Advertisment

করোনা নিয়ে ধর্মের রাজনীতি করলে লোকসান আমাদেরই

রামায়ণ বা মহাভারত সিরিয়াল মানেই উগ্র হিন্দুত্বের প্রসার বলাটা যেমন অবৈজ্ঞানিক, তেমনি ইসলাম মানেই সন্ত্রাসবাদ বলাটা খুবই পশ্চাদমুখী মানসিকতা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
tablighi jamat coronavirus

বৃহস্পতিবার দিল্লির নিজামুদ্দিন এলাকায় ড্রোন থেকে বর্ষিত হয় জীবাণুনাশক স্প্রে। ছবি: তাশি তোবগিয়াল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

করোনা নিয়ে যখন ভারতে তুলকালাম কান্ড চলছে, তখন তবলিগি জামাতের দিল্লি সম্মেলন এক নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে। আমি যখন এ লেখা লিখছি, তখন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুসারে নতুন ৫০০ টি করোনা কেসের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ এসেছে তবলিগি জামাতের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে। শুধু তামিলনাড়ুতেই ৪১১ টি কেসের মধ্যে ৩৬৪ জন হলেন তবলিগি জামাতের প্রতিনিধি। ঘটনাবলী বড় দুঃখের; এ ঘটনা বড় আশঙ্কার।

Advertisment

আমি এখন নিজে বাড়ি থেকে বসেই কাজ করছি, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মেনে নিয়ে। হাতে সময় আছে, তাই মনে হলো, হঠাৎ ভারতে তবলিগি জামাত নিয়ে এত সমালোচনা শুরু হয়েছে, অতি উৎসাহী কিছু মাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া, যখন এই সংগঠনকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বলে চিহ্নিত করেছে, তখন এই সংগঠনের ইতিহাস একটু জানার চেষ্টা করা যাক।

জানলাম, ১৯২০ সালে ভারতেই প্রথম এই সংগঠনটি তৈরি হয়। আজ পৃথিবীর ১৬৫ টি দেশে এই সংগঠনের কাজকর্ম ছড়িয়ে আছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে মোট ৮০ মিলিয়ন (৮ কোটি) মানুষ এই সংগঠনের সমর্থক, সদস্য। স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের আগে ভারতের মতো পাকিস্তানেও এই সংগঠনের প্রচুর সদস্য ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে এই সংগঠনের প্রচুর সমর্থক আছেন।

আরও পড়ুন: নিজামুদ্দিন কতটা ক্ষতি করল ভারতীয় মুসলমানদের

তাই এই সম্মেলন করতে গিয়ে এই সংগঠনের প্রধান বেশ কিছু মৌলানা অভিযুক্ত হয়েছেন, কিন্তু তাই বলে এই সংগঠনের ভাবাদর্শ বা ঐতিহাসিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টারও ঘোরতর বিরোধী আমি।

দেওবন্দী সংগঠনের একটি বিশেষ ধারা হিসেবে এটি বিকশিত হয়। একে বলা যায় 'ইসলামিক মিশনারি' আন্দোলন। মূলত সাবেকি প্রথা, পোশাক, এবং সনাতনী আচরণ ও নৈতিকতাকে ফিরিয়ে এনে পাশাপাশি আধুনিক মানবতাবাদকে গ্রহণ করা হলো এই সংগঠনের ভাবাদর্শ। ১৯২৭ সালে মহম্মদ ইলিয়াস এই সংগঠনের গুরু ছিলেন। রাজনীতির সঙ্গে কিন্তু এই সংগঠনের কোনো সম্পর্ক নেই। কুরআন ও হাদিসকে অনুসরণ এবং হিংসার বিরুদ্ধে মানুষের শুদ্ধিকরণের জন্য এই সংগঠন নানা দেশে ইজতেমা করে।

অধ্যাপক মহম্মদ বুলবুল আশরফ সিদ্দিকী ব্রিটেনের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে এক দীর্ঘ গবেষণাপত্র জমা দেন। পেপারটির নাম 'দ্য তবলিগি জামাত ইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ইউকে: অ্যান এথনোগ্রাফিক স্টাডি অফ ইসলামিক রিফর্ম মুভমেন্ট'। এই পেপারটি পড়ে জানলাম, বাংলাদেশেও এই সংগঠনের গণভিত্তি আছে। তাই ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে, এবং ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জে বড় ইজতেমা হয়। ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশে এই সংস্থা ১৬০ একর জমি পায় টঙ্গী নদীর ধারে। বিশ্ব ইজতেমাও হয়েছে বারবার। ৩২ টি জেলার সম্মেলনে এত মানুষ আসেন ২০১০ সালে যে দুই কিস্তিতে সম্মেলন করা হয়। আরও পড়লাম, ছ'টি নীতির উপর এই সংগঠনের কাজকর্ম দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমত বিশ্বাস, দ্বিতীয়ত প্রার্থনা, তৃতীয়ত জ্ঞান প্রসাদ, চতুর্থত ইসলাম ও মুসলমান সমাজকে শ্রদ্ধা, পঞ্চমত আধ্যাত্মিক সংস্কার, ও ষষ্ঠত সামাজিক উদ্দেশ্যর আন্তরিকতা।

আরও পড়ুন: দিল্লির নিজামুদ্দিনের ঘটনা ‘অপরাধমূলক’, শাস্তির দাবি তুলে গর্জে উঠলেন অপর্ণা সেন

আপনাদের মনে হতে পারে, আজ এত কথা বলছি কেন! বলছি এই কারণেই যে ভারতের উত্তরপ্রদেশের এক গ্রামে যখন আমি দেখলাম এক হিন্দু নারী নিজেকে দেবী বলে দাবি করে হাতে তরবারি নিয়ে ঘোষণা করছেন, করোনা মানি না। নবরাত্রি শুরু হয়েছে। এই নবরাত্রির প্রথম দিনে আমার ভক্তরা সবাই এসে গেছে, সম্মেলন হবেই। তখন আমি এই স্বঘোষিত দেবীর আচরণকে সমর্থন করি নি। শেষ পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশের পুলিশ এসে তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গেছে।

একইভাবে আমার মনে হয়েছে, তবলিগি জামাতের মত এহেন সম্মানজনক সংগঠনের এই তিন দিনের সম্মেলন বাতিল করাটাই উচিত ছিল। তবে আশার কথা, শেষ পর্যন্ত মৌলানা নিজেই বলেছেন যে করোনাভাইরাসের সঙ্গে ইসলামের কোনও সম্পর্ক নেই, উচিত চিকিৎসকদের কাছে যাওয়া। কোভিড-১৯ পরীক্ষা করানোটা কখনোই ইসলাম-বিরোধী নয়। ভারতে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে এ ধরনের বেশ কিছু টিকটক ভিডিও প্রচার করা হচ্ছিল। মহারাষ্ট্রে নাসিকের এসপি আরতি সিং এ ধরনের একটি ভিডিওচক্রকে ভেঙ্গেও দিয়েছেন।

ভারত এবং বাংলাদেশ, আমরা দুইজন দুই প্রতিবেশী, ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বারবার একথা আমি বলছি যে আজ আমরা দুই দেশই করোনা নামক এক ভয়ঙ্কর ভাইরাসের আক্রমণে পর্যুদস্ত। জানি না এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আর কতদিন চলবে। এই অসুখের সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। ধনী আর দরিদ্রেরও কোনও সম্পর্ক নেই। ব্রিটেন বা ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রীরা করোনার প্রভাবে আক্রান্ত হয়ে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মেনে নিয়েছেন। স্পেনের বৃদ্ধা রাজকুমারীর মৃত্যু হলো করোনায়। জার্মানির অর্থমন্ত্রী অবসাদে আত্মহত্যা করলেন। অন্যদিকে অসংগঠিত ক্ষেত্রের কোটি কোটি দিন-আনি-দিন-খাই মানুষের জীবন এক গভীর সঙ্কটে। আমেরিকায় করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এখন হুহু করে বাড়ছে। পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কী, আমরা জানি না।

আরও পড়ুন: নিজামুদ্দিনের জমায়েতকারীদের অশালীন ব্যবহারে এনএসএ প্রয়োগের পথে যোগী

তাই এ পরিস্থিতিতে করোনা নিয়ে তবলিগি জামাতের সম্মেলন বিতর্কের সঙ্গে ধর্মের প্রশ্ন যুক্ত করা উচিত নয়। আবার ১২ মার্চ দিল্লির মরকজে যেভাবে ভাষণ দেওয়া হয়েছে, তারও বিরোধিতা করা উচিত। মরকজ ম্যানেজমেন্ট-এর প্রধান মৌলবীকেও এখন আইসোলেশন সেন্টারে রাখা হয়েছে। এই মৌলবীর বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ নোটিশ জারি করেছে। এই মৌলবি দিল্লিতে থাকেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই।

আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তবলিগি জামাত ভারতে কোনও রেজিস্টার্ড সংগঠন নয়। এই সংগঠনটি প্রথম থেকেই চরিত্রগতভাবে 'ইনফরমাল'। অন্য সংগঠনগুলোর তুলনায় এই সংগঠনের চরিত্র আলাদা।

কথা হচ্ছিল প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বিদেশ মন্ত্রকের এক অফিসারের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, তবলিগি জামাতের এই সম্মেলন ভারতের অসুবিধার সৃষ্টি করেছে বটে। বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু প্রতিনিধি এসেছিলেন, একথাও সত্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজে এ ব্যাপারে খুবই সচেতন, যেন এই ঘটনা ভারত এবং বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নষ্ট না করে দেয়। ৫ এপ্রিল মোমবাতি জ্বালিয়ে রাত ন'টায় সব ঘর অন্ধকার করে ভারতবাসী একতার বার্তা দেবেন, প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতীকী আবেদনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের কাছেও ইতিবাচক বার্তা দেওয়া আছে। আমরা হাতে হাত ধরে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করব।

ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিকে তাই এই ভয়াবহতার দিনে দূরে সরিয়ে রাখুন। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের নিজেদের মধ্যেও যে বহু অন্তর্বিরোধ থাকে, সেটাই আমরা ভুলে যাই বহুক্ষেত্রে। তাদের সকলকে একরূপ জনগোষ্ঠী মনে করে স্থল বিভাজন অহেতুক বিবাদ সৃষ্টি করতে পারে। আমরা যে জাতিসত্তার কথা বলি, ভারতে তাও এক সমজাতীয় জনগোষ্ঠী নয়। তাই আপাতত করোনা প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্যপরিষেবা এবং নাগরিক সচেতনতাই মুখ্য।

টি এস এলিয়ট-এর কবিতার বিখ্যাত লাইন, 'ইতিহাস অজস্র চতুর আর মেকি গলিপথের প্রহেলিকা'। এত ইতিহাস পড়ি আমরা, তবু যে কেন সামাজিক সংস্কার মোচন হয় না! আসল কথা হলো দৃষ্টিভঙ্গির বদল। তবলিগি জামাতের দর্শনেরও মূল কথা হলো সংস্কার। দৃষ্টিভঙ্গির বদল।

আরও পড়ুন: তবলিগি জামাতিদের সঙ্গে কথাবার্তা: “নিজামউদ্দিনের ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক, ডাইনি শিকার করবেন না”

সংবাদমাধ্যমে দেখছি এমন প্রচারও চলছে যে এই সংগঠন থেকে বহু সদস্য সন্ত্রাসবাদী সংগঠনে যোগ দিয়েছেন। বিশেষত ফ্রান্সে নাকি সন্ত্রাসবাদী জিহাদি কার্যকলাপে এ সংগঠনের ভূমিকা আছে। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ নাকি এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন।

প্রথমত, ইসলাম মানেই সন্ত্রাসবাদ, এহেন মানসিকতা থেকেও আমাদের দূরে সরে আসতে হবে। রামায়ণ বা মহাভারত সিরিয়াল প্রদর্শন মানেই উগ্র হিন্দুত্বের প্রসার বলাটা যেমন অবৈজ্ঞানিক, ঠিক তেমনি ইসলাম মানেই সন্ত্রাসবাদ বলাটা খুবই পশ্চাদমুখী মানসিকতা। 'মহাভারত' আশির দশকে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে পিটার ব্রুকের 'মহাভারত'কে পরাস্ত করে বি আর চোপড়ার 'মহাভারত' বিবিসিতে প্রদর্শিত হয়েছিল। ঠিক এভাবেই তবলিগি জামাত-এর দর্শন ও তাদের গণভিত্তিকে অবজ্ঞা করা অনুচিত।

করোনার প্রকোপে এই সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই ভুল। এ ভুল হওয়া উচিত হয়নি, এই ভুলের জন্য দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া হোক। কিন্তু তা বলে যে কোনও ইসলামিক সংগঠনকে সাধারণভাবে দোষারোপ করা অনুচিত। এত মানুষকে নিয়ে খোদ দিল্লিতে নিজামুদ্দিনে এমন সম্মেলন হলো, সেটা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারাই বা কেন জানতে পারলেন না? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নর্থ ব্লক এই ঘটনাস্থল থেকে দূরে নয়। দরগা বন্ধ ছিল। নিজামুদ্দিনের দরগার সঙ্গে এই মরকজের কোনও সম্পর্ক ছিল না? তাহলে এ কি এক গুরুতর প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়?

Advertisment