডোভাল নেমে ভালই করেছেন। মানুষ আস্থা ফিরে পেয়েছেন। নতুন করে মারদাঙ্গা হয়নি। মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়েনি।
আরও পড়ুন: ‘বিচারব্যবস্থার মুখ বন্ধ করছে সরকার’, মুরলীধরের বদলি নিয়ে সোচ্চার কংগ্রেস
তা বেশ, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দলের বিধায়ক সম্পর্কেও অভিযোগ উঠেছে যে তাঁর বাড়ির কাছে জমা করা ছিল বিস্ফোরক এবং নানা ধরনের ভারি পাথর, অ্যাসিড ভর্তি প্যাকেট বা শিশি। চার তলায় ছিল পেট্রোল বোমা। তাঁর বিরূদ্ধে পুলিশ এফআইআর পর্যন্ত দায়ের করেছে। তবে বিজেপির পক্ষ থেকে প্রশ্ন উঠেছে, কেন তাঁকে গ্ৰেপ্তার করা হচ্ছে না। তাহির হুসেন নামক ওই বিধায়ককে দল থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ কেন তাঁকে এখনও আটক করছে না?
আর একটি প্রশ্ন হলো, তাহির হুসেন তো দাঙ্গার সময় নিজের বাড়িতেই ছিলেন। ভিডিওতে তাঁকে ছাতে যেতেও দেখা গেছে। আবার তিনি বলেছেন, দাঙ্গার সময় তিনি নাকি বাড়িতেই ছিলেন না।
আরও একটি প্রশ্ন হলো, দিল্লিতে এই দাঙ্গা যদি পূর্ব পরিকল্পিত হয়ে থাকে, তবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন গোয়েন্দারা কেন আগাম কোনও তথ্য জানতে পারলেন না? ট্রাম্পের আসার সময় দিল্লিতে কোথায় কী হচ্ছে তা জানার জন্য গোয়েন্দাদের তো আরও অনেক তৎপর থাকার কথা ছিল।
দেখুন, এর আগে আসামে নাগরিকত্ব বিল বিরোধী বিক্ষোভ হঠাৎই এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে যায় যে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সফর স্থগিত করতে হয়। আজও সে সফর বাস্তবায়িত হয়নি। এধরনের গোয়েন্দা ব্যর্থতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও বেশ অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে। আমি মানছি, কোনও ব্যক্তি, বা কোনও নেতাকে এ দাঙ্গার জন্য একতরফা দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। কিন্তু গণতন্ত্রে অতীতে কিন্তু নৈতিক দায়িত্ব রাজনেতারা নতমস্তকে গ্ৰহন করতেন। আজ সে সংস্কারটুকুও আমরা ভুলতে বসেছি। বড় দুঃখের দিন আজ।