/indian-express-bangla/media/media_files/2025/10/21/n-1-2025-10-21-13-22-58.jpg)
Netaji Subhas Chandra Bose: কোনও একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।
ব্রিটিশের বৃহত্তম উপনিবেশ ভারতবর্ষের প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রাক্তন গান্ধীবাদী সভাপতি রাতের অন্ধকারে ছদ্মবেশে মিলিয়ে গেলেন আফগানিস্তানের কাবুলে। সেখানে বহু চেষ্টার পর নকল ইতালিয়ান পাসপোর্ট নিয়ে প্রথমে মস্কো তারপর বার্লিন। বার্লিন শহর থেকে ইতালির রোমে যাতায়াত। তারপর একদিন প্রথমে জার্মানি ডুবোজাহাজ তারপর আফ্রিকার মাদাগাস্কারে এসে উত্তাল সমুদ্রে ভেলা নিয়ে এক জাপানি ডুবোজাহাজ চেপে প্রায় তিন মাস পর ইন্দোনেশিয়ার এক দ্বীপে অবতরণ। সেখান থেকে বিমান যোগে টোকিও। আবার টোকিও থেকে সিঙ্গাপুর। তারপর এক সীমিত ক্ষমতার অধিকারী অথচ স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর বিশাল সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ প্রধান হয়ে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া চীন ,কম্বোডিয়া হয়ে বার্মার রেঙ্গুন।
সেখান থেকে আবার ব্যাংকক হয়ে তাইওয়ান এর এক নির্জন দ্বীপে হারিয়ে যাওয়া এবং তারপর চিরদিনের জন্য হয়ে যাওয়া তার জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এক রনযোদ্ধা দেশনায়ক।
এটাই যদি সুভাষচন্দ্র বসুকে ছোট করে বর্ণনা করার জন্য যথেষ্ট না হয় তাহলে আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই মহাসংকট কালে কয়েকটি বিদেশী রাষ্ট্রের সহযোগিতায় তার প্রতিষ্ঠিত একটি প্রবাসী অস্থায়ী ভারত সরকারের। ব্রিটিশ শাসনকালে দেশের বাইরে স্বাধীন ভারতীয় সরকার অবশ্য এর আগেও ১৯১৫ সালে আফগানিস্তানে মহেন্দ্র প্রতাপ সিংয়ের প্রধানমন্ত্রীতে হয়েছে, কিন্তু ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে সুভাষচন্দ্র বসুর সর্বময় নেতৃত্ব নিয়ে তৈরি হওয়া আজাদ হিন্দ স্বাধীন সরকারটির ছিল একটি আধুনিক সেনাবাহিনী, নিজস্ব ক্যাবিনেট , ব্যাংক এবং পৃথিবীর একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকার স্বীকৃতি অনুমোদন।
/filters:format(webp)/indian-express-bangla/media/media_files/2025/10/21/n-2-2025-10-21-13-25-11.jpg)
মাত্র দেড় বছর টিকে থাকা এই আজাদ হিন্দ সরকার ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস কে বাধ্য করল গান্ধী ঘরানার বাইরে গিয়েও ইতিহাসের অন্যান্য ঘটনাবলী কে শ্রদ্ধা এবং গুরুত্ব দিয়ে স্মরণ করার।
জার্মানিতে প্রায় দু'বছর কাটিয়ে সুভাষচন্দ্র বুঝে গেছিলেন যে ইউরোপের কোন দেশ থেকে ভারতবর্ষে সামরিক আগ্রাসন করা কার্যত অসম্ভব। জার্মানি এবং ইতালির সরকারের তার পরিকল্পনার প্রতি আদৌ কোন আগ্রহ আছে কিনা এই চিন্তায় তিনি বিব্রত ছিলেন। অবশেষে হিটলারের প্রত্যক্ষ সাহায্যে বিপদ সংকুল সমুদ্রপথে ডুবো জাহাজে জাপান এসে পৌঁছানোটা তার সামনে নতুন সম্ভাবনা খুলে দিল।
/filters:format(webp)/indian-express-bangla/media/media_files/2025/10/21/n-3-2025-10-21-13-26-45.jpg)
জাপান মোটামুটি ১৯৪৩ এর শুরু থেকেই সুভাষচন্দ্রের উপর আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। সেই সময় সারা পৃথিবীতে বিশ্বযুদ্ধের মোড় আস্তে আস্তে ঘুরে যাচ্ছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে মিত্রশক্তি প্রবল পরাক্রমে তখন প্রতিহত করছে অক্ষশক্তির আগ্রাসন। যে জাপান সিঙ্গাপুর দখল করে পৃথিবী কাঁপিয়ে দিয়েছে সেই জাপানও তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যথেষ্ট অসুবিধা জনক অবস্থায়।
এই পরিস্থিতিতে জাপানের প্রয়োজন ছিল ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশের এমন কোন নেতা যাকে সামনে রেখে আরো কিছুদিন নিজেকে "এশিয়ার মুক্তি সূর্য" বলে যুদ্ধটা চালানো যাবে।
সুভাষচন্দ্র জাপানে পৌঁছালেন মে মাসের মাঝামাঝি এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে মিটিং করলেন জুন মাসের ১০ তারিখে। প্রথম মিটিং এ সুভাষচন্দ্র জাপান সরকারের সহায়তায় তৈরি প্রায় নিষ্ক্রিয় এবং ছত্রভঙ্গ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির নব রূপায়ণের কথা জাপান সরকারকে জানান এবং এই সেনাবাহিনী জাপান সরকারের সাহায্যে রেঙ্গুনের মধ্য দিয়ে ভারতের চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকায় প্রবেশ করানোর পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন।
জাপানি প্রধানমন্ত্রী সুভাষচন্দ্রকে কোন সরাসরি প্রতিশ্রুতি দেননি তবে জাপান সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এবং রাসবিহারী বসুর আমন্ত্রণে ২ জুলাই ১৯৪৩ তারিখে সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুরে উপস্থিত হন।
সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে স্থানীয় ভারতীয় এবং সেই সময় জাপানিদের হাতে যুদ্ধবন্দী ব্রিটিশ আর্মির ভারতীয় সেনাদের তরফ থেকে সুভাষচন্দ্র কে বিপুল সংবর্ধনা জানানো হয়। আজাদ হিন্দ ফৌজের বিখ্যাত সেনাপ্রধান কর্নেল প্রেম সায়গল বলেছেন যে সুভাষ চন্দ্রের সেদিনের সিঙ্গাপুরে অবতরণ যেন স্থানীয় ভারতীয়দের কাছে ঈশ্বর আশীর্বাদের সমকক্ষ একটি পুণ্য লাভ ছিল। সুভাষ চন্দ্রের সিঙ্গাপুরে আসা সেখানকার সব পত্রপত্রিকায় বিরাট করে ছাপা হয়েছিল. জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক Sayonan Times হেডিং করল..." Subhas Chandra Bose coming.. to take active part in Indian Independence move...".
সুভাষচন্দ্রকে ঘিরে তখন সমগ্র পূর্ব এশিয়ার প্রবাসী ভারতীয়দের মনে এক বিপুল স্বপ্নের পৃথিবী। ৪ জুলাই সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত ক্যাথে থিয়েটারে ভির ঠাসা প্রেক্ষাগৃহে বিপুল উদ্দীপনাময় এক পরিবেশে সুভাষচন্দ্র রাসবিহারী বসুর থেকে প্রায় ভেঙে যাওয়া ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির দায়িত্ব নিলেন. যদিও সরকারিভাবে তিনি এই সেনাবাহিনীর দায়িত্ব নেন ২৬ শে অগাস্ট ১৯৪৪।
৪ জুলাই বিপুল সংখ্যক প্রবাসী ভারতীয়র সামনে হিন্দিতে দেওয়া ভাষণে সুভাষচন্দ্র পরিষ্কার করে দিলেন স্বাধীনতার অন্তিম যুদ্ধের পরিকল্পনা এবং তার পরিকল্পনায় স্পষ্ট হল একটি অস্থায়ী স্বাধীন ভারত সরকারের প্রতিষ্ঠার. সুভাষচন্দ্র সেই সরকারের উদ্দেশ্যকে ব্যাখ্যা করে বললেন "....to mobilise all our forces effectively....to lead the Indian Revolution....to prepare the Indian people, inside and outside side India.." এবং সবার শেষে উল্লেখ করলেন "...for an armed struggle which will be the culmination of all our national efforts since 1883".
এর আগেই জার্মানিতে সুভাষচন্দ্র "নেতাজি" বলে স্বীকৃত হয়ে উঠেছেন .সেদিন সিঙ্গাপুরে এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার ভারতীয়র নতুন স্বপ্নের নেতাজি জানিয়ে দিলেন যে এই লড়াইয়ে সবার জন্য অপেক্ষা করে আছে তৃষ্ণা, ক্ষুধা ,কারাবরণ ,যন্ত্রণা আর মৃত্যু .এখানেই তৈরি হলো সেই ঐতিহাসিক রনহংকার "চলো দিল্লি চলো দিল্লি" । এরপর সকলকে চমকে দিয়ে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির নতুন নাম দিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ।
এর পরের দিন অর্থাৎ পাঁচই জুলাই সিঙ্গাপুরের পুরনো সুপ্রিম কোর্ট বিল্ডিং এর সামনে পেডাং ময়দানে ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে এক বিশাল প্রকাশ্য জনসভায় নেতাজি ডাক দিলেন স্বাধীনতার অন্তিম যুদ্ধের যে যুদ্ধযাত্রা শেষ হবে দিল্লির লালকেল্লায়। পরের দিন অর্থাৎ 6 জুলাই সেই একই ময়দানে নেতাজি সুভাষের সাথে এক মঞ্চে আজাধীন ফৌজের অভিবাদন গ্রহণ করলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজো। ভারতবর্ষের সামরিক ইতিহাস নিয়ে নিল এক নতুন যাত্রাপথ।
এই সময় আজাদ হিন্দ ফৌজে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য সংখ্যা মাত্র ৮ থেকে ১০ হাজার।নেতাজির আহ্বানে এরপর আরো বহু মানুষ আজাধীন ফৌজে যোগ দিলেন। সংখ্যাটা প্রায় চল্লিশ হাজারের কাছাকাছি হলেও এদের বেশিরভাগেরই কোন সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল না।
লক্ষ্মী স্বামীনাথনের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর ১২ই জুলাই নেতাজি প্রতিষ্ঠা করলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের নারী ফ্রন্ট ঝাঁসির রানী রেজিমেন্ট। এটাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একমাত্র সম্পূর্ণ নারী পরিচালিত ফ্রন্টে যুদ্ধ করা সামরিক রেজিমেন্ট।
৯ অক্টোবর টোকিওতে আরেকটি সম্মেলনে নেতাজি আরও একবার জাপান সরকারকে মনে করিয়ে দিলেন অস্থায়ী স্বাধীন ভারত সরকারের প্রতিষ্ঠার কথা. এর মধ্যে এই স্বাধীন সরকারের স্বপক্ষে জনমত সংগ্রহে সুভাষচন্দ্র পৌঁছলেন মালয়েশিয়া মালয় বার্মা থাইল্যান্ড ইন্দোনেশিয়া ভিয়েতনাম সহ অন্য দেশ।
জাপান সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অবশেষে সেই স্বপ্নপূরণ হল একুশে অক্টোবর ১৯ ৪৩। সেদিন আবার সিঙ্গাপুরের ক্যাথে প্রেক্ষাগৃহে বিপুল সংখ্যক নাগরিকের সামনে সামরিক পোশাকে অবতীর্ণ হলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু,. বজ্র দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষিত হল " আরজি হুকুমাত ই আজাদ হিন্দ " যার ইংরেজিতে নাম হলো The Provisional Government of Azad Hind.
এই সরকারের জাতীয় সংগীত হলো একটি হিন্দি উর্দু গান " সবসুখ চাইনকি বর্ষা বারসে" . গানটির সুর রবীন্দ্রনাথের জনগণমন অধিনায়ক এর অনুরূপ। জয় হিন্দ গৃহীত হলো এই সরকারের সরকারি স্লোগান। এই সরকারে নির্বাচিত হলেন পাঁচ জন কেবিনেট মন্ত্রী, আট জন আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিনিধি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার 8 জন বিশিষ্ট ভারতীয় নাগরিক।
/filters:format(webp)/indian-express-bangla/media/media_files/2025/10/21/n-4-2025-10-21-13-28-26.jpg)
সুভাষচন্দ্র বসু নিজে হলেন এই সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং বিদেশ মন্ত্রী। ক্যাপ্টেন লক্ষী সাইগাল হলেন নারী সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী জনসংযোগ ও প্রচারের দায়িত্ব পেলেন এস এ আইআর। অর্থমন্ত্রী হলেন কর্নেল এসি চট্টোপাধ্যায় এবং আনন্দমোহন সহায় হলেন মন্ত্রী সমতুল্য ক্যাবিনেট সচিব।
প্রথম ভাষণে সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং সর্বময় নেতা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ঘোষণা করলেন তিনি ভগবানের নামে শপথ করছেন তার দেশের 38 কোটি জনতার স্বাধীনতার জন্য জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি এই পবিত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ থাকবেন"।
দু'দিন পর অর্থাৎ ২৩ শে অক্টোবর এই সরকারকে সরকারি স্বীকৃতি দিল জাপান এরপরই স্বীকৃতি এলো জার্মানি ইতালি ক্রোয়েশিয়া ম্যান শুকাও ম্যানচুক নানকিং ফিলিপিন থাইল্যান্ড এবং বার্মা থেকে এই সরকার স্পেন থেকে অভিনন্দন বার্তাও পেল।
২৪ অক্টোবর আজাদ হিন্দ সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করল ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই ঘোষণা সুভাষচন্দ্র করলেন পঞ্চাশ হাজার জনতার সামনে। সিঙ্গাপুরের আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে গেল হল দিল্লি চলো আর নেতাজি কি জয়ধ্বনিতে।
স্বাধীন আজাদ হিন্দ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এরপর পাঁচ নভেম্বর ১৯৪৩ সালে সুভাষচন্দ্র আমন্ত্রিত হলেন টোকিওতে অনুষ্ঠিত গ্রেটার ইস্ট এশিয়া কনফারেন্সে পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগদান করার।
এই অধিবেশনে আজাদ হিন্দ সরকারের জাতীয় সংগীত বাদ্যযন্ত্রে বেজেছিল। সুভাষচন্দ্র তার ভাষণে উল্লেখ করলেন ঈশ্বর এশিয়ার ভবিষ্যতের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের স্বাধীনতার গুরুত্ব। এরপরে আজাদ হিন্দ সরকারের সরকারের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এবং সেনাবাহিনীর জন্য অর্থ সংগ্রহের আশায় সুভাষচন্দ্র গেলেন হংকং, সাংঘাই, ম্যানিলা, জাভা সুমাত্রা, বর্ণীয় ইত্যাদি স্থানে নানকিং থেকে সুভাষচন্দ্র সকলকে অবাক করে দিয়ে চীনের রাষ্ট্রপ্রধান জাপানের শত্রু চিয়ান কাই শেক কে পর্যন্ত অনুরোধ করলেন ভারতের এই যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য। উনার তরফ থেকে অবশ্য এর কোন প্রতি উত্তর আসেনি।
জাপান সরকারের কাছে সুভাষ চন্দ্রের দাবি ছিল এমন কোন ভূখণ্ডের যেখানে এই আজাদ হিন্দ সরকার তার সার্বভৌমত্ব দাবী করতে পারে। এটা দুর্ভাগ্য যে জাপান আদৌ এরকম কোন উদারতায় বিশ্বাস রাখত না. জাপানের দখল করা ভারতীয় ভূমি তখন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। সুভাষচন্দ্র বসুকে সামরিক পোশাক পরিয়ে জাপান সেই আন্দামানে নিয়ে যায় ১৯৪৩ ডিসেম্বরে এবং সেই দ্বীপপুঞ্জের কোনরকম প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তর না করে শুধুমাত্র লোক দেখানো একটি হস্তান্তরের চুক্তি পরিকল্পনা করা হয়।
সুভাষচন্দ্র আন্দামানের বুকে স্বাধীন স্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন কোনরকম প্রশাসনিক অধিকার ছাড়াই। জাপান সরকারের তরফ থেকে এরপর আরো নানা বিস্ময়কর অসহযোগিতা আসতে শুরু করে। ১৯৪৩ এবং ৪৪ জুড়ে জাপানি বোমারু বিমান কলকাতা ,মাদ্রাজ ;চট্টগ্রাম, বিশাখাপত্তনম সহ নানাভারতীয় বন্দরে নানা সময় বোমাবর্ষণ করে বহু সম্পত্তি এবং নাগরিক জীবন নষ্ট করে। এইসব বোমাবর্ষনে সুভাষচন্দ্র থেকে কোনরকম পরামর্শ নেয়া হয়নি। জাপান সরকারের সঙ্গে স্বাধীন আজাদ হিন্দ সরকারের সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ হয়. "হিকারি কিকনান" নামক একটি মধ্যবর্তী সরকারি সংস্থা দুটি সরকারের যোগাযোগের সেতু হিসেবে কাজ শুরু করে।
৭ই যদি ১৯৪৪ জানুয়ারি এই সরকারের সদর দপ্তর সিঙ্গাপুর থেকে সরে আসে রেঙ্গুনে। তখনো সুভাষচন্দ্রের আশা বার্মা পার হয়ে তার সেনাদল প্রবেশ করবে বাংলার চট্টগ্রামে এবং তখনই তার উপস্থিতির উন্মাদনায় সারা দেশ জুড়ে জনগণের মধ্যে এবং প্রতিটি সেনাবাহিনীর ছাউনিতে শুরু হয়ে যাবে ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ। ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪ আজাদ হিন্দ ফৌজের সুভাষ ব্রিগেড ভারতে প্রবেশ করার উদ্দেশ্যে চলে আসে মান্দালয়।
জাপান অবশ্য ভারতে প্রবেশ করে মনিপুরের মধ্য দিয়ে। ১৮ মার্চ ১৯৪৪ উত্তর-পূর্ব ভারতের ইম্ফল এবং কোহিমা শহরের চারপাশে বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নেয় প্রায় ৭৫ হাজার জাপানি সৈন্য. সেই বিপুল সেনাবাহিনীর পিছনে সঙ্গে আজাদ হিন্দ ফৌজের ১০ হাজার সৈন্য অংশ নেয় ওই যুদ্ধে। ১৪ এপ্রিল ১৯৪৪ ইম্ফল শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে মইরাং নামক একটি স্থানে মুক্ত ভারতের মাটিতে স্বাধীন আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাপতি শওকত আলী মালিক উত্তোলন করেন জাতীয় পতাকা। কোনো আশ্চর্য কারণে সুভাষচন্দ্র রয়ে যান রেঙ্গুনে।
এরই মধ্যে ৫ এপ্রিল 1944 আজাদ হিন্দ সরকার ঘোষণা করে আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠার। এই সময় আজাদ হিন্দ সরকারের ডাক টিকিটও প্রকাশ করা হয় যদিও এই ব্যাংক এবং এই ডাকটিকিটের কোন অর্থনৈতিক বা প্রশাসনিক গুরুত্ব ছিল না।
আরও পড়ুন- Durgamurti-Netaji: গোপেশ্বর পালের দুর্গামূর্তি বিপ্লব ও সুভাষচন্দ্র বসু, তথ্য-মিথ আর মিথ্যার কথামালা
এরপরে আরও দেড় বছর নানা রকম বিক্ষিপ্ত গরিলা যুদ্ধে অল্পবিস্তর সাফল্য পেলেও জাপান সরকারের তাচ্ছিল্যময় অতি সীমিত সহযোগিতায় সুভাষ চন্দ্রের আর বেশি কিছু করার সুযোগ ছিল না।
তবুও তিনি একজন দক্ষ নেতার মত শেষ দিন পর্যন্ত তার সেনাবাহিনীর প্রতিটি সেনাকে, সরকারের প্রতিটি সদস্যকে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা হাজার হাজার প্রবাসী ভারতীয়কে যথাসম্ভব উৎসাহ ও সাহস জুগিয়ে গেছেন। তার এই সময়কার বেতার ভাষণ গুলিতে প্রবল অনুপ্রেরণাদায়ক কথাবার্তা থাকলেও খুব বেশি বাস্তবিক তথ্য থাকত না।
সারা পৃথিবীতে তখন যুদ্ধ পরিস্থিতি জাপানের জন্য ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এবং এটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে এই বিশ্বযুদ্ধের শেষ হাসি হাসবে রাশিয়া, গ্রেট ব্রিটেন এবং আমেরিকা। অক্ষশক্তির ক্ষমতা তখন অস্তাচলে। স্বাভাবিকভাবেই একইসঙ্গে আজাদ হিন্দ সরকার এবং বাহিনীর কর্মক্ষমতা তখন সীমিত।
নেতাজির এই অস্থায়ী স্বাধীন সরকারের যাবতীয় পরিকাঠামো ১৯৪৫ এর মাঝামাঝি থেকে দুর্বল হতে থাকে। ১৯৪৫-এর ৬ এবং ৯ই অগাস্ট হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আমেরিকা এটমবোম ফেলে এবং সে বছর ১৫ই আগস্ট জাপান সরকারিভাবে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে।
নিয়ম অনুযায়ী জাপান সরকারের যুদ্ধ সহযোগী হিসেবে হয়তো আজাদ হিন্দ সরকারের সর্বাধিনায়ক সুভাষচন্দ্র বসুর আত্মসমর্পণ করার কথা ছিল কিন্তু তিনি তার ভেঙ্গে যাওয়ার স্বপ্নকে নতুন করে গড়ে তুলবার জন্য যাত্রা করলেন ব্যাংকক হয়ে তাইওয়ানের পথে।
আরও পড়ুন- রবি ঠাকুর থেকে লিও মেসি, সবার ছোঁয়া শিলংয়ের ত্রিপুরা ক্যাসেলে
সেখান থেকে ১৮ই আগস্ট ১৯৪৫ তার কোথায় যাওয়ার কথা ছিল সেটা ঐতিহাসিক ভাবে আর প্রমাণিত নয় তবে বাঙালি সেটা নিয়ে স্বপ্নবিলাস করতে খুব ভালোবাসে .
তাইওয়ান এর সেই নির্জন বিমানবন্দরে তার অগ্নিদগ্ধ হয়ে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু তাই আজও বহু বাঙালির কাছে কিছুতেই একটি বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা নয়। অঙ্কুরে বিনাশ হওয়া নেতাজির স্বাধীন অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকারের কিছু স্মৃতি আজও সিঙ্গাপুরে আছে তবে বেশিরভাগ ভারতীয় সেগুলো সম্পর্কে কোন খোঁজ খবর রাখেনা।
সিঙ্গাপুরের পুরনো সুপ্রিম কোর্ট বিল্ডিং এর সামনে পেডাঙ্গ ময়দানে যেখানে পাঁচ ও ছ জুলাই ১৯৪৩ সুভাষচন্দ্র তার ঐতিহাসিক ভাষণে নতুন করে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন হাজার হাজার ভারতীয়কে সেই ময়দানের সামনে দিয়ে আজ সিঙ্গাপুরে প্রচুর পর্যটকের বাস যায়। সেই বাসগুলিতে বসে থাকা ভারতীয় পর্যটকদের কেউ বলে না ভারতীয়দের কাছে এই ময়দানটির গুরুত্ব কি।
শুধু হাতেগোনা কয়েকজন যারা আজও ওই দুর্দমনীয় মৃত্যু ভয় হীন যে মানুষটা একদিন আইএস চাকরির বিলাসিতার লোভ ত্যাগ করে শুধু মাতৃভূমিকে ভালোবেসে নিজের জীবনকে বারবার বিপন্ন করেছিল সেই মানুষটাকে মনে রেখে বিষন্নভাবে তাকায় সেই ময়দানের দিকে। তাদের বিষন্ন চোখের মাঝে বেঁচে থাকে একজন নেতা যার মৃত্যুর এত বছর পরেও এই দেশ অন্য কাউকে আর "নেতাজি" বলে ডাকার প্রয়োজন মনে করেনি।
/indian-express-bangla/media/agency_attachments/2024-07-23t122310686z-short.webp)
Follow Us