গত ৬ অগাস্ট, জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর ব্লগ লিখেছিলেন অরুণ জেটলি। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, "ধড়হীন মুরগির মতই কংগ্রেস ভারতের মানুষের থেকে নিজেদের আরও বিচ্ছিন্ন করছে। নয়া ভারত পাল্টে গিয়েছে। শুধু কংগ্রেস সে কথা বুঝতে পারছে না।"
তাঁর শেষ কয়েকটা ব্লগের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম। জেটলি বেশ কিছুদিন ধরেই বেশ কিছু শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। গত ৯ অগাস্ট তাঁকে এইমসে ভর্তি করা হয়। শনিবার দুপুর গড়ানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন তিনি। তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছেন।
আরও পড়ুন, Live: বিদায় অরুণ জেটলি…আজ নিগমবোধ ঘাটে শেষকৃত্য
গোটা রাজনৈতিক জীবন জুড়েই কংগ্রেসের কট্টর সমালোচক ছিলেন জেটলি। ঠিলেন দারুণ কৌশলী, দুধর্ষ বক্তা, এবং এক প্রশিক্ষিত আইনজীবী। কিন্তু এ সবের চেয়েও তাঁর যে পরিচয় সবচেয়ে বড়, তা হল দলের সমস্যায় তিনি ছিলেন প্রথমসারির সমাধানকারী। নির্বাচনে তার করিশ্মা দেখানোর আগেই বিজেপি-কে দেশজোড়া মানুষের বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী রূপে আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন দিল্লির লুটিয়েন ও তাঁর বিজেপির মধ্যেকার সেতুবন্ধন।
সরকারি কাজে দেশের বাইরে থাকা নরেন্দ্র মদী সেখান থেকেই যোগাযোগ করেছেন জেটলির পরিবারের সঙ্গে। এক টুইটে তিনি লিখেছেন, "জেটলি ভারতকে ভালবাসতেন, মানুষের মধ্যে থাকতে ভালবাসকেন। তিনি লিখেছেন, আমি ভাবতেই পারছি না, আমি এখানে বাহরিনে রয়েছি এবং আমার প্রিয় বন্ধু অরুণ জেটলি আর নেই।"
আরও পড়ুন, ‘মূল্যবান বন্ধু’কে হারিয়ে শোকার্ত মোদী
সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী দুজনেই জেটলির বাড়িতে গিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এসেছেন। সিনিয়র কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেছেন, অরুণ জেটলি ছিলেন প্রত্যেক অবিজেপি ব্যক্তির সেরা বিজেপি ব্যক্তিত্ব।
১৯৮৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপির আসন সংখ্যা নেমে এসেছিল ২-এ। দলের নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী সে সময়ে ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে অরুণ জেটলি ও প্রমোদ মহাজনের নাম উল্লেথ করেছিলেন। আরএসএসের কাছের মানুষ কোনও দিনই ছিলেন না তিনি, বরং তিনি ছিলেন বাজপেয়ী ছাঁচের মধ্যপন্থী নেতা। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি মোদীর কাছের মানুষ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
অন্তর্বর্তী সময়ে, যখন বিজেপি নিজেকে পুনর্গঠিত করছে, তথনও জেটলি বুঝিয়ে দেন দলের কাছে তিনি কতটা প্রয়োজনীয়। অন্যতম সোচ্চার কণ্ঠ বলে পরিচিত জেটলি সর্বদাই দলের রাজনৈতিক ভাবনাকে অকাট্যভাবে তুলে ধরেছেন। দিল্লিতে যখন নেহরু পন্থী সমাজবাদ ও বাম ধর্মনিরপেক্ষতাই মূল স্রোত, তেমন সময়েও সে ভাবনাদের সঙ্গে টক্কর দিয়েছেন তিনি। সাধারণের চোখের অন্তরালে, জেটলি পরিচিত ছিলেন তাঁর দরবারের জন্য, যেখানে তিনি তাঁর আইনি, রাজনৈতিক ও সংবাদমাধ্যমের বন্ধুদের সঙ্গে বিতর্ক উপভোগ করতেন, মাঝে মাঝে নিজের হিউমার ও তাঁর বিশাল ভাণ্ডার থেকে তুলে আনা কাহিনি মিশিয়ে দিতেন সে আড্ডায়।
জেটলি রাজনৈতিক পরিবারের মানুষ না হয়েও, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন তাড়তাড়িই। ১৯৪৭৪ সালে তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। জয়প্রকাশ নারায়ণের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের সামনের সারির যুবনেতা ছিলেন তিনি। জরুরি অবস্থার সময়ে মোট ১৯ মাস জেলে কাটান জেটলি। ১৯৭৭ সালে তিনি দিল্লি এবিভিপি-র প্রেসিডেন্ট ও আরএসএস-এর ছাত্র সংগঠনের জাতীয় সম্পাদক হন।
৮-এর দশকের শেষ দিকে দিল্লিতে কর্মরত আইনজীবী হিসাবে বোফর্স নিয়ে কৌশল তৈরি ও রাজীব গান্ধী সরকারের উৎখাতে বিরোধীদের তিনি সাহায্য করেছিলেন। এ সময়ের স্মৃতি তাঁর কাছে আকর্ষণীয় ছিল। পরবর্তী জনতা দল সরকার গঠিত হয়েছিল বাইরে থেকে বিজেপি ও কমিউনিস্টদের সাহায্যে। সে সরকারে অতি স্বল্প সময়ের জন্য (১৯৮৯-৯০) তিনি অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল হন। সে সময়ে বোফর্স মামলার দায়িত্ব তাঁর হাতে ছিল।
১৯৯১ সালে বিজেপির জাতীয় কার্যকরী সমিতিতে যুক্ত হন জেটলি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই পদে ছিলেন তিনি।
দিল্লির অন্য বিজেপি নেতারা, যথা মদনলাল খুরানা বা ভিকে মালহোত্রা রাজ্য রাজনীতির বাইরে বেরোতে পারেননি কোনওদিন। তার মধ্যে জেটলির উত্থান ছিল ধীর কিন্তু অটল। তবে সুষমা স্বরাজ বা প্রমোদ মহাজনের মত তত তাড়াতাড়ি জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করতে পারেননি তিনি। ১৯৯৮ সালে বাজপেয়ী তাঁর দ্বিতীয় দফায় রাজ্যসভা আসনের জন্য জেটলির উপরে স্থান দিয়েছিলেন এল এম সাংভিকে।
জেটলি রাজ্যসভার আসন পান ২০০০ সালে, সাংভি মন্ত্রী হওয়ার পর। সে সময়ে তাঁর পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন প্রবীণ নেতা এল কে আদবানি। বাজপেয়ী মন্ত্রিসভা থেকে রাম জেঠমালানি সরে যাবার পর আইনমন্ত্রকের দায়িত্বভার তুলে দেওয়া হয় জেটলির হাতে।
এর পর থেকে তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। মোদীর সঙ্গে তাঁর সখ্যের সূচনা সে সময় থেকেই। ২০০২ সালের দাঙ্গায় জেটলি মোদীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, ২০০৭ সালের গুজরাট বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত সঙ্গেই ছিলেন তাঁর, যদিও এ সময়ে বাজপেয়ী ঘনিষ্ঠ বিজেপি অংশ তাঁর উপর চাপ দিয়ে চলছিল।
এই পর্যায়ে মধ্যপ্রদেশের ২০০৩ সালের বিধানসভা ভোটে জয় এবং ২০০৪ সালের কর্নাটক বিধানসভায় বড়সড় জয়ের অন্যতম কারিগর ছিলেন জেটলি। জেডিইউ নেতা নীতিশ কুমারের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব এ সময়ে কাজে লাগে।
২০০৬ সালে প্রমোদ মাহাজনের মৃত্যুর পর জেটলি মহাজনের উপর ন্যস্ত দায়িত্বের সিংহভাগ নিজের কাঁধে তুলে নেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল সাধারণ নির্বাচনে দলের দায়িত্ব। ২০০৯ সালে আদবানি নেতৃত্বাধীন বিজেপির পরাজয়ের পর আঁচ এসে পড়েছিল জেটলির উপরেও। শেষ পর্যন্ত আরএসএস বিষয়টিতে পদক্ষেপ করে। তারা স্থির করে সুষমা স্বরাজ লোকসভায় ও অরুণ জেটলি রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতা হবেন। বিজেপি সভাপতির স্থানে রাজনাথ সিংয়ের জায়গায় নিতিন গড়করিকে নিয়ে আসা হয়।
অন্য অনেকের আগেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নরেন্দ্র মোদী এক উঠতি নক্ষত্রের নাম।
Read the Full Story in English