দুর্নীতির ফুটেজ থাকে থাক, মিলে গেল বিসিসিআই-এর ক্লিন চিট

অডিওতে শোনা যাচ্ছে, অবিকল আক্রমের কণ্ঠস্বরের কেউ রাহুলের কাছে হোটেল রুমে যৌনকর্মী পৌঁছে দেওয়ার দাবি করছেন, যার বদলে রাহুলকে অনূর্ধ্ব-২৩ দলে সুযোগ দেওয়া হবে।

অডিওতে শোনা যাচ্ছে, অবিকল আক্রমের কণ্ঠস্বরের কেউ রাহুলের কাছে হোটেল রুমে যৌনকর্মী পৌঁছে দেওয়ার দাবি করছেন, যার বদলে রাহুলকে অনূর্ধ্ব-২৩ দলে সুযোগ দেওয়া হবে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

গত ৬ নভেম্বর লখনৌয়ের একানা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সদ্যসমাপ্ত সিরিজের দ্বিতীয় টুয়েন্টি টুয়েন্টি ম্যাচ খেলতে নামে ভারত এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ। খেলা শুরুর আগে দুই দলের অধিনায়ক রোহিত শর্মা ও কার্লোস ব্রেথওয়েট মাঠে নামেন রাজ্যপাল রাম নায়েকের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে করে নিয়ে এলেন যে প্রাক্তন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের কর্মচারী, তাঁকে নিয়েই আপাতত উঠছে হাজার রকমের প্রশ্ন।

Advertisment

এবছরের ১ জুলাই লখনৌয়ের এক হিন্দী সংবাদ চ্যানেল একটি স্টিং অপারেশন করে, যার কেন্দ্রে ছিলেন আক্রম সাইফি, আইপিএলের চেয়ারম্যান এবং কংগ্রেস নেতা রাজীব শুক্লার ব্যক্তিগত সহায়ক। স্টিং অপারেশনের ভিডিওতে আক্রমকে বলতে শোনা যাচ্ছে, কোনও খেলোয়াড়কে উত্তর প্রদেশের অনূর্ধ্ব-২৩ ক্রিকেট দলে নির্বাচিত হতে গেলে অাক্রমকে টাকা দিতে হবে এবং যৌনকর্মী জোগাড় করে দিতে হবে।

ভিডিওটি প্রকাশ্যে আসার চার মাসের মধ্যে ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিআই) তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ তদন্তের ভিত্তিতে আক্রমের বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ খণ্ডন করে তাঁকে 'ক্লিন চিট' দেয়, যার ফলস্বরূপ আরও একবার গলায় 'অল অ্যাক্সেস' পাস ঝুলিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন আক্রম।

আরও পড়ুন: ‘যৌনকর্মী এনে দাও, খেলতে দেব’, বললেন আইপিএল কর্তার সহকারী

Advertisment

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের তদন্ত কিন্তু অন্য কথা বলছে। আক্রমকে দেওয়া ক্লিন চিট যে বিসিসিআই-এর নিজেরই দুর্নীতি দমন নীতির, এবং একাধিক ক্রিকেটার ও প্রাক্তন সহকর্মীর বয়ানের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, তা মোটামুটি স্পষ্ট। গত একমাসে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিকরা আক্রমের ঘাঁটি সাহারানপুর সরেজমিনে পরিদর্শন করে বহু ক্রিকেটার এবং আধিকারিকদর সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, আক্রম আজও উত্তর প্রদেশে ক্রিকেট নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমান প্রভাবশালী, সৌজন্যে রাজীব শুক্লার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। শুক্লা একদা উত্তর প্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের (ইউপিসিএ) সম্পাদক এবং বর্তমানে তার একজন ডাইরেক্টর, কিন্তু রাজ্যের ক্রিকেট আধিকারিক ও খেলোয়াড়দের কথা অনুযায়ী, তিনিই এখনও 'বস'।

গত দুই দশকে উত্তর প্রদেশ ভারতীয় ক্রিকেটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাজ্যের অন্তত আটজন ক্রিকেটার - মহম্মদ কাইফ, সুরেশ রায়না, আর পি সিং, প্রবীণ কুমার, পীযূষ চাওলা, কুলদীপ যাদব, ভুবনেশ্বর কুমার এবং সুদীপ ত্যাগী - ভারতের হয়ে খেলেছেন, এবং অগুনতি খেলোয়াড় অনূর্ধ্ব-১৯ দলে জায়গা করে নিয়েছেন।

আক্রমের ক্ষেত্রে বিসিসিআই-এর তদন্তের মূলে ছিল স্টিং অপারেশনে তোলা ভিডিও, যেটিতে আক্রমের সঙ্গে তরুণ ক্রিকেটার রাহুল শর্মার কথোপকথন রেকর্ড করা হয়েছে। অডিওতে শোনা যাচ্ছে, অবিকল আক্রমের কণ্ঠস্বরের কেউ রাহুলের কাছে হোটেল রুমে যৌনকর্মী পৌঁছে দেওয়ার দাবি করছেন, যার বদলে রাহুলকে অনূর্ধ্ব-২৩ দলে সুযোগ দেওয়া হবে। বিসিসিআই-এর দুর্নীতি দমন ইউনিট এই টেপের কপি চায় ওই চ্যানেলের কাছে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরেই আইপিএল ম্যানেজার হিসেবে আক্রম পদত্যাগ করার পর তদন্ত বন্ধ করে দেয় বিসিসিআই। "সাইফি নিজেই পদত্যাগ করাতে আমরা আর তদন্ত করি নি," বলেন দুর্নীতি দমন ইউনিটের প্রধান অজিত সিং শেখাওয়াত। কিন্তু বিসিসিআই নিয়মাবলীর ৩২ নম্বর নিয়ম অনুযায়ী, যে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখবেন একজন কমিশনার, যাঁকে ১৫ দিনের মধ্যে তাঁর রিপোর্ট জমা দিতে হবে।

আরও পড়ুন: #MeToo: বিসিসিআই কে চিঠি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের

তাঁকে প্রশ্ন করা হলে বিসিসিআই-এর পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সুপ্রিম কোর্ট মনোনীত তত্ত্বাবধায়ক কমিটির চেয়ারম্যান বিনোদ রাই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, "সাইফি কোনোকালেই বিসিসিআই-এর কর্মচারী ছিলেন না, স্রেফ আইপিএল চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহায়ক ছিলেন। কাজেই চেয়ারম্যান তাঁকে বরখাস্ত করার পর তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তের প্রশ্ন ওঠে না।"

তত্ত্বাবধায়ক কমিটির এক সূত্র অনুযায়ী, এক্ষেত্রে কমিটির কিছু করার নেই। "পরিস্থিতিটা একটু গোলমেলে। আমরা কোনো স্টেট অ্যাসোসিয়েশনের কাজে হস্তক্ষেপ করতে চাই না, এমনিতেই লোধা কমিশনের সুপারিশ নিয়ে দম ফেলার সময় নেই আমাদের।"

কিন্তু বিসিসিআই ব্যাপারটাকে কার্যত চাপা দিয়ে দিলেও ভারতীয় ক্রিকেট জগৎ তা হতে দেয়নি। টুইটারে ক্ষোভ প্রকাশ করে ভারতীয় দলের প্রাক্তন সদস্য এবং উত্তর প্রদেশের প্রাক্তন অধিনায়ক মহম্মদ কাইফ লেখেন, "ইউপি ক্রিকেটে দুর্নীতির পরিমাণ দেখে বিরাট ধাক্কা খেলাম। তরুণ প্রতিভাকে নষ্ট করে দিচ্ছে কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত এজেন্ট। আশা করব রাজীব শুক্লাজি যোগ্য তদন্তের মাধ্যমে তরুণ প্রতিভাদের বিচার এনে দেবেন এবং ইউপি ক্রিকেটে স্বচ্ছতা ফেরাবেন। যারা শোষিত, তাদের সবার পাশে আছি।"

চাপের মুখে ইউপিসিএ তাদের ন্যায়পালকে আক্রমের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বলে। আড়াই মাস পরে ইউপিসিএ মনোনীত ন্যায়পাল অবসরপ্রাপ্ত জাস্টিস সি কে প্রসাদ আক্রমকে সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন। "আমার মতে সমস্ত অভিযোগ অসত্য, অবিশ্বাস্য, এবং বাতিল যোগ্য," গতমাসে জমা দেওয়া তাঁর রিপোর্টে বলেছেন একদা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক এবং বর্তমানে প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান প্রসাদ।

উল্লেখ্য, ইউপিসিএ-র ন্যায়পাল হিসেবে প্রসাদকে ২০১৬ সালে মনোনীত করেন আক্রমের 'বস' শুক্লা, যিনি তখন অ্যাসোসিয়েশনের সর্বময় কর্তা। তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে শুক্লা বলেন, "অভিযোগকারীকে ডাকা হয়, নির্বাচকদের ডাকা হয়, অভিযুক্তকে ডাকা হয়। সবাইকে ডাকা হয়। সমস্ত প্রক্রিয়া মেনে। জাস্টিস প্রসাদ অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির মানুষ। তদন্তের স্বার্থে সবাইকে দু তিনবার করে ডেকেছেন।"

তদন্ত চলাকালীন জাস্টিস প্রসাদ জেরা করেন রাহুল শর্মাকে, যিনি আক্রমের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ তুলে নেন, বর্তমানে ইউপিসিএ সম্পাদক এবং শুক্লার অনুগামী যুধবীর সিংকে, এবং তিনজন নির্বাচককে। কিন্তু স্টিং অপারেশনে উঠে আসা বেশ কিছু নাম উপেক্ষা করেন তিনি। এঁদের মধ্যে রয়েছেন অনুরাগ মিশ্র, যিনি উন্নাওতে একটি ক্রিকেট অ্যাকাডেমি চালান, এবং যাঁকে ইউপিসিএ-র নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখার জন্য আক্রম হুমকি দেন বলে খবর। আরও একজন যাঁকে ডাকা হয় নি তিনি হলেন মনোজ মুদগল। স্টিং অপারেশনের ভিডিওতে শোনা যাচ্ছে আক্রম রাহুলকে বলছেন, যে রাহুলের নির্বাচনের সম্ভাবনা নষ্ট করে দিয়েছেন মুদগল।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে জাস্টিস প্রসাদ বলেন, "আপনারা রিপোর্ট দেখেছেন। আমার আর কিছু যোগ বা বিয়োগ করার নেই।"

পরিশেষে, আক্রম সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, কিন্তু স্বীকার করেছেন তিনি শুক্লার অধীনে কাজ করেন। "সব খতম হো গয়া...স্যার (শুক্লা) কে সাথ হুঁ, স্যার কা অ্যাসিস্ট্যান্ট রহুঙ্গা। মেরা ইউপি ক্রিকেট সে কোই লেনা-দেনা নহি হ্যায় (সব চুকে গেছে...স্যারের সঙ্গে আছি, তাঁর সহকারী হয়ে থাকব। ইউপি ক্রিকেটের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই আমার)।"

cricket IPL 2018