কিছু কিছু ছবি হয় যেটা দেখার পর সেটা ভাল না খারাপ দুম করে সেটা ডিসাইড করা যায় না। ছবির কিছু কিছু জিনিস এত খারাপ লাগে যে রাগে গা-পিত্তি জ্বলে যায়, আবার পরক্ষণেই কিছু জিনিস এতটাই ভাল লেগে যায় যে চোখের জল বাধা মানে না। ‘কবীর সিং’ এরকমই একটি ছবি।
ছবিতে কবীর সিং-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শাহিদ কাপুর, আর তার প্রেমিকা প্রীতির ভূমিকায় কিয়ারা আডবানী। পরিচালক সন্দীপ রেড্ডি ভাঙ্গা ২০১৭ সালে ‘অর্জুন রেড্ডি’ নামক একটি তেলেগু ছবি বানিয়েছিলেন। ‘কবীর সিং’ সেই ছবিরই হুবহু হিন্দি রিমেক। এখান অবধি কম বেশি সকলেরই জানা। কিন্তু যেটা সকলের জানা নেই, সেটা হলো এই, যে এটা প্রায় ১০০ আগের একজন বাঙালী লেখকের একটি কালজয়ী উপন্যাসের সমকালীন অ্যাডাপটেশন। যেই উপন্যাস নিয়ে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় সবথেকে বেশি বার (১৮) ছবি তৈরি হয়েছে। উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রের চেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র আজ পর্যন্ত লেখা হয় নি, আর ভবিষ্যতেও হওয়ার সুযোগ খুবই কম। এতক্ষণে সবাই বুঝে গেছেন যে আমি ‘দেবদাস’-এর কথা বলছি।
আরও পড়ুন, স্বপ্নের দৌড়ে শাহিদ-কিয়ারার ‘কবীর সিং’
ছবিতে কবীর সিং একজন ২৮-২৯ বছর বয়সী ডাক্তার (অর্থোপেডিক সার্জেন)। যে তার প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাওয়ার দরুন মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকে এবং তার ফলস্বরূপ নেশা এবং আত্মহননের পথে চলে যায়। এরপর গল্প নিয়ে আর নতুন করে কিছু বলার থাকে না। কিন্তু বলার থাকে গল্পের প্রেজেন্টেশন আর অ্যাপ্রোচ নিয়ে। ছবির গল্প আর তার প্রেজেন্টেশন অত্যন্ত উগ্র এবং ভুলভাল চিন্তা ভাবনায় ভরা। বিশেষ করে ছবির প্রথম অর্ধে। যেখানে কবীর সিংকে একজন প্রচণ্ড রাগী, ইগোইস্ট, উগ্র পৌরুষে ভরা পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ একটি চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। যে পলিটিকালি ইনকারেক্ট সব কথাবার্তা বলে এবং ভুলভাল কাজ করে।
সে কখনো তার প্রেমিকা প্রীতিকে বলে যে "খারাপ দেখেতে মেয়েরা ভাল বন্ধু হয় না। ভাল দেখতে মেয়েরাই ভাল বন্ধু হয়। ফলে ভাল দেখতে মেয়েদের সাথে মেশো।" আবার কখনো মেয়েটির অনুমতি ছাড়াই তাকে চুমু খেয়ে ফেলে। আবার কখনো প্রেমিকাকে বলে যে "ওড়না ঠিক করো", বা "আমাকে ছাড়া তোমার কোন অস্তিত্ব নেই"। কখনও ছুরি দেখিয়ে একটি মেয়েকে বলে "জামা খোলো"। ছবির অনেকটা অংশ জুড়েই মেয়েটিকে সে ডমিনেট করে এবং মেয়েটিও শিশুর মত সব মেনে নেয়। এবং মেনে নিয়েই তাকে ভালবাসে। যেন তার নিজস্ব কোন চয়েস-ই নেই। যেন এটাই তার ভবিতব্য। এই সময় মনে হয়, "এসব কী হচ্ছে!" এইসব ফালতু জিনিস মাথামুন্ডুহীন তামিল-তেলুগু ছবিতেই চলে। বাস্তবে চলে না।
আরও পড়ুন, বক্সঅফিসে হাফসেঞ্চুরি ‘কবীর’-এর
কিন্তু এই ধারণাটা সম্পূর্ণ পালটে যায় ছবির দ্বিতীয় অর্ধে এসে। যেখানে প্রেমে আঘাত খাওয়া কবীর সিং নিজেকে ধ্বংস করার খেলায় মেতে ওঠে। তখন নিজেকে খুব বোকা মনে হয়। একটি মেয়েকে ভালবেসে একটি ছেলে পাগল হয়ে গেল - এতে আবার তামিল-তেলুগু-বাঙালি-পাঞ্জাবির কী আছে রে বোকা। এটা তো যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর সর্বত্র হয়ে আসছে। ছবির অনেক জায়গায় গল্পে কোন লজিক থাকে না। কেন কবীরের শরীরে এত রাগ, কেন প্রীতির বাবা কবীরকে এতটা অপছন্দ করলেন, কেন কবীরের বাবা দুম করে ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন, কিভাবে প্রবল মাতাল অবস্থায় কবীর অসংখ্য অপারেশন নিখুঁতভাবে করতে পারল, এসব কিছুই স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না।
আবার উল্টোদিকে কবীর যখন তার দাদাকে বলে ওঠে, "প্ল্যান করে বিয়ে, প্ল্যান করে বাচ্চা। এসব কথার মানে কী? এগুলো তো আউট অফ লাভ, আউট অফ ইমোশন হওয়ার কথা", তখন মনে হয়, এই কথাটাই তো প্রকৃত প্রেমিকেরা যুগ যুগ ধরে বলে আসছে। প্রেম কি ইঞ্জিনিয়ারিং নাকি যে প্ল্যান করে করা হবে? তখন মনে হয় লজিকের নিকুচি করেছে।
আরও পড়ুন, এমন লুকে ভিকি কৌশলকে দেখা যায়নি আগে
'দেবদাস' ছিল একজন টিন এজারের অ্যাডোলেসেন্স পিরিয়ডের সমস্যার গল্প। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে পুরুষদের অন্তরে আজীবনই অ্যাডোলেসেন্স পিরিয়ড জীবিত থেকে যায়। ফলে তারা প্রচুর ভুলভাল কাজ আজীবন কাল ধরে করে আসে। এই ছবিতেও সেগুলি করা হয়েছে। এগুলো অবশ্যই খারাপ জিনিস। একে জাস্টিফাই করা যায় না। কিন্তু এই চরিত্রটা এরকমই। অ্যারোগেন্ট কিন্তু ইনোসেন্ট। হিংস্র কিন্তু শিশুর মত সরল। একে ঘৃণা করা যায়, আবার কখনো কখনো ভালোবাসাও যায়। কিন্তু অস্বীকার করা যায় না।
কঠিন বুদ্ধিজীবী ও নারীবাদীরা ছবিটাকে তীব্র আক্রমণ করেছেন। কিন্তু এই ছবি হিট হবেই। কেউ আটকাতে পারবে না। দলে দলে মানুষ ছবিটা দেখছেন এবং দেখবেন। কারণ ছবিতে এমন কিছু আছে যা এক শ্রেণীর পুরুষের আজীবনের আকাঙ্ক্ষা। কাউকে ভালবেসে নিজেকে ধ্বংস করার মধ্যে যে কী বীভৎস মজা আছে সেটা যারা করেছে তারাই জানে। আর যারা করে নি, তাদের হয়ত একদিন রকেট সায়েন্সও বুঝিয়ে দেওয়া যাবে, কিন্তু এই জিনিসটা বোঝানো যাবে না। আর মহিলারাও হয়তো এরকম ছেলেদের পছন্দই করেন। হয়তো তাঁরা ভাবেন, কাউকে ভালবেসে যে ছেলে নিজেকে এইভাবে ধ্বংস করে ফেলছে, সে যদি আমার প্রেমিক হতো তাহলে আমাকে কতটাই না ভালবাসত। হয়তো বললাম। কারণ মহিলারা আদতে ঠিক কী ভাবেন সেটা স্বয়ং ঈশ্বরও জানেন না।
আরও পড়ুন, সাতাশ বসন্ত পেরিয়ে স্মৃতি রোমন্থনে ‘দিওয়ানা’ শাহরুখ
ফলে এই ছবি আপনাকে টানবে। আগুন যেভাবে পতঙ্গকে টানে, মহুয়ার গন্ধ যেভাবে মাতালকে টানে, বাঁশির সুর যেভাবে রাধিকাকে টানত, সেইভাবে এই ছবি আপনাকে টানবে। আমি কী বললাম, কোন বুদ্ধিজীবী কী বললেন, কোন নারীবাদী কী বললেন, সেগুলো নিরর্থক হয়ে যাবে। এই ছবি আপনি দেখেই ছাড়বেন। কারণ দেবদাসের কোনো মার নেই। কোনোদিন পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর আবার যদি নতুন করে মানব সভ্যতার জন্ম হয়, সেদিন প্রথম যে গল্পটা লেখা হবে, সেটা হয়তো দেবদাসই হবে। প্রথম যে ছবিটা তৈরি হবে সেটাও হয়তো দেবদাসই হবে।