সুকান্ত মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিজেপির রাজ্য কমিটিতে জায়গা হয়নি সায়ন্তন বসুর। তিনি যুব মোর্চার রাজ্য কমিটির বিভিন্ন পদে থাকার পর সংগঠনের সর্বভারতীয় সম্পাদক ছিলেন সাড়ে ৫ বছর। ছিলেন দলের বিজেপির রাজ্য কমিটির সম্পাদক। দীর্ঘ দিন ছিলেন রাজ্য সাধারণ সম্পাদক। ২০১৯ বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থীও হয়েছিলেন। চষে বেরিয়েছেন রাজ্যের সর্বত্র। দলবদলের জল্পনা উড়িয়ে দিয়েছেন সায়ন্তন বসু। বরং রাজ্যে গভর্নমেন্ট স্পনসর্ড সন্ত্রাসের দিকে আঙুল তুলেছেন সায়ন্তন। তাঁর স্পষ্ট কথা, 'যো দিখতা হ্যায় ও বিকতা হ্যায়'। আমি আর আপনি দুটো প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে গেলাম মানুষ কোনও গুরুত্ব দিল না সেই আন্দোলনের কিছু হবে না। নির্বাচনে একটা দলের ব্যালান্স শিট বোঝা যায়।' ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার প্রতিনিধির সঙ্গে খোলামেলা কথা বললেন সায়ন্তন। আজ সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব।
প্রশ্ন- বিজেপির আন্দোলনে কোনও দিশা দেখতে পাচ্ছেন?
সায়ন্তন বসু- আমরা যখন ছোট ছিলাম প্রত্যেক দিন দেখতাম এসইউসিআই আন্দোলন করছে। সাধারণ মানুষের গুরুত্বপূর্ণ নানা ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করছে। খবরের কাগজ খুললেই এসইউসির বাইরে কোনও রাজনৈতিক দল নেই। কিন্তু নির্বাচনে প্রাপ্তি একটি বা দুটি আসন। সেই ষাটের দশক থেকে ২টো আসন পেত, ১১ নির্বাচনেও দুটি আসন পেয়েছে। তারপর সেখান থেকেও বিদায় হয়েছে। আন্দোলন দেখে বোঝা যায় না। ফলে পরিচয়। কিন্তু নির্বাচনে একটা দলের ব্যালান্স শিট বোঝা যায়। পার্টিটা খুব ভাল পারফর্ম করল। নির্বাচনে রেজাল্ট দিতে পারল না। নিজের ২০-২৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি একটা নির্বাচনে ফেল করলেও পরের নির্বাচনে ফল মিলবে। রেজাল্টই বলে দেবে।
প্রশ্ন- নবান্ন অভিযানে এবার সেই উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়নি। তাবড় বিজেপি নেতৃত্ব হাজির ছিল না।
সায়ন্তন বসু- এবার নবান্ন অভিযানের রূপরেখা তৈরিতে আমি ছিলাম না। গতবার দুটি অভিযান হয়েছিল, দক্ষিণবঙ্গের জন্য় নবান্ন ও উত্তরবঙ্গের জন্য উত্তরকন্যা অভিযান। ৫-৭ দিনের ব্যবধানে হয়েছিল। উত্তরকন্যা অভিযানে উলেন রায় মারা গিয়েছিলেন। এবার নবান্ন অভিযানে আমি ছিলাম না, বাইরে ছিলাম। নতুন টিম কাজ করেছে। তখন বিধানসভা ভোট সন্নিকটে ছিল। নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিজেপি সরকার গড়বে এই মানসিকতা ছিল। বিজেপি সরকার গড়তে পারেনি। আমরা একটু পিছিয়ে আছি। তাই দুটি অভিযানের মধ্যে তুলনা করা ঠিক হবে না।
প্রশ্ন- ২০২১-এ বিজেপির টার্গেট ছিল ২০০ আসন। ৭৭-এ থেমেছে। বাংলায় কি আদৌ সরকারে আসতে পারবে বিজেপি?
সায়ন্তন বসু- ১৯৮৪ সালে লোকসভা ভোটের সময় প্রচার ছিল 'ঘাস কী রোটি খায়েঙ্গে অটল বিহারীকো প্রধানমন্ত্রী বানায়েঙ্গে।' ভোটের ফলপ্রকাশ হতেই দেখা গেল বিজেপি মাত্র ২টো আসন জিতেছে। বাজপেয়ীজি নিজে ভোটে হেরে গিয়েছেন। ৫ বছর বাদ ভোটে ৮৮টি আসন পেলাম। ১৯৯১-এও তাই। তবে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৯৯৬-এ বিজেপি সরকার হয়েছে। মাঝে ১০ বছর ছিল না, আবার বিজেপি সরকার হয়েছে। ১০ বছর, ৫ বছর, ৭ বছর দেরি হতে পারে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সুশাসন দেওয়ার মতো বিজেপি সরকার হবে। এই বিশ্বাস আমার আছে।
প্রশ্ন- সামনেই রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট…..
সায়ন্তন বসু- আমি ডে টু ডে ফাংসনে পার্টিতে নেই। পঞ্চায়েত নির্বাচন শুধু জেতার নির্বাচন নয়। জোরদার লড়তে হবে। এক ইঞ্চি জমি ছাড়়লে হবে না। নাহলে মুশকিল আছে। গত ২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনে কর্মীরা জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করেছিল। অত্যাচারকে প্রতিহত করেছিলেন। তার ফল পেয়েছিলাম ২০১৯ লোকসভার ভোটে।
প্রশ্ন- বাম ছাত্র-যুবরা বা সিপিএম পথে রয়েছে, বামেদের সম্ভাবনা কতটা?
সায়ন্তন বসু- মুশকিল আছে। সিপিএমের সেই ক্রেডিবিলিটি নেই। ৩৪ বছর বাংলা শাসন করেছে, বাংলাকে কি দেয়েছে? একটা কারখানা দিয়েছে? বলবে হলদিয়া, সেক্টর ফাইভের কথা। এরকম সেক্টর ফাইভের আইটি হাব গুরগাঁওয়ের অতি-গলিতে আছে। কত হাজার কোটি টাকার মৌ হয়েছে? ইমপ্লিমেন্ট হয়েছে কটা? পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত যুবক সুযোগ পেলেই বাইরে চলে যাচ্ছে। অর্থনীতি একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। সিন্ডিকেট রাজ তো সিপিএমের আমলে তৈরি। সিপিএমের পার্টি অফিসগুলো খাপ পঞ্চায়েতে পরিণত হয়েছিল। মানুষ এগুলো ভোলেনি। সিপিএমের আবার সুযোগ হবে তা আমি বিশ্বাস করি না।
প্রশ্ন- বগটুই, হাঁসখালি, আনিস-হত্যা, গরুপাচার, কয়লাপাচার। তাছাড়া শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ। এমন নানা ইস্যু কি কাজে লাগানো যাচ্ছে না?
সায়ন্তন বসু- জনগণকে নিয়ে আন্দোলনে নামতে হবে। আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি আর আপনি দুটো প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে গেলাম মানুষ কোনও গুরুত্ব দিল না সেই আন্দোলনের কিছু হবে না। যে কোনও আন্দোলন সে চিটফান্ড নিয়ে হোক বা টেট, বগটুই নিয়ে হোক। অথবা হাঁসখালি নিয়ে হোক। রাজনৈতিক দল এসব ইস্যু নিয়ে রাস্তায় থাকুক মানুষ সমর্থন করার জন্য একদম তৈরি আছে। রাজনীতিতে একটা কথা আছে, 'যো দিখতা হ্যায় ও বিকতা হ্যায়।' বিজেপিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করতে হবে। মানুষ সঙ্গে থাকলে বিজেপির জয়যাত্রা কেউ আটকাতে পারবে না।
প্রশ্ন- ইস্যু থাকতেও আন্দোলন দানা বাঁধছে না।
সায়ন্তন বসু- মানুষই সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা যাঁরা রাজনীতি করি তাঁরা মানুষকে নির্বোধ ভাবি। এটা খুব ভুল ধারনা। মানুষ খুব বুদ্ধিমান। মানুষ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। অল্প সময়ের জন্য অল্প মানুষকে বোকা বানানো যায়। বেশিরভাগ মানুষ অত্যন্ত বুদ্ধিমান। এই তৃণমূল সরকারকে মানুষ সরিয়ে দেবেন এই বিশ্বাস আমার আছে।
আরও পড়ুন- ১০ মাস সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে, আচমকা তোপ, এখন কী করছেন সায়ন্তন?
প্রশ্ন- ২০২৪-এ মমতার ক্যারিস্মা কি কাজ করবে? এবারও আওয়াজ তুলছে প্রধানমন্ত্রী হবে।
সায়ন্তন বসু- পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ৪২-এ ৪২ পাবে, তাতে কি হবে। লোকসভায় মোট ২৪৫টা আসন। ক্ষমতা পেতে হলে ২৭৩টা আসন প্রয়োজন। ৪২ বাদ দিলে থাকে ২৩১। কোথা থেকে জিতবে? বাকি রাজ্যে তৃণমূলের নাম কেউ শোনেনি। খায় না মাথায় দেয় কেউ জানে জানে না। কোথাও ২ শতাংশ ভোট পাচ্ছে কোথাও ৬ শতাংশ ভোট পাচ্ছে। ভাবছেন ওখান থেকে জিতে জাতীয় দল হবে। আসন তো দরকার। নাম্বার দরকার। সবাই প্রধানমন্ত্রী হতে চান। দু-চারটে আসন এদিক ওদিক হতে পারে কিন্তু বিজেপিই ২৪-এ ক্ষমতায় আসবে।
প্রশ্ন- গোয়া, ত্রিপুরায় তৃণমূল ভোটে লড়াই করছে। তৃণমূল-বিজেপির সেটিংয়ের অভিযোগ তুলছে কংগ্রেস-সিপিএম।
সায়ন্তন বসু- তৃণমূল কত শতাংশ ভোট পাচ্ছে? ২ শতাংশ। বিজেপি জিতছে ১০ শতাংশ বাড়তি ভোট নিয়ে। বিজেপির এত দূরাবস্তা আসেনি তৃণমূলকে বলতে হবে ওখানে গিয়ে প্রচার কর। এটা একেবারে ভুল ধারনা।
প্রশ্ন- ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের পর বিজেপি নেতা-কর্মীদের খুন, সন্ত্রাস, বাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ করেছিল। কিন্তু নেতাদের সমর্থন পায়নি বলে অধিকাংশ কর্মী অভিযোগ করেছিল।
সায়ন্তন বসু- যে সন্ত্রাস হয়েছে তা গভর্নমেন্ট স্পনসর্ড সন্ত্রাস ছিল। তা কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষে আটকানো সম্ভব ছিল না। বন্দুক, পিস্তল নিয়ে লোকের বাড়িতে হামলা করেছে। পেট্রোল বোম মারছে। আমি-আপনি কি করব? আমরা ফোন এসপি তুলছে না। মণ্ডল সভাপতির ফোন আইসি তুলছে না। জেলা সভাপতির ফোন এসডিপিও তুলছে না। করবেন টা কী। একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার পারত এই সরকারকে বরখাস্ত করে শান্তি ফিরিয়ে আনতে। সেই সময় হয়নি। হলে কী হতো জানি না। কিন্তু কোনও সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের পক্ষে গভর্নমেন্ট স্পনসর্ড সন্ত্রাস আটকানো সম্ভব নয়। আমরা কোনও সন্ত্রাসবাদী সংগঠন নই। আমরা রাজনৈতিক দল।