চাষের জমিতে গেলেই শোনা যাচ্ছে অন্নদাতাদের হাহাকার, কান্নার শব্দ। লাগামছাড়া দাম দিয়ে সার কিনতে নাভিশ্বাস উঠেছে বাংলার কৃষকদের। চাষিদের বক্তব্য, 'খাবার উৎপাদনকারীদেরই অন্ন জুটছে না। চাষের খরচ সামাল দিতে গিয়ে দফারফা অবস্থা।' উত্তর ২৪ পরগনার মণ্ডলগাছি পূর্বপাড়ার রাজচাঁদ মণ্ডল, কাইমুদ্দিন, রুস্তম, মহিউদ্দিনরা একান্ত নিরুপায় হয়েই চাষ করে চলেছেন। সারের জোগান নিয়ে ইতিমধ্যে ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিকে আলু চাষিরাও পড়েছেন মহাবিপাকে।
৫ বিঘে জমি রয়েছে বছর পয়ষট্টির রাজচাঁদ মণ্ডলের। তাঁর প্রধান জীবিকা কৃষি। তিনি বলেন, 'চাষের হাল খুব ভাল না। বাজারে ফসলের দাম পাচ্ছি না। বেগুন, পটল, ধান চাষ করি। যে সার ছিল ২০-২৫টাকা এখন সেই সার ৪২-৪৫টাকা কেজি। এই সার কটা গাছের গোড়ায় দেব? বস্তাপ্রতি দাম হয়েছে ২২০০ থেকে ২৩০০ টাকা। গতবছর দাম ছিল ১৩০০ টাকা। ইউরিয়ার দাম শুধু কম আছে। সমস্ত দানা সারের এক অবস্থা। বৃদ্ধ বয়সে কী আর করব!' 'শুধু কি সার, ট্রাক্টর, কীটনাশক, চাষের জল, বীজ নানা খাতে খরচ বেড়েই চলেছে,' বলেন রাজচাঁদ। অপর চাষি মহিউদ্দিনের কথায়, 'আলুচাষে সার ছাড়া ১৪ হাজার টাকা বিঘে প্রতি খরচ আছে। বাজারে সেই টাকাই উঠছে না। ১০:২৬ সার-এ তো হাত দেওয়া যাচ্ছে না। এদিকে সারের দোকানদাররা বলছে যেভাবে পাচ্ছি সেভাবে বিক্রি করছি।'
দিনরাত এক করে ফসল ফলান কৃষকরা। সম্প্রতি সারের দাম নিয়ে সর্বত্র হইচই শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিধানসভায় উঠেছে সারের মূল্যবৃদ্ধির প্রসঙ্গ। মণ্ডলগাছির বছর উনষাটের রুস্তম আলী পড়ন্ত বিকেলে জমিতে কাজ করছিলেন। তিনি বলেন, 'চাষের জমিতে কাজ করে খাওয়া জুটছে না। চাষে সবই ক্ষতি। এক বিঘে জমি চাষ করতে গেলে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা দরকার। তেল, সার সব কিছুর দাম আকাশছোঁয়া। সব সারেরই দাম বেশি। চাষির দিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। এমন অবস্থা যে না খেয়ে মরতে হবে। দেনা হয়ে যাচ্ছে।' রুস্তম আলীর স্ত্রী ও এক ছেলে, দুই মেয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছোট মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। ছেলে ভূগোলে অনার্স। তবু ছেলের কোনও চাকরি না জোটায় আক্ষেপ এই কৃষকের।
মণ্ডলগাছি পূর্বপাড়ার কাইমুদ্দিন জীবনযুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন ছোট থেকেই। মূলত ভাগে জমি চাষ করেন তিনি। দেড় বিঘে জমিতে ধান চাষ করেছেন ৪৬ বছরের কাইমুদ্দিন। তিনি বলেন, 'বর্ষায় জল তেমন হয়নি। স্যালোর লাইন ছিল না। ধান ভাল হয়নি। সারের দাম অতিরিক্ত নিচ্ছে। ১০:২৬, ডিআইপি, ইউরিয়া, পটাশ সবেরই এক হাল। কমপক্ষে ১৬,০০০ টাকা বিঘে প্রতি ধানচাষে খরচ। বিঘেতে ৮-৯ বস্তা ধান উঠবে। সরকার সহায়ক মূল্যে নিলে তবু রক্ষে।'
স্থানীয় সার ব্যবসায়ী কুতুবুদ্দিন খান জানিয়েছেন, ১০:২৬ সারের খুব ক্রাইসিস, দামও বেশি। কুতুবুদ্দিন বলেন, 'এই মুহূর্তে ১০:২৬ সার পাওয়া যাচ্ছে না। এবারে দেখছি কিছু চাষি অন্য সার দিয়ে আলু চাষ করছে।' যদিও খুব বেশি দামের কথা স্বীকার করলেন না তিনি। তবে বস্তাপ্রতি ২০০-২৫০ টাকা বেশি বলে জানিয়েছেন তিনি। প্রায় ১৬০০ টাকায় এই সার বিক্রি করেছেন বলে দাবি করেছেন ওই সার বিক্রেতা।
আরও পড়ুন- জোট করে রাম-বামকে ‘উচিত শিক্ষা’, পঞ্চায়েতের আগে এ এক নয়া সমীকরণ!
সারের অগ্নিমূল্য নিয়ে সরগরম রাজ্য-রাজনীতি। সারের দাম নিয়ে তোপ দেগেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দায় চাপিয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর। এই ঠেলাঠেলির মাঝে বাংলার কৃষকরা জমিতে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন।