Advertisment

শিবসেনার সঙ্গে জোট বাঁচাতে কেন মরিয়া বিজেপি

মোদীর আগে পর্যন্ত গেরুয়াবাহিনীর হাতে একজনই হিন্দু হৃদয় সম্রাট ছিলেন, তিনি বাল ঠাকরে। ২০১২ সালে ঠাকরের মৃত্যুর পরে এবং বিজেপির সম্প্রসারণের জেরে প্রাসঙ্গিকতা হারাতে থাকে শিবসেনা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
shiv-sena-bjp

২০১৪ সালে শিবসেনা-বিজেপি জোটের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উদ্ধব ঠাকরে (এক্সপ্রেস আর্কাইভ)

বারবার শিবসেনার কাছে অপমানিত হয়েও কেন জোট ছাড়তে চাইছে না বিজেপি?

Advertisment

আর কোনও উপায় নেই, তাই। উত্তর প্রদেশে সপা-বসপার ঘনিষ্ঠতার ফলে পরিস্থিতির পরিবর্তনের জেরে বিজেপি এখন অন্তত একটি রাজ্য চাইছে, যার মাধ্যমে কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলে রাখা সম্ভব। উত্তর প্রদেশে ৮০টি লোকসভা আসন রয়েছে। যে কোনও হিসেবেই এ রাজ্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে মহারাষ্ট্রের আসন সংখ্যা ৪৮, উত্তর প্রদেশের তুলনায় ঢের পিছনে। উত্তর প্রদেশে দলের অবশ্যম্ভাবী নিম্নগামিতার কথা মাথায় রাখলে মহারাষ্ট্র বিজেপি-র পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ২০১৪ সালে শরিক আপনা দলকে সঙ্গে নিয়ে উত্তর প্রদেশে ৮০টির মধ্যে ৭৩টি আসন জিতেছিল বিজেপি। বিজেপি-র পক্ষে সে রাজ্যে আর ভাল কিছু করা সম্ভব নয়। লোকসভা উপনির্বাচনে কৈরানা, ফুলপুর এবং গোরখপুরে পরাজয়ের পর উত্তর প্রদেশে এনডিএ-র আসন সংখ্যা এখন ৭০-এ দাঁড়িয়েছে।

শুধু সংখ্যার জন্যেই বিজেপিকে এখন নিজেদের অন্যতম প্রাচীন সঙ্গী শিবসেনার সঙ্গে সেঁটে থাকতে হবে। ২০১৪-র ভোটে রাজ্যের ৪৮টি আসনের মধ্যে ৪১টিতে জিতেছিল গেরুয়াবাহিনী, তার মধ্যে শিবসেনা পেয়েছিল ১৮টি আসন। তার চেয়েও জরুরি সংখ্যাতত্ত্ব হলো, শিবসেনা পেয়েছিল ২০.৮২ শতাংশ ভোট আর বিজেপি পেয়েছিল ২৭ শতাংশ। সেনা ও বিজেপি যদি আলাদা ভাবে ভোটে লড়ে, তাহলে নিঃসন্দেহেই বেশি ক্ষতি হবে শিবসেনার, কিন্তু ক্ষতির মুখে পড়বে বিজেপি-ও। ২০১৪ সালে ১৮.২৯ শতাংশ ভোট পাওয়া কংগ্রেস এবং ১৬.১২ শতাংশ ভোট পাওয়া এনসিপি ইতিমধ্যেই জোট গড়ে ফেলেছে। এ অবস্থায় বিজেপি সে ধাক্কা সামলাতে পারবে না।

অর্থাৎ কেন্দ্রের ক্ষমতাশালী বিজেপি আত্মসমর্পণ করছে একটা স্থানীয়, আপাত গুরুত্বহীন দলের কাছে?

ব্যাপারটা এত সরলও নয়। শিবসেনার এই দোলনা-রাজনীতির সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা বিজেপি-র প্রতি শিবসেনার সাম্প্রতিক আচরণে কিছুমাত্র অবাক হবেন না। জোট ভাঙা তাদের উদ্দেশ্য নয়। বিজেপি নেতৃত্ব, সে মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ হোন কী দলের সভাপতি অমিত শাহ - সকলেই শিবসেনার সীমাবদ্ধতার কথা জানেন। ফলে তাঁরা শিবসেনার সমালোচনা বা অভিযোগকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। এই জোট অসম বিবাহের এক দুর্ধর্ষ উদাহরণ, যেখানে দু পক্ষই আলাদা হওয়ার চাইতে যন্ত্রণাদায়ক ভাবে টিকে থাকতে পছন্দ করে, যা আরও যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠছে দুপক্ষের কাছেই।

আরও পড়ুন, রাফাল বিতর্কের মধ্যেই রাহুল-পারিকর সাক্ষাৎ

মহারাষ্ট্রে শিবসেনা জমি হারাল কেন?

মহারাষ্ট্রে রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে শিবসেনা নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখার চেষ্টা করছে। মুম্বইয়ে ভিনরাজ্য থেকে আগত মানুষের ঢলের মাঝে 'মারাঠি মানুস'-দের রক্ষা করার ডাক দিয়ে জন্ম হয়েছিল শিবসেনার। যতদিন পর্যন্ত শিবসেনা সে মিশনে সৎ ছিল এবং সে ডাক অর্থবহ ছিল, ততদিন তা কার্যকর ছিল। এদেরই সংগঠন স্থানীয় লোকাধিকার সমিতির সৌজন্যে মারাঠি যুবকেরা বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ পেয়েছে, কাজ পেয়েছে বড় শিল্পোদ্যোগে, এমনকি সরাকির চাকরিতেও ঢুকে পড়েছে তারা। এর ফলে মারাঠি পরিবারে সংগঠনের জনপ্রিয়তা বেড়েছে, মারাঠি যুবকরা ছয় ও সাত-এর দশকে শিবসেনায় যুক্ত হয়েছেন বহু মারাঠি যুবক।

পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে ১৯৮২ সালে মুম্বইয়ে মিল ধর্মঘটের পরে। মিল মালিকরা, যাঁরা ছিলেন মূলত গুজরাটি ও মাড়োয়ারি, বাল ঠাকরেকে ব্যবহার করেন শ্রমিক নেতা দত্ত সামন্তকে অকেজো করার জন্য। এই ধর্মঘটের ফলে মুম্বইয়ের চেহারা বদলে যায়, বদলে যায় শিবসেনার রাজনৈতিক চেহারাও। মিলের মারাঠি কর্মীরা দলে দলে কাজ ছেড়ে দিয়ে নিজেদের এলাকায় চলে যান। এর সঙ্গে ছিল রিয়েল এস্টেট সেক্টরে সস্তা শ্রমিক হিসেবে মূলত উত্তর ভারতীয়দের যোগদান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিবসেনা মারাঠিদের মধ্যে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে, যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায় মুম্বইয়ে।

পরিস্থিতির মোকাবিলা কীভাবে করল শিবসেনা?

শিবসেনা ঝাঁপিয়ে পড়ল হিন্দুত্ব ব্রিগেডে। আট-এর দশকে জাতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি হিন্দুত্বের রাজনীতির সূচনা করল। সে সময়ে তারা একটি আঞ্চলিক দলকে চাইছিল সহযোগী হিসেবে। প্রমোদ মহাজনের কৌশলী নেতৃত্বে শিবসেনাকে পাশে পেয়ে যায় তারা। হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডা সামনে রেখে রামজন্মভূমি আন্দোলনকে খোলাখুলি সমর্থন করল শিবসেনা, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কৃতিত্ব তারাই নেয়। ১৯৯৫ সালে বিধানসভা ভোটে প্রথমবার কংগ্রেসকে হারায় তারা। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তারাই ক্ষমতায় ছিল, প্রথমে মনোহর জোশী এবং পরে নারায়ণ রাণেকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বহাল রেখে। ১৯৯৯ সালে রাজ্যে ভোট হয় লোকসভা ভোটের সঙ্গেই।

যেহতু কেন্দ্রে বিজেপি বড় দাদা, সে কারণে রাজ্যে মোট ১৭১টি আসনে নিজেরা প্রার্থী দেয় শিবসেনা, ১১৭টি ছেড়ে দেয় বিজেপি-কে। সে জোট ভোটে হেরে যায়। কিন্তু জোট টিকে যায়। সে ব্যাপারে ভূমিকা ছিল অটল বিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবাণী এবং অবশ্যই প্রমোদ মহাজনের, যাঁর সঙ্গে তুখোড় সম্পর্ক ছিল বাল ঠাকরের। ২০০৪ সালেও সেই ১১৭-১৭১ হিসেব বজায় রেখে ভোটে লড়ে জোট, কিন্তু ফের হেরে যায় তারা। কেন্দ্রে পরাজয় হয় এনডিএ সরকারেরও।

আরও পড়ুন, আমরাই দাদা ছিলাম, আছি, থাকব: বিজেপি-র সঙ্গে জোট নিয়ে শিবসেনা

সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করল কবে থেকে?

নরেন্দ্র মোদীর উত্থানই পার্থক্য গড়ে দিল। মোদীর আগে পর্যন্ত গেরুয়াবাহিনীর হাতে একজনই হিন্দু হৃদয় সম্রাট ছিলেন, তিনি বাল ঠাকরে। ২০১২ সালে ঠাকরের মৃত্যুর পরে এবং বিজেপির সম্প্রসারণের জেরে প্রাসঙ্গিকতা হারাতে থাকে শিবসেনা। নয়া বিজেপি নেতৃত্ব বুঝিয়ে দেন, যে তাঁরা কোনও ভাগাভাগি বা বোঝাপড়ায় বিশ্বাসী নন - তাঁদের স্লোগান - শত শতাংশ বিজেপি সেনাকে নাড়িয়ে দেয়। তারা দেখে, বিজেপি বাড়ছে, শিবসেনা কমছে। এই নিরাপত্তাহীনতাই শিবসেনাকে ক্রমশ ঠেলে দেয় যুদ্ধের আড়ম্বরের শব্দসংকেতের জগতে।

কিন্তু শিবসেনা বিজেপির সঙ্গে জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে না কেন?

সেনা যদি জোট ছাড়ে তাহলে ভাগাভাগি হবে দুভাবে। একটি অংশকে দখল করে নেবে বিজেপি, অন্যদিকে কংগ্রেস ও এনসিপি ঝাঁপাবে একটি অংশের দিকে। শিবসেনার সামনে খুব বেশি বিকল্প খোলা নেই - ফলে বিজেপি-র সঙ্গে তাদের জোট থাকবে। অন্তত যতদিন না পর্যন্ত ক্ষয়ের নিয়মে তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

bjp shiv sena General Election 2019
Advertisment