মহম্মদ শামি আজ ভারতীয় বোলিং অ্য়াটাকের অন্যতম স্তম্ভ। জসপ্রীত বুমরা, ভুবনেশ্বর কুমার ও শামিকে নিয়েই বিরাট কোহলির পেস ব্রিগেড। বিশ্বকাপ দেখেছে এক নতুন শামিকে। উত্তরপ্রদেশের বছর ২৯-এর পেসার স্বপ্নের ফর্মে রয়েছেন এই টুর্নামেন্টে। অথচ শেষ একটা বছর শামির ব্য়ক্তিগত জীবনে বয়ে গিয়েছে ঝড়।
গত বছরের মার্চে শামির বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ এনেছিলেন তাঁর স্ত্রী হাসিন জাহান। শামির বিরুদ্ধে ব্যাভিচার, গার্হস্থ্য হিংসা, ধর্ষণ এবং ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ এনেছিলেন তিনি। এমনকী চলতি বছর মার্চেও শামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছিল কলকাতা পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৮ এ (পণ সংক্রান্ত ইস্যুতে হেনস্থা) এবং ৩৫৪ এ (যৌন নির্যাতন) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছিল। হাসিন জাহান প্রায়ই শামির বিরুদ্ধে তোপ দাগেন।
আরও পড়ুন: ক্ষুব্ধ কোহলির চড়া মেজাজের সামনে শামি, ‘গালিগালাজ’ প্রকাশ্যে
দেখতে গেলে বিশ্বকাপে স্মরণীয় প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছেন মহম্মদ শামি। চোট ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্মৃতি পেরিয়ে বল হাতে নিয়ম করে ঝলসে উঠছেন ভারতীয় পেসার। আফগানিস্তানের পরে শামির আগুনে স্পেলে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে স্ত্রী হাসিন জাহানের চোখে মহম্মদ শামি সেই বখাটেই রয়ে গিয়েছেন। বিশ্বকাপের মাঝেই হাসিন ফেসবুক পোস্ট করে জানিয়েছিলেন যে, শামি টিকটকে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। তিনি ৯৭জনকে ফলো করছেন এবং তাঁর মধ্যে ৯০ জনই মেয়ে। হাসিন অবাক হয়ে যান যে, এক মেয়ের বাবা হয়েও শামি কী করে এসব করেছেন।
উত্তরপ্রদেশের আমরোহায় বেড়ে উঠেছেন শামি। সেখানকারই গ্রাম সাহসপুর আলিনগরে থাকতেন তিনি। সেখান থেকেই আজকের শামির পথ চলা শুরু। এখন এই গ্রামেই প্রায়ই ক্রাইম ব্রাঞ্চের অফিসার আর রিপোর্টারদের আনাগোনা লেগেই থাকে। এখানে তাঁর অন-ফিল্ড পারফরম্য়ান্সের চেয়েও কথা বেশি হয় অফ-ফিল্ড কার্যকলাপ নিয়ে। গ্রামবাসীদের কেউ বলেই ফেলেন, "ছেলেটার ক্রিকেট নিয়ে একটা পাগালামি ছিল। আর আজ নিজের বদনাম করছে।"
বিশ্বকাপের প্রথম চার ম্য়াচ রিজার্ভ বেঞ্চে ছিলেন শামি। ভুবনেশ্বর কুমারের জন্য় দলে সুযোগ পাননি তিনি। ভুবি চোট পাওয়ায় শিঁকে ছেঁড়ে শামির। চার বছর আগের বিশ্বকাপে ১৭টি উইকেট নেন তিনি। এই বিশ্বকাপে তাঁর ১৪টি উইকেট নেওয়া হয়ে গিয়েছে। এর মধ্য়ে রয়েছে একটি হ্য়াটট্রিকও। চেতন শর্মার পর দ্বিতীয় ভারতীয় বোলার হিসেবে শামি বিশ্বকাপে হ্য়াটট্রিকের নজির গড়েন। শামির গ্রাম সাহসপুর এখন শামির নামেই পরিচিত। আমরোহা আরা মোরাদাবাদের মাঝামাঝি একটা জায়গা। ৯ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে পৌঁছে যাওয়া সবুজের সমারোহে ঘিরে থাকা এই ছোট্ট গ্রামে। চারপাশে রয়েছে আঁখ আর গমের ক্ষেত। এই গ্রাম ক্রিকেট ভালবাসে। কিন্তু দুপুরের ভাতঘুমের চেয়ে বেশি নয়, ফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ-ভারত ম্য়াচের দিন এখানে কোনও রেডিও-র আওয়াজও পাওয়া যায়নি। ৫০০০ মানুষের বাস সাহাসপুরে।
আরও পড়ুন: মাঠে শামির দুঃসময়ে গ্য়ালারিতে গালে হাত! তরুণীর পরিচয় চমকে দেওয়ার মতো
শামিরা তিন ভাই। তিনি মেজো। তার ওপরে রয়েছেন হাসিব, নিচে কাইফ। শামির প্রয়াত বাবা তৌসিফ আহমেদ কখনই সেভাবে ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে পাঠাতে পারেননি সন্তানদের। ট্রাকটর সারাইয়ের দোকানে কাজ করতেন তৌসিফ। সিমেন্ট দিয়েই একটি পিচ বানিয়ে দিয়েছিলেন ছেলেদের ক্রিকেট খেলার জন্য়। কিডনি-তে স্টোনের জন্য় হাসিব ক্রিকেটটা চালিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু শামির ভাই কাইফ সে কলকাতায় ক্রিকেট খেলেন। ২৩ বছর বয়য়। বিশ্ববিদ্য়ালয় পর্যায়ে খেলেন তিনি। শামির বাবা দু'বছর আগে প্রয়াত হন। বাবার প্রসঙ্গে কাইফ বলছেন যে, তাঁর বাবাও ছিলেন মিডিয়াম পেসার। প্রকৃত পিচ তৈরি করে দিতে না-পারার আক্ষেপ ছিল তাঁর। ফলে নিজেই একটা পিচ বানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু শুধু সন্তানদের জন্য় নয়। সকলকেই সেখানে খেলার সুযোগ দেন তিন। চাইতেন এই গ্রাম থেকে কেউ অন্তত ভারতের হয়ে খেলুক। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে সকলের বোলিং দেখতেন। কাইফ আরও বলেছেন যে, শামি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বল করতে পারতেন। একমাত্র বল জঙ্গলে চলে গেলে বা ঝোপ-ঝাড়ে আটকে গেলেই তারা ব্রেক পেতেন।
শামিরা যখন ক্রিকেট খেলতেন তখন কেউ ভাল পারফর্ম করে পয়সা পেতেন না। কিন্তু শামি সবসময় ম্য়াচের বলটা নিয়ে যেতেন। শামির প্রথম কোচ ছিলেন বদরুদ্দিন সিদ্দিকি। ২০০৫ সালে মোরাদাবাদে তাঁর অ্যাকাডেমিতে আসেন শামি। ২০০১৬ সালে উত্তর প্রদেশের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ ট্রায়ালে গিয়েছিলেন তিনি। সিদ্দিকি বলছেন শামির মধ্য়ে ফাস্টবোলার হওয়ার সব রসদই ছিল। তাঁর পা আর রানআপ ছিল দুর্দান্ত ৩০ মিনিট বল করলেও একই ভাবে বল করতেন। প্রথম বলের তুলনায় শেষ ডেলিভারি তাঁর দ্রুত হত।
শামি ছোট থেকেই একটু গা এলিয়ে নিতে ভালবাসতেন। এমনকী দোকানের ছোট্ট এক সোফায় গা এলিয়ে ভুজিয় খেতে পছন্দ করতেন তিনি। এমনকী ইশান্ত শর্মাও ইউটিউব শো 'ব্রেকফাস্ট উইথ চ্যাম্পিয়ন'-এ এসে বলেছিলেন যে, শামি পাবজি খেলতে ভালবাসেন। খাওয়ারের মধ্য়ে বিরিয়ানি, পাঁঠার মাংস, নল্লি নিহারি খেতে ভালবাসেন। বোলিং করে খাইয়ে দাইয়ে তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে দিলে তাঁর আর কিছু লাগে না! কিন্তু ছোট থেকে শামি খেতে ভালবাসলেও, এসব খাবার থেকে নিজেকে দূরে রেখেই বোলার হিসেবে প্রস্তুত করেছিলেন।
Read full story in English