বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে সাগর পারের পর্যটন নগরী কক্সবাজার। এটি বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, টানা ১৫৫ কিলোমিটার (৯৬ মাইল) এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এই সমুদ্রপাড় থেকে একইসঙ্গে বিস্ময়কর সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়, যা এই বঙ্গোপসাগরের বালুকাভূমিকে দিয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য। প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের নাম এখন বিশ্ব পর্যটনের ভূচিত্রে খুবই উজ্জ্বল নক্ষত্র।
আরো বিস্ময়কর এই যে, এই কক্সবাজার জেলাতেই হাজার হাজার বছর ধরে বাস করছেন ভিন্ন ভাষাভাষী রাখাইন জাতিগোষ্ঠী, যাদের রয়েছে অতি সমৃদ্ধশালী সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ইতিহাস, ঐতিহ্য।
আরও পড়ুন, আমাদের পহেলা বৈশাখ: বাংলাদেশ থেকে বলছি
কিন্তু বরাবরই এই আদি বাসিন্দারা থেকে গেছেন অনেকটা যেন লোকচক্ষুর আড়ালে, মূলধারার উন্নয়ন ও জীবনপ্রবাহ থেকে বেশ খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়েই। তাঁদের ওপর গবেষণা হয়েছে কিছু, কিন্তু রাখাইন আনন্দ-বেদনা, লুঠ হয়ে যাওয়া ব্যবসা-বাণিজ্য, বিলুপ্ত বয়নশিল্প বা লেখ্যভাষার দুরবস্থা নিয়ে লেখালেখি ও তথ্য-সাংবাদিকতা হয়েছে খুব কমই।
জীবন ও জীবিকার তাগিদে অতি নিভৃতে প্রতি বছর কমছে রাখাইন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা (দেখুন: রাখাইনরা কেন দেশ ছেড়ে যান, মুক্তমনা ব্লগ, লেখক)।
‘‘জনসংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে, সাংগ্রেং উৎসব বা ওয়াটার ফেস্টিভ্যালের জন্য বলতে গেলে তেমন জায়গা নেই।’’ (ছবি- বিপ্লব রহমান)
আদিবাসী ফোরামের পরিসংখ্যান মতে, কক্সবাজার, পটুয়াখালি ও বরগুনা জেলায় রাখাইন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আনুমানিক প্রায় ৫০ হাজার। তবে অধুনা ডিজিটাল বাংলাদেশেও ভাষাগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু রাখাইন জাতিগোষ্ঠী নানা নিপীড়ন-নিষ্পেষণের মধ্যেও আপ্রাণ চেষ্টায় ধরে রাখতে চাইছেন নিজ বৈশিষ্ট্য, লোকজ সংস্কৃতি, ও ঐতিহ্য।
আরও পড়ুন, রমনার বটমূল কেঁপে উঠেছিল বিস্ফোরণে
সম্প্রতি সরেজমিনে রাখাইনদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব ‘সাংগ্রাং’-এ দেখা গেছে এরই খণ্ড চিত্র।
রাখাইন নেতার কথোপকথনে সাংগ্রাং
কক্সবাজারের রাখাইন জনগোষ্ঠীর নেতা, আদিবাসী ফোরামের অন্যতম সংগঠক মং থেন হ্লা’র কাছে জানতে চেয়েছিলান রাখাইন বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসব সাংগ্রেং বা সাংগ্রেইয়ের আদ্যোপান্ত।
তরুণ এই নেতা যা বললেন, তা আলাপচারিতায় অনেকটা এরকম:
“সাংগ্রাং--রাইখাইন বর্ষকে বরণ করে নেওয়ার জন্য রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর সামাজিক উৎসব। আমরা এটি শুরু করি সকলে মিলে বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে, চন্দন, সুগন্ধি, গাছ-গাছড়ার সুবাসিত পানি ইত্যাদি দিয়ে বুদ্ধমূর্তিকে স্নান করানোর মধ্য দিয়ে। এটি সাধারণত এপ্রিল মাসের ১২-১৩ তারিখ পালন করা হয়। এটি সাধারণত এপ্রিল মাসের ১২-১৩ তারিখে পালন করা হয়। ১৪-১৫ এপ্রিল, পঞ্জিকা অনুযায়ী রাখাইন বছরের শেষ দিন মন্দিরে গিয়ে আমরা নানা আচার পালন করি। এলাকায় রাখাইন ঐতিহ্য অনুযায়ী বিভিন্ন পদের মিষ্টি খাবার রান্না করা হয়। নুডলস জাতীয় খাবার, বিন্নি চাল দিয়ে ‘বিনিভাত’ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। এসব রাখাইন আত্মীয়-স্বজনকে দেওয়া হয়।’’
‘‘উচ্চশিক্ষিত রাখাইন তরুণ-তরুণী ও শিশু-কিশোররা সর্বত্রই খুব স্মার্ট’’ (ছবি- বিপ্লব রহমান)
“সাধারণত এপ্রিলের ১৭ তারিখ হলো রাখাইন নববর্ষের প্রথম দিন। এদিনকে ঘিরে আমরা পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট প্যান্ডেল করি। ওয়াটার ফেস্টিভাল বাজল উৎসব বা পানি খেলার জন্য তরুণ-তরুণীরা একই রঙের কাপড় পরেন। মেয়েদের সাথে পানি খেলার জন্য ছেলেরা দল বেঁধে যান। পানি খেলার মধ্যে ছেলেমেয়েরা যখন পানি ছিটিয়ে উৎসব করেন, তখন তাঁদের মধ্যে একে অপরকে জানার সুযোগ হয়, বন্ধুত্ব, বোনের সম্পর্ক, ভাইয়ের সম্পর্ক ইত্যাদি তৈরি হয়।”
আরও পড়ুন, সংবাদ জগতের একাল-সেকাল
“এভাবে (সাধারণত) এপ্রিলের ১৭, ১৮, ১৯ তারিখ আমরা সাংগ্রেং বা পানি খেলা উৎসব পালন করি। আর ২০ তারিখ আমরা আবার বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে প্রদীপজ্বালিয়ে পুরনো বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নিই।”
জানতে চেয়েছিলাম, মং এর ছোটবেলার সাংগ্রেং-এর পর কয়েক প্রজন্ম পেরিয়েছে। তো, এখনকার সাংগ্রেং-এর সঙ্গে সেই সময়ের সাংগ্রেং-এর কোনোপার্থক্য? জবাবে রাখাইন নেতা যা বলেন, তা সত্যিই বেদনাদায়ক।
তিনি বলেন, “আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, কক্সবাজারে জনসংখ্যা কম ছিল, সব জায়গায় আমরা ঘুরে বেড়াতে পারতাম। কিন্তু এখন জনসংখ্যা এতো বেড়ে গেছে যে, সাংগ্রেং উৎসব বা ওয়াটার ফেস্টিভালের জন্য বলতে গেলে তেমন জায়গা নেই। এ কারণে দিন দিন উন্মুক্ত পরিবেশে চলাচল বা উৎসব করা সীমিত হয়ে যাচ্ছে।”
মিয়ানমার থেকে আসা অন্তত ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর কেমন প্রভাব পড়েছে কক্সবাজারের আদি জনগোষ্ঠী রাখাইন জীবনে?
এমন প্রশ্নের জবাবে মং থমকে যান। একটু দম নিয়ে আবারও বলতে থাকেন:
“রোহিঙ্গারা আসার পর আমাদের নিত্য চলাচল, বাজারঘাট করা ইত্যাদি কমে গেছে। যারা উখিয়া-টেকনাফের দিকে আছেন (মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চল), তাঁদের চলাচল করতে গেলে কিন্তু হিসেব করে বের হতে হয়, কখন কী হয়, কেউ জানে না!”...
আরও পড়ুন, উত্তর সত্য, সাংবাদিকতা এবং আমরা
“এত কিছুর পরেও বৃহত্তর কক্সবাজারে কিন্তু সাংগ্রেং উৎসব হচ্ছে। কক্সবাজার সদরের টেকপাড়া, চালবাজার, মাছবাজার, ক্যাংপাড়া...এর বাইরে মহেশখালি, চৌফলদণ্ডী, হারবাং, টেকনাফ, রামু, বালিছড়া এসব জায়গাতে সাংগ্রেং হচ্ছে। এর বাইরে বরিশাল, কুয়াকাটা (পটুয়াখালি) ও বরগুনায় রাইখাইন এলাকায় সাংগ্রেং হচ্ছে বলে আমরা জেনেছি। তবে শুধু সীমান্ত এলাকাগুলোতে নিরাপত্তাহীনতা আছে।”
ঝটিকা সাংগ্রেং, বিস্মৃত রাখাইন রাজ্য...
কক্সবাজারের সদর এলাকার বিভিন্ন সাংগ্রেং প্যান্ডেল ঘুরে ঘুরে দেখি। সেখানে উচ্চস্বরে চলছে রাখাইন ভাষায় লাইভ কনসার্ট। সুর ও বাদ্য জানায়, খুব সম্ভব হেভি মেটালিকা (ছবি- বিপ্লব রহমান)
এই কথোপকথনের পর আমরা কক্সবাজারের সদর এলাকার বিভিন্ন সাংগ্রেং প্যান্ডেল ঘুরে ঘুরে দেখি। সেখানে উচ্চস্বরে চলছে রাখাইন ভাষায় লাইভ কনসার্ট। সুর ও বাদ্য জানায়, খুব সম্ভব হেভি মেটালিকা।
আরও পড়ুন, জেন্ডারঃ কী বুঝি – বুঝি কি?
জমকালো নতুন সাজপোশাকে রাখাইন তরুণ-তরুণীরা কনসার্টে মেতেছেন নেচেগেয়ে। পানি খেলাও চলছে সমানতালে। আর পানি খেলায় শিশু-কিশোরদের আগ্রহই যেন বেশী। বেশ কয়েকজনের হাতে আবার দেখা গেল, প্রমাণ আকৃতির ওয়াটার গান। উৎসবের লাগসই প্রযুক্তি বটে!
অক্টোপাস বা শুঁটকি মাছ ভুনা, মুন্ডি (চাল দিয়ে তৈরি বিশেষ রাখাইন খাবার), তেঁতুলসহ তাজা লাইট্টা মাছের ঝোল, নাপ্পি (কয়েক রকম শুঁটকির পেস্ট) দিয়ে বানানো স্যুপি-নুডুলস ইত্যাদি অনুপানসহ রাখাইন আদি পানীয় “রা” টেনেছি খানিকটা। (ছবি বিপ্লব রহমান)
আর ছোট মাপের প্যান্ডেলে কনসার্টের আয়োজন করা না হলেও উচ্চস্বরে হিন্দি বা ইংরেজি গানের সিডি বাজতে দেখেছি।
মোবাইল ফোন, ভিডিও শ্যুটিং ইত্যাদি বাঁচিয়ে নিজেরাও কাকভেজা হয়ে ছবি তুলেছি। রাখাইন ছেলেমেয়েরা সাদরে বরণ করে নিয়েছেন ঢাকা থেকে আসা রবাহুতদের।
কয়েকটি জায়গায় ছোট ছোট পানাহারের আসরেও অংশ নিয়েছি। মুরগি, শূকর, অক্টোপাস বা শুঁটকি মাছ ভুনা, মুন্ডি (চাল দিয়ে তৈরি বিশেষ রাখাইন খাবার), তেঁতুলসহ তাজা লাইট্টা মাছের ঝোল, নাপ্পি (কয়েক রকম শুঁটকির পেস্ট)দিয়ে বানানো স্যুপি-নুডুলস, কাঁচা আম ভর্তা, পেঁপে সালাদ ইত্যাদি অনুপানসহ রাখাইন আদি পানীয় “রা” টেনেছি খানিকটা।
আরও পড়ুন, যৌনবিশ্বে কীসের হাতছানি
বলা ভাল, ভাত গ্যাঁজানোর পর কয়েকবার ডিস্টিল করা এই রাইস জুসটি বেশ কড়া, পানির মতোই স্বচ্ছ ও রাখাইন সমাজে বেশ জনপ্রিয়। লোকে বলে, “রা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল!”...
আর সাধারণ পর্যবেক্ষণ বলছে, উচ্চ শিক্ষিত রাখাইন তরুণ-তরুণী ও শিশু-কিশোররা সর্বত্রই খুব স্মার্ট, প্রজন্মের পর প্রজন্ম বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী ও পর্যটন বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা করেই তাদের টিকে থাকতে হচ্ছে বলে, এ প্রজন্ম একই সঙ্গে কর্মঠ, উদ্যমী, বিনয়ী, উচ্ছল, দ্বিধাহীন, বেপরোয়া ও রক্ষণশীল।...
ছবি ও ভিডিও: লেখক, ©কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত।