‘বিশ্বমানের পরিষেবা’ পেতেই নাকাল, রেফার রোগেই কি বেসামাল SSKM-র পরিকাঠামো?

বিশ্বমানের পরিষেবার দাবি করা হলেও সেটা পেতে রীতিমত কালঘাম ঝরাতে হয় রোগী ও পরিজনদের এমনই দাবি করেছেন রোগীদের একাংশ।

Hospital, Patients
'বিশ্বমানের পরিষেবা' পেতেই নাকাল, রেফার রোগেই কী বেসামাল এসএসকেএমের পরিকাঠামো?

বোলপুর থেকে সাতসকালেই হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে পড়েছেন ছেলের ভাল চিকিৎসা করাবেন বলে। বেশ কয়েকদিন ধরেই কিডনির জটিল অসুখে ভুগছেন ছেলে বান্টি সাহা। স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েও সুফল মেলেনি। অগত্যা ভরসা রাজ্যের অন্যতম সেরা পিজি হাসপাতাল। অ্যাম্বুলেন্স বুক করে হাসপাতালের ইমার্জেন্সির সামনে এসেছেন তখন সকাল সাড়ে নটা। দীর্ঘ তিন ঘন্টা ধরে ছেলে বান্টিকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের পাশে দাঁড়িয়ে মা। বাবা হন্যে হয়ে ভর্তির চেষ্টায় আঁধার কার্ড হাতে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছেন। কথা বলে জানা গেল, আউটডোরের মেডিসিন বিভাগের এক চিকিৎসক বান্টিকে দেখেছেন। তিনি জানিয়েছেন, যেখানে চিকিৎসা চলছিল সেখানেই নিয়ে যেতে, প্রেসক্রিপশনে তিনি কী করণীয় তার উল্লেখ করে দিয়েছেন।

কিন্তু বছর ২১ এর এক তরতাজা যুবককে কেন ভর্তি নেওয়া হবে না সে প্রশ্ন অমিল। পাশেই অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে রয়েছেন নিতাই মালিক। চোখে গভীর ক্ষত নিয়ে এসেছে কলকাতার প্রথম সারির হাসপাতালে। একঘন্টারও বেশি সময় ধরে নিতাইবাবু অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে রয়েছেন। বাড়ির লোক গিয়েছেন ট্রলির সন্ধানে। কথা বলতে রীতিমত কাতরাচ্ছেন তিনি। তাও ধীরে ধীরে তিনি বললেন, দিন কয়েক আগে তার পরিচিত এক রোগীকে তিন দিনের চেষ্টায় পিজি হাসপাতালে ভর্তি করতে পেরেছেন। এবার তিনি নিজেই অসুস্থ। কীভাবে ভর্তি হবেন সেটাই বড় প্রশ্ন। রেফার জ্বরেই কী রোগীর চাপে হিমশিম অবস্থা হাসপাতালের উঠেছে প্রশ্ন।

এইমুহূর্তে পিজিতে প্রায় ২৫০০ জন কর্মী এবং ১২০০ জন চিকিৎসক আছেন। কমবেশি ৩০০ জন চিকিৎসক ও কর্মী ৩৯টি আউটডোর পরিচালনা করেন সোম থেকে শনি। ছুটির দিন বাদ দিলে বছরের যে কোনও দিন রোগীর সংখ্যা হয় গড়ে ১২ হাজারের মতো।

এদিন সকাল থেকে হাসপাতাল চত্বরে থিকথিক করছে কালো মাথার ভিড়। অর্থপেডিক বহির্বিভাগের সামনে এঁকেবেঁকে চলেছে সর্পিল লাইন। লাইনে দাঁড়িয়ে নদীয়ার বাসিন্দা মধুসূদন দত্ত। পায়ের ব্যথায় দাঁড়ানোর জো নেই। সকাল থেকে খালিপেটে এসে লাইন দিয়েছেন। দাঁড়াতে না পেরে পাশেই বসে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘ভোর হতেই বেরিয়ে পড়েছি। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ হাসপাতালে এসে দেখি প্রচুর ভিড়। পায়ের যন্ত্রণা নিয়ে কোনমতে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। এখন বাড়ির লোক লাইন রেখেছে, কখন ডাক্তার দেখাতে পারবো সেটাই বড় প্রশ্ন। প্রথম সারির সরকারি হাসপাতালে পরিষেবা পেতে কেন এত ঝক্কি পোহাতে হবে প্রশ্ন মধুসূদনবাবুর’।

কিছুটা এগোতেই বাঁদিকে হাসপাতালের সেন্ট্রাল ল্যাব। সেখানে রক্ত পরীক্ষার জন্য উপচে পড়ছে ভিড়। লাইনে দাঁড়ানো রোগীরা জানালেন, রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে পেতে কমপক্ষে ১০ দিন। কখনও কখনও ২ সপ্তাহ পরও রিপোর্ট হাতে পাওয়ার কথা জানালেন নিউব্যারাকপুরের সীমা দেবী।

আরও পড়ুন: [ আজই সিঙ্গাপুরে অস্ত্রোপচার, বাবাকে কিডনি দান করে গর্বিত মেয়ে রোহিনী ]

হাসপাতালের রোগীদের জন্য পরিকাঠামোর বেশ কিছু বদল আনে পিজি কর্তৃপক্ষ। কোভিড পর্ব মিটতেই ওপিডি’র রোগীর চাপ সামাল দিতে নয়া কম্পিউটার ভিত্তিক টিকিট কাউন্টার চালু করা হয় হাসপাতালের তরফে। কিন্তু তাতেও যে সমস্যা আখেরে মেটেনি, ওপিডি’র সামনে লম্বা লাইন তার প্রমাণ। অন্যদিকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করানোর জন্য অসাধু চক্রের অভিযোগ এনেছেন রোগীর পরিজনরা। কীভাবে কাজ করে এই দালাল চক্র? রোগীর পরিজনরা জানালেন, হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সে করে যে রোগীরা আসে, সেই অ্যাম্বুলেন্স চালক এবং সহায়করা রোগীর বাড়ির লোকেদের নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি হাসপাতালে এসে কোন শৌচালয় ব্যবহার করবে সেটা ঠিক করে দেয়। অ্যাম্বুলেন্স চালক এবং হাসপাতালের একশ্রেণির বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীর যোগসাজশেই গোটা ব্যাপারটা চলে। দালাল চক্র নিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উষ্মাপ্রকাশ করেছিলেন।

আরও পড়ুন: [ ৯০ দিন পার, কাতারে আটক নৈসেনা আধিকারিকদের ফের জেল হেফাজত, চরম উদ্বেগে পরিবার ]

অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের মত পিজি হাসপাতালে যে বেশ সক্রিয় দালাল চক্র তা রোগীর পরিজনদের কথাতেই স্পষ্ট। শহরের প্রতিটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরই দাবি, রোগীর পরিজনেরা অভিযোগ জানালে, ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু পরিজনদের প্রশ্ন, ‘‘রোগীকে নিয়ে চিন্তা করব, না দালাল ধরাব? এটা দেখার কাজ তো হাসপাতালের।’’ দিন কয়েক আগেই টাকার বিনিময়ে পরিষেবা পাইয়ে দেবার জন্য পুলিশের জালে ধরা পড়ে আদিত্য হাজরা এবং নৌশাদ আলম নামে দুই যুবক। তারা বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক নিয়োজিত রক্ষী হিসাবে পিজি হাসপাতালে কাজ করতেন। সিটি স্ক্যান করানোর নামে টাকা চাওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় ২ অভিযুক্তকে। পাশাপাশি মাঝে মধ্যেই রোগী উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাও সামনে আসছে। এই ব্যাপারে হাসপাতালের তরফে অবশ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদা করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

দক্ষিণেশ্বর থেকে এমআরআই করাতে পিজি হাসপাতালে এসেছেন গোবিন্দ বনিক। তিনি বলেন, আজ শুধু তারিখ টুকু নিতে এসেছি। কখনও ১০ দিন কখনও ২০ দিনও অপেক্ষা করতে হয় এমআরআই করাতে এসে। অন্যদিকে স্বপন শর্মা নামে এক রোগীর পরিজনের দাবি, ‘দিন কয়েক আগেই সেরিব্রালে আক্রান্ত হয়ে আমি আমার বৌদিকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করাতে এসে পারিনি। অগত্যা শহরের এক বেসরকারি নার্সিং হোমে তাঁকে ভর্তি করা হলেও প্রাণে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।’ তাঁর কথায়, ‘বিশ্বমানের পরিষেবার দাবি করা হলেও সেটা পেতে রীতিমত কালঘাম ঝরাতে হয় রোগী ও পরিজনদের।’

আরও পড়ুন: [ আহমেদাবাদে ভোট দিলেন মোদী, দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণ ঘিরে উৎসবের মেজাজ গুজরাটে ]

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে এব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে জানানো হয়, ‘রোগীদের স্বার্থ সবসময় আমাদের কাছে সবার আগে,। অনেক ক্ষেত্রে এমন কিছু রোগীকে রেফার করা হয় যাদের হয়তো ভর্তির সেভাবে প্রয়োজন নেই। সেক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা রোগীকে দেখে প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে বাড়িতে থেকেই চিকিৎসার পরামর্শ দেন। দালাল চক্রের ব্যাপারে রোগীদের পরিজনদের বারবার সাবধান করা হয়। প্রতারণার ঘটনা ঘটলে সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে হাসপাতালের তরফে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

Stay updated with the latest news headlines and all the latest Westbengal news download Indian Express Bengali App.

Web Title: Difficult to get medical services in pg hospitals kolkata what the patient says

Next Story
বেনিয়ম করে স্কুলে চাকরি, নাম সামনে আসতেই চূড়ান্ত অবসাদ, চরম সিদ্ধান্ত মহিলার
Exit mobile version