/indian-express-bangla/media/media_files/2025/09/28/cats-2025-09-28-15-28-01.jpg)
ছদ্মবেশে চলে 'হুদুড় দুর্গা'র খোঁজ
মর্তে আবির্ভূতা হয়েছেন দেবী দুর্গা। তাই আনন্দে মাতোয়ারা বর্ণহিন্দুরা। তবে দেবী দুর্গা মর্তে আসায় মোটেই আনন্দিত নয় আদিবাসীরা। তাঁদের কাছে এই দুর্গা পুজোর সময়টা হল শোকের সময়। দেবী দুর্গা তাঁদের কাছে হলেন 'হুদুড় দুর্গা’। সেই কারণে দেবী পক্ষে দুর্গা আরাধনা চলার সময়ে ছদ্মবেশে নাচের মাধ্যমে আদিবাসীরা 'হুদুড় দুর্গাকে’ খুঁজে বেড়ান।
ছদ্মবেশে 'হুদুড় দুর্গাকে’ খুঁজে বেড়ানোর গোটা পর্বটা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে 'দাসাই পরব’ নামে খ্যাত। মাহাত্ম্যে ভরা এই 'দাসাই পরব’ পালনে আজও অবিচল রয়েছেন পূর্ব বর্ধমান জেলার আদিবাসী মানুষজন।তাই মহাষষ্ঠীর দিন থেকে তাঁরা ’দাসাই পরব’ পালনে মাতোয়ারা।
দেবী দুর্গাকে আদিবাসীদের 'হুদুড় দুর্গা’ ভাবার নেপথ্যে রয়েছে মহিষাসুর প্রীতি। আদিবাসী সমাজের অনেকেই মনে করেন তাঁরা মহিষাসুরের বংশধর। ২০১১-র জনগননা অনুযায়ী ভারতে এখনও 'অসুর জনজাতির’ মানুষের বসবাস রয়েছে। সেই আদিবাসী জনজাতির লোকজন’ই মহিষাসুর অর্থাৎ হুদুড় দুর্গার পুজারী। দুর্গা পুজোর সময়ে তাঁরা মহিষাসুরের পুজো করেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন দুর্গা আসলে কোন নারী শক্তি নয় । আদিবাসী জনজাতির মতে, দুর্গা হলেন শক্তিশালী বলবান পুরুষ।সেই কারণে তাঁদের কাছে দুর্গা ’হুদুড় দুর্গা’ নামেই পরিচিত।
'বন্ধু' সজলের পাশে অর্জুন, সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পুজো বন্ধে প্রশাসনকে বেনজির হুঁশিয়ারি, রাজ্য-রাজনীতি কাঁপিয়ে দিলেন
আদিবাসী জনজাতীর মানুষজন এও বিশ্বাস করেন 'অনার্যদের’ দেবতা হলেন 'অসুর’। আর্যরা কখনই অনার্যদের দেবতা 'হুদুড় দুর্গার’ সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না । তাই 'দেবী রুপি’ দুর্গাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে মহিষাসুরের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন দেবতারা।
তাঁদের মতে,চিরাচরিত দুর্গা পূজার কাঠামোয় অসুরকে যতই অত্যাচারী দেখানো হোক না কেন, বাস্তবে মহিষাসুর ছিলেন ঠিক তার উল্টোটাই। যুদ্ধে 'অসুর' কোন মহিলা ও শিশুদের আঘাত করতেন না। সেই দুর্বলতা জেনে দেবতারা বিজয়লাভ করার জন্য প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দুর্গাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ।সেই সময়েও নিজের নীতিতে অবিচল ছিলেন মহিষাসুর।তাই দুর্গার কাছে তিনি পরাজিত হতে বাধ্য হন।
এই বিশ্বাসে ভর করেই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন দুর্গাপুজোর সময়ে ছদ্মবেশে নাচের মাধ্যমে তাঁদের ’অনার্য ভগবানকে’ খুঁজে বেড়ান।যার প্রস্তুতি সাধারণত ভাদ্র মাস শেষ থেকেই আদিবাসী মহল্লায় শুরু হয়ে যায়। আর তারপর পুজোর ষষ্ঠীর দিন থেকে পুরুষরা নারী সেজে ধামসা ও মাদল নিয়ে ’দাসাই নাচে’ র মধ্য দিয়ে হুদুড় দুর্গার খোঁজে মাতোয়ারা হন । দশমী পর্যন্ত চলে এই দাসাই পরব।
আদিবাসী 'অসুর জনজাতির’ লৌকিক বিশ্বাস অনুযায়ী,অসুররা এই দেশের প্রাচীন জনজাতি। তাঁদের নেতার নাম ছিল ‘হুদুড়’ দুর্গা’ অর্থাৎ ‘মহিষাসুর’। সাঁওতালি মতে দুর্গা পুংলিঙ্গ। সাঁওতালি ভাষায় ‘হুদুড়’ কথার অর্থ প্রচণ্ড জোরে বয়ে চলা বাতাস । আর্য সেনাপতি ’ইন্দ্র’ ছলনা ও কৌশলের আশ্রয় নিয়ে এক দেবীকে ’হুদুড় দুর্গার’ কাছে পাঠান। ওই দেবী হুদুড় দুর্গাকে বিয়ে করার পর নবমীর দিন হুদুড় দুর্গাকে হত্যা করেন। সেই কারণে ওই দেবী দুর্গাদেবী নামে পরিচিতি পান । অসুর জনজাতির মানুষজন এই লোককথাকে বিশ্বাস করেই শতকের পর শতক দুর্গোৎসবের চারদিন শোকের দাসাই পরব পালন করে আসছেন। আদিবাসী পুরুষেরা নারীর বেশে,মাথায় ময়ূরের পুচ্ছ লাগিয়ে বুক চাপড়ে ‘ভুয়াং’ নাচের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে দুঃখের গান গেয়ে এই সময়ে খুঁজে বেড়ান তাদের মহিষাসুর বা হুদুড় দুর্গাকে।
উৎসবের রাতে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই সব শেষ
রাজ্যের শাসক দলের আদিবাসী জনজাতী গোষ্ঠীর নেতা টুডু বলেন , আদিবাসী সংস্কৃতির অনেক কিছুই এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না আদিবাসী সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরব দাসাই। সেই পরবকে সামনে রেখেই নিজেদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা স্বরুপ বহু আদিবাসী দুর্গা পুজোর কটা দিন দাসাই পরবের অনুষ্ঠানে সামিল হন। আদিবাসী এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দেবু টুডু তাঁদের সম্প্রদায়ের তরুণ প্রজন্মকে আহ্বান জানিয়েছেন।