Advertisment

দশমীতে বিসর্জন নয়, হয় আবাহনের মন্ত্রোচ্চারণ, বহমান গুসকরার জমিদার বাড়ির ঐতিহ্যের রীতি

কালের নিয়মে হারিয়ে গিয়েছে অনেক ঐতিহ্য, কমেছে জৌলুস। তবে গুসকরার চোঙদারবাড়ির দুর্গাপুজোতে এখনও নানা রকমের রীতি-রেওয়াজ প্রচলিত আছে।

author-image
Joyprakash Das
New Update
Not immersion in Dashmi, but chanting of invocations, flowing Guskara zamindar house tradition

গুসকরার চোঙদার বাড়ির দুর্গাপুজো। ছবি: জয়প্রকাশ দাস

চারমহলা ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপুজোর আসর মাতিয়ে গিয়েছেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। এসেছেন আরও অনেক প্রখ্যাত শিল্পী। এখানে চলতো নাটক-যাত্রাপালাসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পাত পেরে খাওয়া-দাওয়া সারতেন ষোলোআনা গ্রামের লোকজন। সেই সব শুধু রয়ে গিয়েছে স্মৃতির পাতায়। কালের নিয়মে হারিয়ে গিয়েছে অনেক ঐতিহ্য, কমেছে জৌলুস। তবে গুসকরার চোঙদারবাড়ির দুর্গাপুজোতে এখনও নানান রকমের রীতি-রেওয়াজ প্রচলিত আছে। রয়েছে নানা প্রথা, অভিনবত্ব। এখনও পুজো দেখতে আর ইতিহাসের আস্বাদন নিতে সপ্তমী থেকেই মানুষজন ঢুঁ দেন এই জমিদার বাড়িতে।

Advertisment

ঠাকুরবাড়ির দালানে ইতস্তত ঘুরে বেরাচ্ছেন কেউ কেউ। মূর্তিকে প্রণাম করছেন, পাশাপাশি প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো ঠাকুরবাড়ির পিলার, দোতলার বাড়ান্দায় ঘুরে বেরিয়ে অতীতকে ছুঁতে চাইছে এখনকার প্রজন্ম। সোমনাথেশ্বর চোঙদারের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির দালানে বসেই কথা হচ্ছিল। অতীতের নানা কাহিনী তুলে ধরছিলেন তিনি। সোমনাথেশ্বর কথায়, 'রাজা বিক্রমাদিত্যর সময়কাল থেকে দেখতে হবে। সেই সময় আমাদের বংশধরেরা এখানে এসেছিলেন। তখন উজ্জয়নী সাম্রাজ্যের সামিল। বীরভূম খন্ড অন্তর্গত বঙ্গচত্র সামিল ছিল এই এলাকা তথা মঙ্গলকোট অধ্যুষিত। বর্ধমান পরে হয়েছে। পুরনো পুঁথির গবেষণা করলে তা বেরিয়ে আসবে।'

publive-image
চোঙদার বাড়িতে চলছে পুজো। ছবি: জয়প্রকাশ দাস

চোঙদারদের পুজো সঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা জানা যায়নি। সোমনাথবাবুর দাবি, 'পুঁথি অনুযায়ী প্রায় সাতশো বছর আগেও হতে পারে। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ এখানে এসেছিলেন। পুজোর কটা দিন যাত্রা, নাটক, থিয়েটার সবই চলত। কলকাতার বড় বড় নাট্য সংস্থা এখানে মঞ্চস্থ করতে আসতো। এখন যাত্রা, নাটক, থিয়েটর সব বন্ধ। এখনও অতিমারির একটা বিরাট প্রভাব আমাদের ওপর পড়ল। আগে মেষ, মোষ ও ছাগবলি হত। এখন চালকুমরো, আখ বলি হয়। সামর্থে কুলোচ্ছে না। গ্রাম ষোলোআনা নিমন্ত্রিত হত। হাজার পঞ্চাশেক লোক তো হবেই।'

publive-image
চলছে পুজোর তোড়জোড়।

এই পুজোতে নানা আচার-প্রথা রয়েছে। দশমীর পুজোর পর এই মন্দিরেই শ্রাদ্ধ-শান্তি হয়। পুজোর ঘট বিসর্জন হয় না। আবারন হয়। পুজোতে বসেন পরিবারের এক সদস্য, আর গুরু বাড়ির পুরোহিত।শ্যামল চোঙদার বলেন, 'সপ্তমীর দিন হোম জ্বালানো হয়। তা নবমীর দিন রাতে পুন্যার্হুতি দেওয়া হয়। শুনেছি দশমীর দিন দুর্গাপুজো শেষ হওয়ার পর এই ঠাকুরবাড়িতে দেহ রাখেন আমাদের পূর্ব পুরুষ চতুর্ভুজ চোঙদার। এই সংবাদ পেয়ে সেখানে আসেন তাঁর স্ত্রী বিদ্যাধরী দেবী। তিনিও এই মন্দিরে প্রাণ ত্যাগ করেন। তাই এখনও দশমীর পুজো শেষ হওয়ার পর তাঁদের উদ্দেশে শ্রাদ্ধ-শান্তি করা হয়। তারপর নবপত্রিকাকে পুকুরে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু ঘট আমাদের বিসর্জন করা হয় না। ওই ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয় আমাদের কূলদেবতা ভৈরবনাথের মন্দিরে। পরের বছর ষষ্ঠীর দিন ঘট জলে দেওয়া হয়। ফের সপ্তমীর দিন ঘটস্থাপন করা হয়। নবপত্রিকা জলে দিলেও বিসর্জনের মন্ত্রোচ্চারণ করা হয় না। আবাহনের মন্ত্রোচ্চারণ হয়।'

publive-image
জমিদার বাড়িতে পুজোর আড্ডা। ছবি: জয়প্রকাশ দাস

এই জমিদার বাড়িতেও কুমারী পুজো প্রচলিত আছে। কিন্তু তারও বিশেষত্ব আছে। শ্যামলবাবু জানান, অষ্টমী পুজো শেষ হওয়ার পর কুমারী পুজো হয়। তবে কুমারী আগে থেকে ঠিক করা হয় না, আবার তাকে ব্রাহ্মণ হতে হবে এমন কোনও মানে নেই। অষ্টমীপুজোর পর এই ঠাকুর বাড়ির দালান থেকেই কুমারী বেছে নেওয়া হয়। তাঁকেই কুমারী রূপে পুজো করা হয়। এই প্রথম এখনও চালু রয়েছে।

পুজোতে চোঙদার বাড়ির পুরুষরা ফল কাটে, ফুলের মালা তৈরি করে। মহিলারা ভোগ রান্না করেন। বাড়ির বধূ মল্লিকা চোঙদার বলেন, 'পুজোর দিনগুলো ব্যস্ততা, হইহুল্লোড় করে কেটে যায়। কোভিড উৎসবের মেজাজ কিছুটা নষ্ট করেছে। আমার এটা শ্বশুরবাড়ি। ৩২ বছর এসেছি। এখানে একটা আভিজাত্য আছে। ছেলেরা ফল কাটে, মালা তৈরি করে, বউয়েরা ভোগ রান্না করে। একসময় মহিলারা পর্দানসীন ছিলেন। লোকে বলে চোঙদার নয়, বাবুবাড়ির পুজো।' তিনি জানান, পুজোয় ষোল থালা ভোগ দেওয়া হয়। দিনে গোবিন্দ ভোগ, তিনরকম ভাজা, দুরকম তরকারি, মুগের ডাল, পায়েস ও মাছের টক। অষ্টমীতে খিচুরি ভোগে থাকে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় দেওয়া হয় ওল, পায়েস, লুচি, অরহরের ডাল, নাড়ু, ক্ষীর, চানা।

আরও পড়ুন- বাংলাদেশে দুর্গামণ্ডপে দুষ্কৃতী হামলা, প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি শুভেন্দুর, নিন্দা তৃণমূলের

বর্ধমান মহারাজাধিপতির অধীন চোঙদার জমিদারদের পারিবারিক জমির পরিমান ছিল সাড়ে সাত লক্ষ হেক্টর। জানান সোমনাথেশ্বর চোঙদার। একটা সময় যে চোঙদারদের যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্যি ছিল তা ঠাকুরবাড়ি, রান্না বাড়ির পরিসরে স্পষ্ট প্রমাণ আছে। সোমনাথবাবুর কথায়, তারাপ্রসন্ন চোঙদার রাজ্যাভিষেকের সময় বর্ধমানের মহারাজাধিরাজপতিকে ১০০১টি মোহর দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। এখন নাটক নেই, যাত্রাও নেই, নেই সেই আয়োজন, জাঁকজমক অনেকটাই কমে গিয়েছে। তবে এই পরিবারের যাঁরা কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন তাঁরা পুজোর চারটে দিন বাড়িতে হাজির হয়ে যান। জমিদারবাড়ির পুজোর ঐতিহ্য রক্ষা করতে চেষ্টার কসুর করছে না বর্তমান প্রজন্ম। 

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

West Bengal East Burdwan Durgapuja 2021
Advertisment