প্যারা অলিম্পিকের ইতিহাসে নজির গড়ল ভারত। পদক তালিকায় এবার নয়া ইতিহাস ভারতীয়দের। ইতিমধ্যেই কয়েকদিন আগেই পদক তালিকায় ভারত নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রদর্শন করে ফেলেছিল। যত দিন গড়িয়েছে, পদকের সংখ্যা আরও বেড়েছে। টোকিও অলিম্পিকে ভারত ইতিহাস তৈরি করেছে কয়েকদিন আগেই।
পদক তালিকায় ২৫তম স্থান অর্জন করে প্যারালিম্পিক ২০২০-তেও একইভাবে ভারত ইতিহাস তৈরি করল। ভারত ফিরছে ১৯ টি পদক জয় করে। এখনও পর্যন্ত প্যারালিম্পিকের ইতিহাসে এটাই ভারতের সেরা প্রদর্শন। পদক তালিকায় রয়েছে ৫ টি সোনা, ৮ টি রুপো এবং ৬ টি ব্রোঞ্জ। পদক তালিকায় ২৪তম স্থান অর্জন করে প্যারালিম্পিক ২০২০ তেও এভাবে ভারত ইতিহাস তৈরি করল। ভারত ফিরছে ১৯ টি পদক নিয়ে। টোকিও প্যারালিম্পিকের শেষ পর্যায়ে প্যারা ব্যাডমিন্টনে পুরুষদের সিঙ্গলসে ফের সোনা জিতেছে ভারত।
আরও পড়ুন: ভারতেই এবার অলিম্পিকের আসর! সেরার সেরা ইভেন্ট আয়োজনে দেশ কতটা তৈরি
এবার দেশকে সোনা এনে দিলেন কৃষ্ণ নাগর। ফাইনালে তাঁর জয় ভারতকে পঞ্চম স্বর্ণপদক এনে দেয়। অলিম্পিকের আসরে নীরজ চোপড়ার সোনা জয়ের স্মৃতিকে উস্কে দিয়ে কৃষ্ণ নাগরের সোনা জয়ের দৌলতে ভারত এবারের প্যারালিম্পিকে সামগ্রিকভাবে ১৯ টি পদক জয়ে করে পদক তালিকায় ২৪ তম স্থান অর্জন করে।
ভারতীয়রা শেষবার রিও অলিম্পিকে ১৯ জন অংশ নিয়ে ৪ টি পদক পায়। এবার ভারতীয় দলে ছিল ৫৪ জন। তাদের কাছ থেকে কিছুটা প্রত্যাশা থাকলেও, এত ভালো ফল হবে সেটা ছিল ধারনার বাইরে। তাই তাদের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। টুইট করে এবারের প্যারালিম্পিকে পদকজয়ীদের শুভেচ্ছা জানান তিনি। সেই সঙ্গে তিনি বলেছেন, “এটা ভারতের সার্বিক খেলাধুলা বিকাশের মানপত্র।"
আরও পড়ুন: বনগাঁর তনয় এবার টি২০ বিশ্বকাপে! রোহিত-কোহলিদের সামনেই অগ্নিপরীক্ষা দিনমজুরের ছেলের
তবে প্যারালিম্পিকের আসরে দেশের সার্বিক পদক জয়ের পিছনে উন্নত ট্রেনিং, আধুনিক প্রশিক্ষণ, সহ বিভিন্ন ফ্যাক্টর কাজ করেছে। ২৩ বছর বয়সী জ্যাভেলিন থ্রোয়ার সুমিত আন্তিল তিনটি বিশ্বরেকর্ড ভেঙে এবারের প্যারালিম্পিকের আসরে সোনা জয় করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর কথায়, “আমার প্রশিক্ষণ এবং খেলাধুলার টেকনিক অলিম্পিকের মঞ্চে সোনাজয়ী নীরজের থেকে খুব আলাদা ছিল না।"
তিনি আরও বলেছেন, “২০১৮ সালে নীরজ চোপড়ার মত প্রথম সারির অ্যাথালিটদের সঙ্গে ফিনল্যান্ডে বেশ কয়েকজন প্যারা এথলিটদের সঙ্গে প্রশিক্ষনের সুযোগ পেয়েছিলাম। যা আমাদের মানসিক বিকাশে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেছিল। আমি গত তিন বছরে ইতালি, ফ্রান্স, তিউনিসিয়ায় প্রতিযোগিতা করার সুযোগ পেয়েছি এবং গেমসে প্রতিযোগিতার অভিজ্ঞতা আমার ক্ষেত্রে অনেক কাজে এসেছিল। এই সব অভিজ্ঞতা আমার ২০২৪ সালের প্যারা অলিম্পিকের আসরেও কাজে আসবে।"
আরও পড়ুন: জুভেন্তাস-রোনাল্ডো বিচ্ছেদ! কেরিয়ারের শেষবেলার মহাতারকাকে নিয়ে ঝুঁকিই নিল ইউনাইটেড
আন্তিল সাই এবং এনজিও গো স্পোর্টস ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সাত লক্ষ টাকার প্রস্থেটিক ব্লেড, যন্ত্রপাতি এবং বায়োমেকানিক্স সাপোর্ট, সহ খেলাধুলার যাবতীয় সরঞ্জাম পেয়েছেন। এর জন্য তিনি বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়েছেন সাই এবং গো স্পোর্টস ফাউন্ডেশনকে।
এবারের প্যারা অলিম্পিক মঞ্চে রৌপ্য পদক জয়ী যোগেশ কাঠুনিয়ার কথায়, “সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও সরকার এখন প্যারা-অ্যাথলিটদের সাফল্যের জন্য তাদের নগদ পুরস্কার এবং চাকরির ক্ষেত্রে সাধারণ ক্রীড়াবিদদের মতোই দেখছে। এটি আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে।"
নীরজ চোপড়ার মত আন্তিলও সোনা জয়ের পর হরিয়ানা সরকারের কাছ থেকে নগদ ৬ কোটি টাকা পুরস্কার জেতেন। তাছাড়া ৫৪ সদস্যের পুরো ভারতীয় দল, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান টার্গেট অলিম্পিক পডিয়াম স্কিমের (টপস) অংশ ছিল। কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী এই বছর লোকসভায় দাঁড়িয়ে বলেছেন, “২০১৮-২০১৯ সাল থেকে ২০২১-২০২২ সাল পর্যন্ত সরকার প্যারা-স্পোর্টসে প্রায় ৮.২ কোটি টাকা ব্যয় করেছেন।"
আরো পড়ুন: ইউরোর সেরা দলে বাদ রোনাল্ডো! বাছাই দল নিয়েই উঠে গেল প্ৰশ্ন
এছাড়াও প্রত্যেক প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের পিছনে সরকারের তরফ থেকে ব্যাক্তিগত ভাবেও খরচ করা হয়েছে। স্বর্ণ ও ব্রোঞ্জ পদক বিজয়ী শুটার অবনী লেখারার বাড়িতে তার খেলাধুলার উন্নতির জন্য সম্পূর্ণ সরকারী উদ্যোগে কম্পিউটারাইজড ডিজিটাল বেসড গেমস সামগ্রী ইন্সটলেশন করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে টোকিও প্যারালিম্পিক্সে ভারতীয় টেবিল টেনিস প্লেয়ার ভাবিনা প্যাটেল তার অনুশীলনের সুবিধার জন্য সরকারি উদ্যোগে আপডেট করা "অনুশীলন অংশীদার" রোবট পেয়েছিলেন যা গত বছর লকডাউনের সময় তাকে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেছিল।
ভাবিনা প্যাটেল চতুর্থ শ্রেণিভুক্ত প্যারা অ্যাথলিট। এই শ্রেণির অ্যাথলিটরা সঠিকভাবে বসতে পারেন এবং দুটো হাতই সমানভাবে চালাতে পারেন। শুধুমাত্র শিরদাঁড়ার নীচের দিকে কিংবা সেরিব্রাল পলসিতে তাঁরা আক্রান্ত হন। প্রশিক্ষণের ফল স্বরূপ প্যারালিম্পিকের ফাইনালে পৌঁছে রুপো নিশ্চিত করেন ভারতীয় টেবিল টেনিস প্লেয়ার ভাবিনা প্যাটেল। সেমিফাইনালে চিনের ঝাং মিয়াওকে ক্লাস ফোরের ম্যাচে ৩-২ এ পরাস্ত করেন ভাবিনা। রাউন্ডে তাঁর স্কোর ছিল ৭-১১, ১১-৭, ১১-৪, ৯-১১, ১১-৮। এর আগে বিশ্বের পাঁচ নম্বরে থাকা সার্বিয়ার বরিস্লাভা পেরিচ রানকোভিচকে তিনি পরাস্ত করেছিলেন। মাত্র ১৮ মিনিটে ১১-৫, ১১-৬, ১১-৭ এ পরাস্ত করেন তিনি। সেমিফাইনালে প্রথম পর্যায়ে পিছিয়ে যান ভাবিনা।
এরপর দুরন্ত প্রত্যাবর্তন করে পরপর দুটো স্ট্রেট গেমে এগিয়ে যান তিনি। এতেই চাপে পড়ে যান চিনা প্রতিপক্ষ। চতুর্থ গেম জিতে ব্যবধান ২-২ করেন ঝাং মিয়াও। শেষ গেমে ১১-৮ এ হারিয়ে ইতিহাস তৈরি করলেন ভাবিনা। পদক জয়ের পর তিনি বলেছেন, “চিনা প্রতিপক্ষ থাকলেই জোরদার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। আমি চিনা তারকাকে হারিয়ে প্রমান করেছি ‘আমিও পারি’। তাঁরাও মানুষ, আমরাও মানুষ। সুতরাং অসাধ্য বলে কিছু হয়না।"
সরকারী এবং বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ এব্যাপারে বিশেষ কাজে এসেছে। ২০০৮ সাল থাকে প্যারা ক্রিরাবিদদের সঙ্গে কাজ করে চলেছে গো স্পোর্টস ফাউন্ডেশন। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী ১৯ জন অ্যাথালিটের মধ্যে ১১ জনকে হাতে কলমে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করে গো স্পোর্টস ফাউন্ডেশন। সরকারী তরফে তাঁদের দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন বিশেষ পর্যবেক্ষক।
গো স্পোর্টস ফাউন্ডেশনের তরফে এক আধিকারিক দীপ্তি বোপাইয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, “সরকারের তরফে ফোনে সব সময় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হত। কার কী সুবিধা আসুবিধা সব বিষয়েই সরকারের তরফে সতর্ক নজর ছিল। অবনির জন্য সরকার বিদেশে নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছিল। সেই প্রশিক্ষণে যাতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে তা দেখার দায়িত্ব ছিল আমাদের ওপর।" তিনি আরও বলেছেন সুমিতের ওপর আমাদের তরফে বিশেষ ব্যাবস্থা নেওয়া হয়েছিল। অবনীর প্রশিক্ষনের জন্যও আমাদের তরফে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল।"
প্যারা-ব্যাডমিন্টনের প্রধান কোচ গৌরভ খান্না লখনউতে প্রশিক্ষনের সুবিধা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, "আগে আমাদের খেলার জন্য টাইম স্লট বুক করতে হতো, কিন্তু এখন আমাদের সমস্ত সুবিধা এবং আধুনিকতম খেলাধুলার সরঞ্জাম পেশাদার একাডেমি রয়েছে। আমরা নিজেদের ইচ্ছামত অনুশীলনের সময় নির্ধারণ করতে পারি। তারপরে জিম, বাষ্প স্নান, বরফ স্নান, হাইড্রোথেরাপি … পেশাদার ক্রীড়াবিদ হিসাবে যা যা প্রয়োজন সবই রয়েছে এখানে।"
গান্ধীনগরের এসএআই ক্যাম্পাস এবং ইন্দোরের টেবিল টেনিস সেন্টারের মতো সুবিধাগুলিও প্যারা-অ্যাথলিটদের জন্য সাজিয়ে তোলা হয়েছে, কোচিং পদ্ধতি বছরের পর বছর পরিবর্তিত হয়েছে। এখন খেলাধুলার পথ আরও মসৃণ। ২০১৫ সালে প্রায় ৭০০ প্যারা-অ্যাথলেটিক্স প্রশিক্ষনের সুবিধা পেয়েছিল, ২০১৯ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাড়ায় ১৮০০।
টেবিল টেনিস তারকা প্যাটেল বলেন, “আগে মানুষ প্যারালিম্পিকের বিষয়ে কোনও ধারণাই ছিল না। তবে এই সম্পর্কে এখন সকলেই ওয়াকিবহাল। এখনও এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে মানুষ মনে করে, ‘ইয়ে বেচারে হ্যায়'। সেই ধারনাকে বদলাতে হবে। হাম বেচারে নাহিন হ্যায় (আমরা অসহায় নই)। আমরা কী অর্জন করেছি তা দেখুন। আমাদের প্যারালিম্পিয়ানরা অলিম্পিয়ানদের চেয়ে বেশি পদক এনেছে। এবং আরও অনেক কিছু আছে যা আমরা এখনও অর্জন করতে পারি।”
প্রসঙ্গত, টোকিও অলিম্পিকে ভারত পদক তালিকায় ৪৮তম স্থান অর্জন করেছে, যার মধ্যে নীরজ চোপড়ার সোনার পদক সহ সর্বকালের সেরা সাতটি পদক রয়েছে। তিনবারের প্যারালিম্পিক পদকজয়ী দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া বলেছেন, "আমরা এখন আরও উন্নতি করতে পারি। কারণ পদক কেবল অ্যাথলেটিক্স, শুটিং, ব্যাডমিন্টন এবং টেবিল টেনিসে এসেছে। কিন্তু টোকিও আমাদের জন্য আগামী দিনের দিশা দিয়ে গেল।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন