১৯৬৪ সালের ১০ অক্টোবর। মুম্বইয়ের এক অ্যাপার্টমেন্টে পাওয়া গেল গুরু দত্তের মৃতদেহ। বয়স মাত্র ৩৯। অতিমাত্রায় অ্যালকোহল ও ঘুমের ওষুধের মিশ্রন পাওয়া গিয়েছিল পাকস্থলীতে। ভারতীয় সিনেমার গতি-প্রকৃতি বদলে দেওয়া এই মানুষটি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। শুধু ভারতীয় নয়, এশিয়া তথা বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে তাঁর কাজ স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা আত্মহত্যা কিনা, তাই নিয়ে বিতর্ক ছিল। গুরুর পুত্র পরে বলেছিলেন, ঘুমের ওষুধের ওভারডোজ এবং অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলেই মৃত্যু, তবে আত্মহত্যা নয়। যাই হোক, একসঙ্গে অত ঘুমের ওষুধ সহ মদ্যপানের পিছনে লুকিয়ে থাকা সত্যটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। মানসিকভাবে শান্তি বা সুস্থিতি থাকলে, এই ধ্বংসের পথে কেউ পা রাখে না।
সেই সময় মিডিয়া আজকের মতো সক্রিয় ছিল না। তাহলে আজকের মতোই প্রচুর কাটাছেঁড়া চলতো। পর্যালোচনায় এটুকুই প্রকাশিত, ভালো ছিলেন না তিনি। স্ত্রী তথা অত্যন্ত গুণী সংগীতশিল্পী গীতা দত্তের সঙ্গে বোঝাবুঝির অভাব ছিল। গুরুর জীবনে আর এক গুরুত্বপূর্ণ নারী ওয়াহিদা রহমান, তিনিও সম্ভবত দূরে সরে যান। কথিত, ওয়াহিদার জন্যই একদা প্রেমিকা ও স্ত্রী গীতার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে গুরুর। আলাদা থাকতে শুরু করেন তাঁরা। এইসব মিলিয়েই কি হতাশা, অবসাদ এবং জীবন থেকে বিদায়? তথ্য বলে, গুরু এর আগেও দু'বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন।
আরও পড়ুন: সোশ্যাল মিডিয়ায় ভক্তের ওঠা নামা! সুশান্তের মৃত্যুতে কে রাজা, কেই বা ফকির?
চলে আসি ২০১৮'য়। ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখটা রীতিমতো শকিং ছিল ভারতীয় সিনেমা দর্শকের কাছে। দুবাইয়ের এক বহুতারা হোটেলের স্নানঘরে বাথটবে মিললো শ্রীদেবীর নিথর দেহ। আবিস্কার করেন শ্রীর স্বামী বনি কাপুর। বয়স ৫৫, অসুস্থ ছিলেন এমন তথ্যও ছিল না। মাত্র কিছুদিন আগে দুরন্ত কামব্যাক করেছেন 'ইংলিশ ভিংলিশ' দিয়ে। তাহলে অশান্তিটা কোথায়? প্রচুর বিতর্ক হলো। সব মিটিয়ে দুবাই থেকে মুম্বই শ্রীদেবীর দেহ নিয়ে আসার মধ্যেi সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, এটা একটা দুর্ঘটনা। কিছুদিন চর্চা চলল। মিডিয়ায় নানা গল্প।
তারপর একদিন সবাই সব ভুলে গেল। যেমন ভুলে গেল দিব্যা ভারতী, জিয়া খান, প্রত্যূষা ব্যানার্জি, কুলদীপ রনধাওয়া এবং টলিউডের অত্যন্ত প্রতিভাময়ী ও শক্তিশালী অভিনেত্রী মহুয়া রায়চৌধুরীর অস্বাভাবিক ও অকালমৃত্যুর কথা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আত্মহত্যা হলেও, প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে অভিযোগের কাঠগড়ায়। আর কাঠগড়ার এই এক বা একাধিক ব্যক্তি হয় প্রভাবশালী, নয় বিপুল অর্থবান। ফলে, সব মিটে যেতে দেরি হয় না।
সাম্প্রতিক সুশান্ত সিং রাজপুত। খুবই বেদনাদায়ক তাঁর এই অকালমৃত্যু। এখানেও হত্যা না আত্মহত্যা, প্রথম প্রশ্ন উঠেছিল এটাই। কোনও সুইসাইড নোট না পাওয়া গেলেও মুম্বই পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে আত্মহত্যা বলেই জানায়। তবু মানুষ সন্তুষ্ট নয়। সুশান্তর পরিবারের পক্ষ থেকে তো বটেই, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের তরফেও ক্ষোভ, অভিযোগ আছে। আর সুশান্তর অগণিত ভক্তকুল তো রীতিমতো আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে। লোকজনের রাগ বা ক্ষোভকে ভিত্তিহীন বলা যাবে না। নেপোটিজম বা লবিবাজির অভিযোগ বলিউডে এর আগেও উঠেছে। এমন অভিযোগ টলিউডেও আছে। সত্যি কথা বলতে গেলে, কোন পেশায় নেই? ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির খবরের দিকে আম জনতার চোখ একটু বেশি থাকে। তাই ঢেউটাও ওঠে বেশি।
আরও পড়ুন: দুটো কোম্পানি মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি চালায় এবং ঠিক করে কে গান গাইবে: সোনু নিগম
সুশান্তর প্রেক্ষিত ধরেই যদি বলি, এত সম্ভাবনা, এত প্রতিভা, শিক্ষা, মেধা, তারই সঙ্গে সাফল্য, জনপ্রিয়তা। তবু কেন নিজেকে এভাবে শেষ করে দেওয়া? তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু এই প্রশ্নের জবাব মানুষ নিজেই খুঁজে বের করে নিচ্ছে। এই মানুষদের মধ্যে কঙ্গনা রানাওয়াতের মতো বলিউড সেলিব্রিটিও আছেন। সুশান্তর মৃত্যু প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্যের ভিডিওটি বিপুলসংখ্যক ভাইরাল হয়েছে।
অন্যদিকে সংবাদমাধ্যম থেকে সোশ্যাল মিডিয়া, সর্বত্র চর্চিত কতটা মন খারাপ, হতাশা ও অবসাদের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন তিনি! কিভাবে তাঁর কেরিয়ার নষ্টের উদ্যোগ নিয়েছিল বলিউডের রাঘববোয়ালরা। আবার এমন এক সংকটের সময়েই তাঁকে ছেড়ে চলে যান তাঁর বান্ধবী, যাঁর সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি সাত পাকে বাঁধা পড়তে চলেছিলেন সুশান্ত। এইসব ভিতরের খবর রাতারাতি কী করে চাউর হয়ে যায়? খবরগুলো কে দেয়? যে বা যারা দেয়, সে বা তারা সুশান্তর কে? এসব প্রশ্ন কোথাও ওঠে না। সত্যি বলতে কী, তুলতে গেলেও বিপদ। লোকজনের ভাবাবেগে প্রবল আঘাত লাগার সম্ভাবনা। যদিও বাস্তব হলো, এই লোকজনই গুরু দত্ত থেকে শ্রীদেবী বা মহুয়াকে ভুলে গেছে। একদিন সুশান্তকেও…!
এই বিস্মরণের আগেই তাই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা তোলা প্রয়োজন। অগাধ প্রতিভার অধিকারী এই তরুণের মৃত্যু আসলে যে প্রশ্নগুলো তুলে আনে, চোখ ফেরানো দরকার সেদিকে। দরকার সত্যের মুখোমুখি হওয়ার। সব পেশাতেই পিছন থেকে ছুরি শানানো, কেউ ওপরের দিকে উঠতে চাইলে তাকে টেনে নামানো, দলে না থাকলে তাকে উত্যক্ত করে তোলা - এইসব চিরাচরিত ঘটনা।
শুধু যদি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বা আরও ভালো করে বলিউডের কথা ধরি, সুশান্তই প্রথম নন। কোণঠাসা করার চেষ্টা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়েছে। স্বয়ং ধর্মেন্দ্রর মতো প্রবীণ অভিনেতা বলেছেন, বলিউড খুব নিষ্ঠুর জায়গা। অনেকের কথাতেই এটা প্রকাশিত, এখানে কেউ বন্ধু নয়। এটাও বলা হয়, প্রায় প্রত্যেকেই মুখোশ পরে থাকে। সুশান্তর মৃত্যুকে ঘিরে এই কথাও উঠেছে, বেঁচে থাকতে তাঁকে যারা এই অবসাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, তারাই এখন কুমিরের কান্না কাঁদছে। এই অভিযোগের সমর্থনে মুখ খুলেছেন সইফ আলি খানের মতো প্রতিষ্ঠিত তারকা। "এখানে প্রবল হিপোক্রেসি চলে!" বলেছেন ক্ষুব্ধ ছোটে নবাব।
আরও পড়ুন: বাংলা ইন্ডাস্ট্রির স্বজনপোষণ নিয়ে বিস্ফোরক শ্রীলেখা
এইসবই সত্যি। কিন্তু তারপর? এইসব অভিযোগ, অনুযোগেই শেষ হয়ে যাবে এই যন্ত্রণাময় পর্ব? সুশান্তর সঙ্গে ঠিক কী হয়েছিল, আজ আর জানা যাবে না। শুধু, এইটা বলার, ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেল। ক্ষতি হলো তাঁর পরিবারের। ইন্ডাস্ট্রির কিছু আসে যায় না। আর আমরাও কিছুদিন পর ভুলে গিয়ে অন্য কোনও ইস্যুকে আঁকড়ে ধরব। তবে কেন? কেন এই ধ্বংসের পথ বেছে নেওয়া? এই অপরিহার্যতা কি এড়ানো যেত না? তাঁর ওপর দিয়ে যে ঝড়ই বয়ে যাক, আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও পথ কি ছিল না? প্রসঙ্গত, হত্যার সম্ভাবনা নিয়ে যতই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টের ছয়লাপ হোক, এর এখনও পর্যন্ত কোনও তথ্যগত ভিত্তি নেই। তাই আমরাও আত্মহত্যা প্রসঙ্গ ধরেই চলব। সেদিনের গুরু দত্ত থেকে আজকের সুশান্ত সিং রাজপুত। কোথায় সেই ঘাটতি, যা একজন পরিপূর্ণ শিল্পীকে খেলার মাঠ থেকে খেলা অসমাপ্ত রেখে চলে যেতে বাধ্য করে?
জবাব একটাই, যুদ্ধের মানসিকতা। ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি 'temperament'; এটা না থাকলে কোথাও দশটা-পাঁচটার চাকরি করাই ভালো। যেখানে নিরাপদ ও তরঙ্গহীন জীবন। বলিউড যে সমুদ্র। সেখানে কোথাও কি মধ্যবিত্ত-সুলভ মান-অভিমানের স্থান আছে? ভাবাবেগ সেখানে শুধুই পর্দায়। পর্দার পিছনে জটিল অঙ্কের হিসেব। ভুললে চলবে না এই প্রবাদ, 'যস্মিন দেশে যদাচার'। সুশান্ত যে এসব কথা ভাবনায় রাখেননি, সে তো বোঝাই যাচ্ছে।
এখানে স্বপ্ন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে হলে আর সবকিছুর সঙ্গে কৌশলী লড়াই চালিয়ে যাওয়ার চাতুর্যটাও সমান জরুরি। হৃদয় ও মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সমন্বয় সাধন একান্ত প্রয়োজন। ব্যক্তিগত টানাপোড়েন থাকতেই পারে, তা পেশার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। এই যে সব সোশ্যাল নেটওয়ার্কে হৃদয় বিশেষজ্ঞরা হাহাকার করে বলছেন, "ইস, কাউকে যদি একটু বলতে পারতেন মনের কথা!" কাকে বলি আমরা, কে-ই বা শুনি? শুনি যদি, তাকে নিয়ে হয় হাসির খোরাক, নয় নিজের স্বার্থে কাজে লাগাই। আমাদের ডাল-ভাতের জীবনেই এই, আর ওখানে তো আরও প্রতিকূল অবস্থা।
মহেশ ভাট, করণ জোহর বা খানদের কুশপুত্তলিকা দাহ করলে সুশান্ত ফিরে আসবেন না। মামলা-মোকদ্দমা করেই বা কী হবে? সলমন খানকে তাঁর নিজের করা অপরাধেই ছুঁতে পারেনি কেউ, এ তো সন্দেহবশে অভিযোগ। কোথাও কারও গায়ে এতটুকু আঁচ লাগবে না। এখানকার লবিবাজির বুনিয়াদ সত্যি খুব শক্ত। তাহলে নিটফল কী হলো? একটি অপরূপ তারা হারিয়ে গেল অসময়ে। আজ মাতামাতি, কাল বিস্মরণ, এটাই নিয়তি।
কিন্তু, যদি অন্য কিছু হতো? যদি জেদটা ধরে রাখতেন সুশান্ত? যদি এদেরই মতো কৌশলী হওয়ার অঙ্ক কষতেন, তাহলে হয়তো এড়ানো যেত এই অকালবিদায়। এটাই কাম্য আসলে। এটাই জবাব সব অন্যায়ের। টিকে থেকে বেদনাকে আগুনে পরিণত করা। একান্তের অশ্রুকে বাষ্পে পরিবর্তন। আগুনটা জ্বলুক না ধিকি ধিকি। একদিন সেই আগুনই তৈরি করে দেবে আলোকময় বৃত্ত। নিজেকে শেষ করে কাকে শাস্তি দিলেন তিনি? কে মনে রাখবে? সব চোখের জল অচিরেই যাবে শুকিয়ে। পড়ে থাকবে ছাই। স্মৃতিরাও একদিন উড়ে যাবে কালের আকাশে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন