রঞ্জি ট্রফির গ্রুপলিগের খেলা শেষ। কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে বিদর্ভ, সৌরাষ্ট্র, কর্নাটকের মত দলগুলি। অনেক আশা জাগিয়ে শুরু করেও শেষ আটে যেতে ব্যর্থ হল বাংলা। প্রায় সত্তর বছর পর এই প্রথম দিল্লি, মুম্বাই, বাংলা এবং তামিলনাড়ুর মধ্যে একটি দলও রঞ্জি ট্রফির নক আউট পর্বে জায়গা করে নিতে পারেনি।
বি গ্রুপে বাংলার অভিযান শুরু হয় অপেক্ষাকৃত দুর্বল হিমাচল প্রদেশের বিরুদ্ধে ছোট্ট শহর নাদৌনের অটল বিহারী বাজপেয়ী স্টেডিয়ামে। বাংলা টসে জিতে ব্যাটিং নেয় এবং কেউ ব্যক্তিগতভাবে তেমন বড় রান না করলেও দলগতভাবে ৩৮০ রানে প্রথম ইনিংস শেষ করে। বাংলার বোলাররাও টিমগেমের পরিচয় দেন। প্রদীপ্ত প্রামানিকের চার উইকেট ছাড়া অশোক দিন্দা, ঈশান পোড়েল এবং আমির গনি দুটি করে উইকেট নেন। প্রদীপ্ত গোটা রঞ্জিই ভালো খেলেছেন এবং মাত্র পাঁচ ম্যাচেই ২৫.২৬ গড়ে ১৯ উইকেট তুলে নিয়েছেন। প্রথম ইনিংসের লিডের সঙ্গে সঙ্গে ৩ পয়েন্ট তুলে নিয়ে বাংলা শেষ দিন ব্যাটিং করে কাটিয়ে দেয়। নজর কাড়েন বাংলার দুই ওপেনার অভিষেক রমন এবং অভিমন্যু ঈশ্বরণ।
আরও পড়ুন, রঞ্জিতে ঐতিহাসিক ব্লান্ডার, শূন্য রানে ছয় উইকেট
লিগের দ্বিতীয় খেলায় নিজেদের ঘরের মাঠ ইডেন গার্ডেন্সে মধ্য প্রদেশের বিরুদ্ধে রানের পাহাড় গড়ে বাংলা। তরুণ কৌশিক ঘোষের শতরান এবং ঈশ্বরণের ৮৬ রানের পর অধিনায়ক মনোজের ২০১ রানে ভর করে বাংলার রান ৫০০ পার হয়। দিন্দা তুলে নেন চারটি উইকেটে। কিন্তু মধ্য প্রদেশকে ফলো অন করালেও দ্বিতীয় ইনিংসে প্রায় সত্তর ওভারে তাদের মাত্র তিনটে উইকেট ফেলতে সক্ষম হয় বাংলার বোলাররা। মধ্যপ্রদেশের হয়ে আর্য্যমান বিড়লা এবং শুভম শর্মা শতরান করেন। ম্যাচ ড্র হয় এবং বাংলাকে ৩ পয়েন্ট নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
এই অবধি তবু ম্যাচ ড্র করে কিছু পয়েন্ট কুড়োতে সক্ষম হয়েছিল বাংলা। কিন্তু তৃতীয় খেলাতেই নেমে আসে বিপর্যয়। কেরালার বিরুদ্ধে ধরাশায়ী হয় বাংলা। ফাস্ট বোলিং সহায়ক পিচে বাংলার টিমে অশোক দিন্দা, মহম্মদ শামি, ঈশান পোড়েল এবং মুকেশ কুমার, চার ফাস্ট বোলার থাকলেও ভারতীয়-এ দলের হয়ে ঈশ্বরণ খেলতে চলে যাওয়ায় দলের ব্যালেন্স অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। উপরন্তু শামি খেললেও ভারতীয় বোর্ডের নির্দেশ ছিল শামিকে দিয়ে প্রতি ইনিংসে পনেরো ওভারের বেশী বল করানো যাবে না। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে বাংলা প্রথম ইনিংসে ১৪৭ রানের বেশী করতে পারেনি। পিচের যথার্থ সদব্যবহার করে কেরালার তিন ফাস্ট বোলার সন্দীপ ওরিয়ার, বাসিল থাম্পি এবং মাত্তাকান্ডাথিল নিধেশ মিলে ৯ উইকেট তুলে নেন। জলজ সাক্সেনার অসাধারণ শতরানে ভর দিয়ে ১৪৪ রানের লিড নেয় কেরালা। দ্বিতীয় ইনিংসে আবার সন্দীপ ওরিয়ারের ৫ উইকেট বাংলার ইনিংস শেষ করে দেয় ১৮৪ রানে এবং মাত্র ১ উইকেট এর বিনিময়ে জয়ের রান তুলে নেয় কেরালার তরুণ ব্রিগেড।
এর পরের ম্যাচেই আবারও ছন্দে ফেরে বাংলা, উত্তেজনাপূর্ণ জয় ছিনিয়ে নেয় তামিলনাড়ুর তরুণ দলের থেকে। অবশ্য প্রথম ইনিংসের পর ৭৪ রানে এগিয়ে ছিল তামিলনাড়ু এবং মনে হচ্ছিল এই খেলাতেও হয়ত বাংলাকে খালি হাতে ফিরতে হবে। কিন্তু ঋত্বিক চ্যাটার্জীর দারুণ বোলিং খেলায় ফিরিয়ে আনে বাংলাকে। ২১৬ রানের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামে বাংলা। শুরুটা ভালো করলেও মাঝে পরপর উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায় তারা। শেষ পর্যন্ত সুদীপ আর প্রদীপ্তর ব্যাটে ভর দিয়ে মাত্র এক উইকেটে জিতে ছ পয়েন্ট তুলে নেয় বাংলা। তবে এই ম্যাচে দুই ইনিংসেই ধারাবাহিকতার পরিচয় দেন অভিষেক কুমার রামণ, প্রথম ইনিংসে একমাত্র তিনিই ২০ রানের গণ্ডি পার করে ৯৮ রান করেন এবং দ্বিতীয় ইনিংসে করেন ৫৩ রান।
চেন্নাই থেকে হায়দরাবাদ পৌঁছয় বাংলা এবং ঈশ্বরণ দলে ফিরেই করেন চোখ ধাঁধানো ১৮৬ রান। কিন্তু দলের পরবর্তী সর্বোচ্চ ছিল সুদীপ এবং অনুষ্টুপের ৩২। বাংলা ৩৩৬ রান করলেও প্রথম ইনিংসের লিডের দরুন ৩ পয়েন্টের বেশী পায়নি এই ম্যাচে।
এর পরের খেলায় বিশাখাপত্তনামে অন্ধ্র প্রদেশের বিরুদ্ধে তিন পয়েন্টের বদলে মাত্র এক পয়েন্ট নিয়েই খুশি হতে হয় বাংলাকে। বাংলার ওপেনাররা ব্যর্থ হলে মনোজ (৯০) এবং ঋত্বিক(৭৬) বাংলার স্কোর ৩০০ অবধি নিয়ে যান। কিন্তু অন্ধ্রের অপেক্ষাকৃত অনভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের সামনে বল হাতে ব্যর্থ হন বাংলার বোলাররা এবং দ্বিতীয় ইনিংসে চেষ্টা সত্ত্বেও শেষ অবধি ম্যাচের ফল আশানুরূপ দিকে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয় বাংলা।
ছটি ম্যাচের শেষে বাংলার পয়েন্ট ছিল ১৬। এবছরের নিয়ম অনুযায়ী গ্রুপ এ এবং বি থেকে মোট পাঁচটি দল যেতে পারত এবং সেই দলগুলির মধ্যে থাকতে হলে পরবর্তী ম্যাচগুলিতে জয়ী হওয়া বাংলার জন্য অবশ্যম্ভাবী ছিল।
মনোজদের পরবর্তী প্রতিপক্ষ ছিল দিল্লি। ইডেনের ফাস্ট বোলিং সহায়ক পিচে আবারও প্রথম ইনিংসে পিছিয়ে পড়েছিল বাংলা। কিন্তু ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে ৩২২ রানের লক্ষ্য নিয়ে এযাবৎ কেরিয়ারের সেরা ব্যাটিং করেন অভিমন্যু ঈশ্বরণ। প্রথমে অন্য ওপেনার অভিষেকের সঙ্গে ১২১ রানের পার্টনারশিপের পর চতুর্থ উইকেটে অভিজ্ঞ অনুষ্টুপের সঙ্গে যোগ করেন ১৮৬ রান এবং দলকে এনে দেন এক অবিস্মরণীয় জয়। নিজে অপরাজিত থাকেন ১৮৩ রানে, অনুষ্টুপের সংগ্রহে ছিল অপরাজিত ৬৯ রান। বাংলার ক্রিকেট ইতিহাসে এটাই তাদের চতুর্থ ইনিংসে সবচেয়ে বড় রান তাড়া করে জয়।
নতুন বছরে এই অসমান্য জয় বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে নতুন উৎসাহের সৃষ্টি করে। গ্রুপের শেষ ম্যাচে প্রতিপক্ষ ছিল যুবরাজ সিং, আনমোলপ্রিত সিং, শুভমান গিলের পাঞ্জাব। নক আউটে যাওয়ার সামান্যতম সম্ভাবনা তৈরীর জন্য দুই দলেরই প্রয়োজন ছিল সরাসরি জয় এবং অন্তত ছ পয়েন্ট। কলকাতায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সল্টলেক ক্যাম্পাসের মাঠে টসে জিতে ব্যাটিং নেয় বাংলা। কিন্তু পাঞ্জাবের তরুণ বাঁহাতি স্পিনার বিনয় চৌধুরীর ছ উইকেটের দাপটে মাত্র ১৮৭ রানে গুটিয়ে যায় বাংলা এবং সেখানেই কার্যত শেষ হয়ে যায় বাংলার নক আউটে যাওয়ার আশা। আনমোলপ্রিতের শতরান এবং শুভমানের ৯১ পাঞ্জাবকে দেয় ২৬০ রানের লিড। দ্বিতীয় ইনিংসে আবার ফর্মে ফেরেন অভিমন্যু। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজের প্রথম দ্বিশতরানে ভর দিয়ে বাংলার পরাজয় রোধ করেন। যোগ্য সংগত করেন অধিনায়ক মনোজ তিওয়ারি (১০৫)। চতুর্থ দিনের শেষবেলায়, মাত্র ১৬ ওভারে পাঞ্জাবের জন্য ১৭৩ রানের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন মনোজ কিন্তু মনপ্রিত গণির ২৮ বলে ৫৮ রানের পরেও শেষ অবধি ম্যাচ অমীমাংসিত ভাবেই শেষ হয়। পাঞ্জাবের ৩ পয়েন্ট ও বাংলার ১ পয়েন্টের পর দুই দলই ২৩ পয়েন্ট পেয়ে শেষ করে এবং শেষ পর্যন্ত বি গ্রুপ থেকে শুধু কেরালা কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছয়।
এই মরশুমে বাংলা দলের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা নিঃসন্দেহে অভিমন্যু ঈশ্বরণ। মাত্র ছটি ম্যাচ খেলে ৯৫.৬৬ গড়ে ৮৬১ রান করেন অভিমন্যু। এগারো ইনিংসের মধ্যে ছ ইনিংসে পঞ্চাশের গন্ডি পার করেছেন তিনি। তাঁর এই পারফর্মেন্স সামনের ভারতীয়-এ খেলাগুলিতে তাঁর জায়গা নিশ্চিত করবে এবং টেস্টক্যাপের দিকে তাঁকে নিয়ে যাবে।
অন্যদিকে হতাশাজনক পারফর্মেন্সের কথা বললে বলতে হয় সুদীপ চ্যাটার্জির কথা। মাত্র ২৭.২৮ গড়ে ৩৮২ রান করেছেন সুদীপ। গোটা মরশুমে একটাও শতরান নেই, সর্বোচ্চ মাত্র ৫৬। দুই মরশুম আগে নিজের খেলার জোরে সবার নজর কেড়ে নিয়েছিলেন সুদীপ কিন্তু এই মরশুমে একেবারেই ছন্দে ছিলেন না তিনি।
আরও পড়ুন, রাহুল-পাণ্ডিয়ার বদলি শুভমান গিল ও বিজয় শংকর
দলের অভিজ্ঞ খেলোয়াড় মনোজ এবং অশোক দিন্দা নিজের খেলা ধরে রেখেছেন। একদিকে ৫১.৩৩ গড়ে ৬১৬ রান করে দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান-সংগ্রাহক ছিলেন মনোজ। অন্যদিকে ২৬.৮২ গড়ে ২৮ উইকেট নিয়ে এবছরও দলের সর্বোচ্চ উইকেট-শিকারী হিসেবে শেষ করেচেন দিন্দা। তার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে নিজের চারশতম উইকেট তুলে নিয়েছেন এ বছর। মুকেশ কুমার এবং ঈশাণ পোড়েলের মত তরুণ ফাস্ট বোলারদের যথাযথ গাইড করে তৈরী করে নেওয়ার দায়িত্ব রয়েছে দিন্দার কাঁধে। স্পিন বিভাগে প্রদীপ্ত নজর কাড়লেও আমির গনির কাছে প্রত্যাশা আরো বেশী ছিল বাংলার ফ্যানেদের।
সব মিলিয়ে এই মরশুমেও শেষ অবধি বাংলার ফ্যানদের হাতে রইল ‘কী হলে কী হতে পারত’র গল্প। আবার পরের মরশুমে আশায় বুক বাঁধবেন বাংলার ক্রিকেটপ্রেমিকরা। অনূর্ধ্ব ২৩ সি কে নাইডু ট্রফিতে কিন্তু বাংলার পারফর্মেন্স বেশ চোখে পড়ার মত। আশা করা যায় ফাস্ট বোলার অনন্ত সাহা বা লেগ স্পিনার প্রয়াস রায় বর্মনের মত তরুণেরা আগামী মরশুমে বাংলাকে নতুন সাফল্যের পথে নিয়ে যাবেন।