রাভীক ভট্টাচার্য
গ্রামে একমাত্র তাঁর বাড়িতেই কম্পিউটার ছিল। তাঁর যে এমন পরিণতি হবে, তা বোধহয় টের করতে পারেননি পুরুলিয়ার সুপুরডি এলাকা। বয়স মাত্র ২১, ইতিহাসে অনার্স নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন, রাজনীতিতে ঝোঁক ছিল। এলাকার বিজেপি কর্মী বলে পরিচিত ছিলেন। গত ৩০ মে বাড়ির কাছেই একটি গাছ থেকে মিলল তাঁর ঝুলন্ত দেহ। ত্রিলোচন মাহাতোর মতো তরুণের এহেন অকালমৃত্যুতে হতবাক এলাকাবাসী। শুধু ত্রিলোচনই নয়, পুরুলিয়ার এই যুবকের খুনের ঘটনার রেশ কাটার আগেই মাত্র চারদিনের ব্যবধানে আরও একজনের দেহ উদ্ধার হয়েছে। ত্রিলোচনের মতোই ঝুলন্ত অবস্থায় মিলেছে দুলাল কুমারের দেহ। ত্রিলোচনের মতোই দুলালও একজন বিজেপি কর্মী। গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছিল ত্রিলোচনের দেহ। দুলালের দেহ উদ্ধার হয়েছে হাইটেনশন বিদ্যুতের টাওয়ারে। এই দু’জনের মৃত্যু ঘিরে এই মুহূর্তে উত্তাল গোটা রাজ্য।
ত্রিলোচন ও দুলালকে খুন করা হয়েছে বলে, ইতিমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে। যদিও ৩০ বছর বয়সী দুলাল কুমার আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি করেছে পুলিশ। দুলালের পরিজনরা অবশ্য পুলিশের এহেন দাবি মানতে নারাজ।
ত্রিলোচন বরাবরই সরকারের বিরোধী দলকে সমর্থন করতেন। ২১ বছর বয়সী ওই যুবার সাত বাই পাঁচ ফুট ঘরের মধ্যে এখনও জ্বলজ্বল করছে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর ছবি। কয়েকটা তথ্যের দিকে নজর করা যাক। ত্রিলোচন ও দুলাল, দু’জনের দেহই ঝুলন্ত অবস্থায় মিলেছে। ঘটনাচক্রে দু’জনেই বিজেপি কর্মী বলে পরিচিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, পঞ্চায়েত ভোটের আগে আগেই দু’জনে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বলরামপুর ব্লকে পদ্মবাহিনী সাতটি গ্রাম পঞ্চায়েত সংসদ জিতেছে। ২০টির মধ্যে পঞ্চায়েতের ১৭টি আসন দখল করেছে গেরুয়াবাহিনী, দখল করেছে দুটি জেলা পরিষদও।
চলতি বছরের মার্চ মাসে পুরুলিয়ায় প্রথমবার ঘটা করে রামনবমীর আয়োজন করেছিল বজরং দল। এই সময়েই বিজেপির সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল ত্রিলোচনের নাম। পরিবারের লোকেরা তাঁকে বিদ্রোহী তকমা দিয়েছিলেন। পরিবার সূত্রে জানা গেছে, সিপিএমের আমলে ত্রিলোচন কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন। পরে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর পড়াশোনাতে মন দিয়েছিলেন ত্রিলোচন, একইসঙ্গে ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা শুরু করেছিলেন সে, যা রমরম করে চলছিল। বজরং দলের রামনবমীর মিছিলের পরই ত্রিলোচনের মতো বহু তরুণই পঞ্চায়েত ভোটের প্রাক্কালে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। বুথ সুরক্ষা কমিটির প্রধান করা হয়েছিল ত্রিলোচনকে।
পঞ্চায়েত ভোটের সময় বলরামপুর এলাকায় তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে বিক্ষিপ্ত অশান্তি হলেও, সুপুরডি এলাকায়, সেরকম কোনও ঘটনা ঘটেনি।
বিজেপিতে যোগ দেওয়াতেই ত্রিলোচনকে খুন করা হয়েছে, একথা ত্রিলোচনের মৃতদেহের গায়ের টি-শার্টে লেখা ছিল। শুধু টি-শার্টে লেখাই নয়, এ সংক্রান্ত একটি পোস্টার জাতীয় কাগজও উদ্ধার হয়েছিল মৃতদেহের পাশ থেকে। দুলাল কুমারকে খুন করার তত্ত্বে এখনও সিলমোহর না দিলেও, ত্রিলোচনকে যে খুন করা হয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। তবে ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরেই ত্রিলোচন খুন হয়েছেন বলে দাবি করেছে পুলিশ। তৎকালীন পুলিশ সুপার জয় বিশ্বাস এ ব্যাপারে বিশদে জানাতে চাননি। অন্যদিকে পুরুলিয়ার নতুন পুলিশ সুপার আকাশ মাঘারিয়াও এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন।
গোটা ঘটনা পুলিশ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেছেন ত্রিলোচনের বাবা হরিরাম মাহাত। তিনি বলেন, ‘‘ওর কোনও শত্রু ছিল না। তৃণমূলের লোকজন ওকে হুমকি দিয়েছিল।’’ বিজেপির জয় উপলক্ষে গ্রামে যে উৎসব হয়েছিল, তার আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন ত্রিলোচন। সেটা অনেকেই পছন্দ করেনি বলে জানিয়েছেন ত্রিলোচনের বাবা।
যেদিন ত্রিলোচন নিখোঁজ হন, সে দিন রাত ৮টা ১৫ মিনিট নাগাদ, ত্রিলোচন তাঁকে ফোন করেছিলেন বলে দাবি করেছেন ভাই শিবনাথ। তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে বলে ফোনে ভাইকে জানিয়েছিলেন ত্রিলোচন, এমনটাই দাবি শিবনাথের।
আরও পড়ুন, Purulia: বলরামপুরে ফের মৃত্যু বিজেপি কর্মীর, উঠল সিবিআই তদন্তের দাবী
ত্রিলোচনের উপর অনেক আশা ছিল পরিবারের। ৫৮ বছর বয়সী ত্রিলোচনের বাবা হরিরাম বলে গেলেন, ‘‘বলরামপুর বাজারে আমার একটি দোকান রয়েছে। পড়াশোনা ছেড়ে আমার দুই ছেলে কাজের জন্য ভিনরাজ্যে গিয়েছে। যা রোজগার করেছিলাম, তার সবটাই ওর জন্য খরচ করেছিলাম, ভেবেছিলাম, ত্রিলোচন হয়তো পড়াশোনা করে কিছু একটা করবে।’’
পরীক্ষার জন্য কিছু নথি ফটোকপি করতে সাইকেলে করে বলরামপুর গিয়েছিলেন ত্রিলোচন। সেদিন সন্ধে থেকেই নিখোঁজ হয়ে যান ত্রিলোচন। তাঁকে কয়েকজন লোক টেনে হিঁচড়ে জঙ্গলে নিয়ে গিয়েছে বলে ভাইকে জানিয়েছিলেন ত্রিলোচন।
ত্রিলোচনের মতোই আরেক নিহত দুলাল কুমারের বাড়িতেও শোকের ছায়া। স্বামীর মৃত্যুতে তিন সন্তানকে নিয়ে কার্যত দিশেহারা স্ত্রী মণিকা। গত ২ জুন দুলালের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। আত্মঘাতী হয়েছেন দুলাল, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট তুলে ধরে একথা দাবি করেছেন পুলিশ সুপার আকাশ মাঘারিয়া। তবে পুলিশের আত্মহত্যার তত্ত্ব মানতে পারছেন না পরিজনরা। দুলালের পরিজন ও গ্রামবাসীদের বক্তব্য, দুলাল আত্মহত্যা করতে পারেন না। বাড়িতে কোনও সমস্যা ছিল না, আর্থিক দিক থেকেও কোনও অসুবিধে ছিল না, তাহলে কেন আত্মহত্যা করবেন তাঁর স্বামী? পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন দুলালের স্ত্রী। তাঁর অভিযোগ, পুলিশ মিথ্যে কথা বলছে। তৃণমূল কর্মীরা তাঁর স্বামীকে শাসিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন, SP Transferred: পুরুলিয়ার জোড়া রহস্যমৃত্যুর জেরে এসপি বদল
ত্রিলোচনের খুনের প্রতিবাদে গত ১ জুন বিজেপির থানা ঘেরাও কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন দুলাল। ওই দিনই দুলাল নিখোঁজ হন বলে অভিযোগ পরিবারের সদস্যদের। দুলাল রাজনীতি নিয়ে খুব সক্রিয় ছিলেন, তাই তাঁকে টার্গেট করা হয়েছে বলে মনে করছেন দুলালের আত্মীয় দীনবন্ধু কুমার। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত তৃণমূল কর্মীকে পুলিশ নিয়ে গেলেও কাউকে এখনও এ ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়নি বলে দাবি তাঁর।
অন্যদিকে পুরুলিয়ায় এই জোড়া মৃত্যুতে তৃণমূলের যোগ কার্যত অস্বীকার করেছেন দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। রবিবার পার্থ বলেন, ‘‘ময়নাতদন্তের রিপোর্টে পরিষ্কার বলা রয়েছে দুলাল আত্মঘাতী হয়েছেন। খুনের অভিযোগ করে বিজেপি অশান্তি করতে চাইছে।’’
বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসু বলেন, ‘‘সিবিআইকে তদন্তভার দিতে হবে, না হলে আমরা আদালতে যাব।’’
অনুলিখন: সৌরদীপ সামন্ত