সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় সাইকেল লেন হবে। মানে, শুধুমাত্র সাইকেল চলার আলাদা পথ। শুধু তাই নয় শহরের কিছু অংশে শুধুমাত্র সাইকেলই চলবে - তাকে বলা হবে 'সাইকেল জ়োন'। বিভিন্ন জায়গায় আলাদা সাইকেল পার্কিংয়ের জায়গা হবে। অন্যান্য পরিবহণ ব্যবস্থার সঙ্গেও যোগসূত্র গড়ে তোলা হবে সাইকেলের। এককথায় সাইকেল - বান্ধব পরিকাঠামো তৈরি করা হবে কলকাতায়, যেমনটা হওয়া উচিৎ যে কোনও আধুনিক শহরে। Kolkata Metropolitan Development Authority (KMDA) নাকি এই পরিকল্পনা নিয়েছেন। বিষয়টি সম্ভবত প্রাথমিক ভাবনার স্তরেই রয়েছে।
যাঁরা কলকাতায় প্রতিদিন সাইকেল চালান তাঁদের কাছে এর থেকে বড় আনন্দের খবর আর কীই বা হতে পারে?
বস্তুত কলকাতার পরিবহণ ব্যবস্থায় সাইকেলকে এতদিন কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয় নি। শহরের প্রধান রাস্তাগুলোতে সাইকেল তো নিষিদ্ধই, এখনও। অন্তত প্রশাসন তো এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে এখনও কিছু জানান নি। এমনকী বিভিন্ন জায়গায় সাইকেল চালালে ট্রাফিক পুলিশকে জরিমানা দিতে হয়। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষেরা, যাঁরা জীবিকার প্রয়োজনে, খরচ বাঁচাতে সাইকেলের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল, তাঁরাই বেশি হেনস্থা হন পুলিশের কাছে। সারা শহরের বিভিন্ন জায়গায় জ্বলজ্বল করে 'নো সাইক্লিং' বোর্ড। এই নিয়ে বিতর্কও কম হয় নি। কলকাতার এই আজব নিয়মের কথা শুনে অবাক হয়েছেন ভিনরাজ্যের মানুষ। অন্য দেশের মানুষ আকাশ থেকে পড়েছেন। এদিকে এই মুহূর্তে পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম দূষিত শহর কলকাতা। আর সেখানেই কি না সাইকেল নিষিদ্ধ!
আরও পড়ুন, সুন্দরবনে এবার লক্ষ্মী, সাইকেলে চেপে পাড়ি ১১০ কিমি
২০০৮ সালে যখন শহরের ৩৮ টি রাস্তায় সাইকেল নিষিদ্ধ হয় তখন প্রশাসনের যুক্তি ছিল সাইকেল নাকি কলকাতার গতি কমিয়ে দিচ্ছে। এই ১১ বছরে প্রশাসনের বয়ান খানিকটা বদলালেও নিষেধাজ্ঞা কিন্তু বেড়েছে আরও অনেক বেশি রাস্তায় (কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের ২০১৪ সালের নির্দেশ অনুসারে)।
এই ১১ বছরে কলকাতার 'গতি' কতটা বেড়েছে জানি না - তবে প্রাইভেট গাড়ি বেড়ে গেছে অনেক গুণ। ফুটপাথ ছোট হয়ে প্রায় গোটা রাস্তার দখল তারা পেয়ে গেছে। রাস্তার একদিকে, যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে তৈরি হয়ে যায় তাদের স্থায়ী বা অস্থায়ী 'পার্কিং'। সাইকেল হয়েছে আরও কোণঠাসা।
আমি এমন অনেককে চিনি যাঁদের জীবন ঘোরে সাইকেলকে ঘিরেই। আমি রঘুদাকে চিনি, যিনি একটা সাধারণ রোডস্টার সাইকেল নিয়ে কলকাতার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুটে বেড়ান। শুধু সাইকেল নয়, সাইকেলকে ঘিরে থাকা সামাজিক বন্ধন তাঁকে আকৃষ্ট করে। আমি অমলেন্দুদা বা ধীমানদাকে চিনি যাঁরা বাইপাসের অসম্পূর্ণ সাইকেল লেনের কাজ শেষ করার দাবিতে জান লড়িয়ে দেন। আমি কল্লোলদাকে জানি যিনি বাড়ি থেকে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে পড়ানোর জন্য প্রতিদিন সাইকেল নিয়ে যেতেন। সাইকেল নিষেধাজ্ঞার পরপরই টালা ব্রিজে উঠতে বাধা পান ও সরাসরি পুলিশ কমিশনারকে একটা চিঠি লেখেন এই ব্যাপারে। চিঠির উত্তর না এলেও সাইকেল চালানোয় তাঁর ছেদ পড়ে নি। আমি শ্রীমান কিম্বা অমিতকে দেখেছি সাইকেল নিষেধাজ্ঞা তোলার দাবিতে র্যালির জন্য গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তায় পোস্টারিং করতে। আমি শমীক বা শিলাদিত্যকে দেখেছি নিপুণ রাজনৈতিক দৃষ্টি নিয়ে সাইকেল আন্দোলনকে ব্যাখ্যা করতে।
হাজার বাধাবিপত্তির মধ্যেও যাঁরা কলকাতায় প্রতিদিন সাইকেল চালান, এরকম আরো অনেককে আমি জানি। জানি তাঁদের সমস্যাগুলোর কথা। সাইকেল চালানোর সময় গা ঘেঁষে ভয় দেখিয়ে গাড়ি চলে গেলে ঠিক কিরকম লাগে - তা আমরা বুঝি।
আমি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সৌরভকে জানি - শিবপুর থেকে বানতলা, রোজ ৫৫ কিলোমিটার অফিসে যাওয়া আসা করেন সাইকেল নিয়ে। আমি গ্রাফিক ডিজাইনার সুদীপ্তকে জানি - সাইকেল বাদ দিয়ে, কোনো একদিন হঠাৎ বাসে বা ট্যাক্সি করে অফিস গেলে ওর মেজাজ খাপ্পা হয়ে থাকে। আমি একজন ডাব -বিক্রেতার কথা শুনেছি সাইকেল ভর্তি ডাব নিয়ে কলকাতায় প্রতিদিন আসেন প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূর থেকে। আমাদের সুনীশদা অবসর নেবার পর সাইকেল চালিয়ে ২০ বছর বয়স কমিয়ে ফেলেছেন। সাইকেল ভুলিয়ে দিয়েছে তাঁর আর্থ্রাইটিস। অনিলদা প্রতিদিন আধঘন্টায় কসবা থেকে তাঁর কর্মস্থল সল্টলেক সেক্টর ফাইভ পৌঁছে যান সাইকেল নিয়ে, যদি না পুলিশ তাঁকে রুবির মোড়ে আটকায়। আর ৭৫ পেরোনো অনুপদা? সাইকেল নিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা যাওয়ার প্ল্যান করছেন আবার!
আরও পড়ুন, সাইকেলে চেপে বিকল্প দীপাবলি উদযাপন
আমাদের শহর যদি সত্যিই কোনোদিন সাইকেল - বান্ধব হয়ে ওঠে, তাহলে এই মানুষগুলি ও এরকম আরো কয়েকলক্ষ মানুষের আনন্দের সীমা থাকবে না।
কলকাতার আর পাঁচজন সাইকেল আরোহীর মতো আমিও সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি এবং চাইছি যত দ্রুত এই কাজ শেষ হোক। বস্তুত সাইকেল লেন বানানোর কাজটা খুব কঠিন বা খরচ সাপেক্ষও নয় অন্যন্য অনেক প্রকল্পের নিরিখে। একটু দাগ দিয়ে ও রঙ দিয়ে আলাদা করে খুব দ্রুত শুরু করে দেওয়া যায় শহরের অনেকগুলি রাস্তায়। শুধু শুরু করে দিলেই হবে না। যত্নবান হতে হবে এর রক্ষণাবেক্ষণে। খেয়াল রাখতে হবে এর উপর যেন গাড়ি পার্কিং না হয়। বা অন্য উচ্চগতির মোটরবাইক বা স্কুটার না চলে। এরকম দৃষ্টান্ত ভারতের অন্যান্য শহরে আমরা দেখেছি। মোট কথা এশহরের পরিবহণ ব্যবস্থায় সাইকেলকে প্রায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। যেমনটা দেয় সাইকেল বান্ধব আধুনিক শহরগুলি। মূল কলকাতা শহরের আয়তনও খুব বেশি নয়,মুম্বাই বা দিল্লির তুলনায়। শহরের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে প্রায় উত্তর প্রান্তে মাত্র ১ ঘন্টার সাইক্লিংয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় - খুব সাধারণ সাইকেলে, সাধারণ গতিতে চালালেও। রাস্তা ভালো থাকলে সাইকেল সাধারণভাবে ৪ / ৫ মিনিটের মধ্যে ১কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে সহজেই।সংশ্লিষ্ট মহল বা সংস্থাগুলি নিশ্চয়ই সমীক্ষাও করবেন তাঁদের মতো করে। কিন্তু কলকাতায় যাঁরা রোজ সাইকেল চালান তাঁদের অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রোজ যাঁরা সাইকেল চালান তাঁরা ছাড়াও আরো অনেক অনেক মানুষ সাইকেলকে নতুনভাবে বেছে নেবেন এই পরিকাঠামো গড়ে উঠলে। আর পরিবেশরক্ষার বিষয়টিতে রয়েইছে।
তবে শুধু পরিকাঠামো নয়। প্রশাসনকে উদ্যোগী হতে হবে সাইকেল চালানোতে উৎসাহ দেওয়ার কাজেও। বহুদিন এর উল্টোটা হয়ে এসেছে এই শহরে। এবার তাতে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
সাইকেলকে তো একটু অবহেলার চোখে দেখা হয় আমাদের সংস্কৃতিতে। সেটাও একটু ভাবা দরকার। শুধু প্রশাসন নয়। ভাবতে হবে নাগরিকদেরও। 'দারিদ্রের চিহ্ন' হিসেবে গড়ে উঠেছে সাইকেল। এবং সত্যিই সাইকেল এখনও কম আয়ের মানুষের লাইফলাইন। তাই হয়তো উচ্চ বা মধ্যবিত্তদের একটা অনীহা প্রকাশ পায় সাইকেলের প্রতি। বুঝতে হবে এই 'দারিদ্র্যের চিহ্ন'টিই আমাদের সবাইকে বাঁচাতে পারে। একে গায়ে মাখতে হবে। গাড়ির কনভয় ছেড়ে অফিসের উচ্চপদস্থকেও সাইকেলে যাতায়াতে উৎসাহ দিতে হবে, সম্ভব হলে নিজেও সাইকেলে চড়তে হবে কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতের জন্য। অন্যরা তাতে আরও উৎসাহিত হবেন। সমর্থদের বুঝতে হবে সামাজিক প্রতিষ্ঠার সঙ্গে অনেকটা রোডস্পেস দখল করা ধোঁয়াযুক্ত ঢাউস গাড়ি ব্যবহারের কোনো যোগ নেই। বরং সম্পূর্ণ উল্টোভাবে ভাবা শুরু করতে হবে শহরের শিক্ষিত সমাজকে।
স্কুটি বা মোটরবাইক বাদ দিয়ে, কমবয়সীদের অনেকেই আজকাল সাইকেলের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন । নানারকম গিয়ার দেওয়া, হালকা আধুনিক সাইকেলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন স্বাধীনভাবে শহরের এদিক ওদিক। এটা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। এই পরিকারঠামো তৈরি হলে আমরা আশা করবো অনেক সমর্থ মেয়েরাও স্কুটি ছেড়ে সাইকেলের পথে আসবেন। যে সাইকেল একসময়ের নারীবাদী আন্দোলনের চিহ্ন হয়ে উঠছিল, তাই যেন পরিবেশ বাঁচানোর প্রতীক হয়ে ফিরে আসে আজকের কলকাতায়।
আরও পড়ুন, ‘তাতে আমার কী?’ বলার সময় শেষ
২০১৮ সালে রাষ্ট্রসংঘ যখন ৩ জুন তারিখটিকে World Bicycle Day হিসেবে ঘোষণা করেছিল, তার সংকল্পপত্রে বলা হয়েছিল সাইকেল মানবিক যোগাযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ও সমাজে এক ধরনের সাম্যভাব আনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।
আবার বিখ্যাত প্রবীণ পরিবেশবিদ ও চিন্তাবিদ Lester R. Brown তাঁর 'PLAN B 4.0; Mobilizing to Save Civilization' বইতে নতুনভাবে মানুষকেন্দ্রিক শহর গড়ার কথা বলেছেন। তাঁর এই ভাবনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় 'Return of Bicycle'
সারা পৃথিবীর বিভিন্ন বড় শহরে সাইকেল নিয়ে কাজ করছে আমস্টারডামের 'BYCS' সংস্থা। যাঁরা বলছেন শহরগুলো বদলালে পৃথিবী বদলাবে। এবং সেই বদল আসবে সাইকেলের পথ ধরে। সম্প্রতি কলকাতাতেও কাজ শুরু হয়েছে 'BYCS' এর ভাবনায়। ওঁদের স্লোগান '50 by 30'. অর্থাৎ ওঁদের লক্ষ্য বা বক্তব্য, ২০৩০ সালের মধ্যে কোনো একটি বড় শহরের মোট যান চলাচলের অন্তত ৫০% সাইকেলের মাধ্যমে হোক।
'কলকাতা সাইকেল সমাজ' সাইকেল আরোহীদের অধিকার নিয়ে সরব থেকেছে গত ১০ বছর ধরে। লাগাতার তাঁরা কাজ করেছেন কলকাতায় সাইকেল চালানোর স্বপক্ষে। জনমত তৈরি করেছেন। ট্রাফিক পুলিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিটিং করেছেন। বিস্তারিত চিঠি দিয়েছেন পরিবহন মন্ত্রীকে।
এতসব আন্তর্জাতিক ও আধুনিক ভাবনাচিন্তার মধ্যেও দিব্যি টিকে আছে কলকাতার রাস্তায় 'সাইকেল নিষেধাজ্ঞা'।
আশা করা যায় খুব দ্রুত এই নিষেধাজ্ঞাটি বাতিল হবে।
দেরিতে হলেও প্রশাসন যে অবশেষে সাইকেল-পরিকাঠামোর কথা ভেবেছেন, আশা করা যায় তাতে সাড়া দেবেন কলকাতার নাগরিকসমাজের বৃহত্তর অংশ। পরিকল্পনার স্তর পেরিয়ে, যত তাড়াতাড়ি এই কাজ শেষ হয় ততই এই শহরের মঙ্গল।
(শতঞ্জীব গুপ্ত কলকাতা সাইকেল সমাজের স্বেচ্ছাসেবক ও BYCS গোষ্ঠীর কলকাতার সাইকেল মেয়র)