Sandeshkhali: সন্দেশখালি। শুধু বঙ্গ রাজনীতি নয়, দেশের রাজনীতির চর্চায় শিরোনামে উত্তর ২৪ পরগনার এই দ্বীপভূমি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়রা রোজদিন প্রচারে এই দ্বীপভূমির নাম নিচ্ছেন। সেই দ্বীপাঞ্চল দিনভর ঘুরে দেখল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা। কেমন আছে সন্দেশখালি? এখানকার ১৫টি বুথে ১৪,৯৬৭ জন ভোট দেবেন আগামী ১ জুন। এখন জোরকদমে প্রচার চলছে পুরো দ্বীপাঞ্চলজুড়ে।
সন্দেশখালি দ্বীপ থেকে এবার আন্দোলনকারী রেখা পাত্রকে বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করে চমকে দিয়েছে বিজেপি। এই দ্বীপের বাসিন্দা নিরাপদ সরদার সিপিএমের প্রার্থী। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হাজি নুরুল ইসলাম। সন্দেশখালির পাত্র পাড়ায় বাড়ি বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্রর। ভোটপ্রচারে ব্যস্ত থাকায় এখন রেখা পাত্র সহ পরিবারের কেউ এই বাড়িতে থাকছেন না। তাঁরা বসিরহাটে থাকেন। পাত্রপাড়ায় রেখার ছিটে বেড়ার বাড়ি। রেখা পাত্রর বাড়ির পাশেই দেখা হল একদল মহিলা বিজেপির কর্মীর সঙ্গে। তাঁরা সন্দেশখালির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে জানালেন।
সন্দেশখালির বিজেপি মণ্ডল সভাপতির ভাইরাল ভিডিও নিয়ে রানি বারুই বলেন, "টাকা পয়সা দিয়ে ফেক ভিডিও করা হচ্ছে। পুলিশ তাদের সহযোগিতা করছে। মুখের কাছে থানা থাকলেও পুলিশ কোনও নিরাপত্তা দিতে পারছে না। তাঁরা সাধারণের কোনও সহযোগিতা করছে না।" রানি দেবীর বক্তব্য, "একজন মহিলা শ্লীলতাহানীর অভিযোগ করে ঘটনা সত্যি বলেই। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কেউ কি মিথ্যা অভিযোগ করতে পারে? সত্যি ঘটনাকে সাজানো বলা হচ্ছে। প্রয়োজনে সিবিআই তদন্ত হোক। কে আমাদের নিরাপত্তা দেবে? এখানে সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থাও খুব খারাপ। না খেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। শুধু তাই না হুমকি দিচ্ছে, ব্যাগ গুছিয়ে রাখতে বলছে। গ্রামে থাকা চলবে না। রাতে দরজায় লাথি মারা হচ্ছে।"
৫ জানুয়ারি সন্দেশখালি দ্বীপ থেকে কয়েক কিমি দূরে সরবেড়িয়ায় তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানের বাড়িতে হানা দিয়েছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের আধাকারিকরা। ওই আধিকারিকদের ওপর হামলা চালিয়েছিল শাহজাহানের অনুগামীরা। পরে ৩১ জানুয়ারি সন্দেশখালিতে জমির দখল নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। তৃণমূল, বিজেপি ও সিপিএম নেতৃত্বের দাবি ওই আন্দোলন ছিল প্রকৃতই গণআন্দোলন। সব দলের কর্মী-সমর্থকরা ওই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।
আন্দোলনকারী সুমিতা পাত্র বলেন, "সন্দেশখালির মা বোন, ভাই বাবাদের ওপর অত্যাচারের জবাব মিলবে লোকসভা ভোটে। গত ১০ বছর ধরে অত্যাচার চলছে। ভোট মিটলে ফের মারধর চলবে বলে হুমকি দিচ্ছে। মিথ্যে কেস দিচ্ছে। তৃণমূলের অত্যাচার সবাই দেখছে। আমাদের কোনও নিরাপত্তা নেই। থানার পাশে বাড়ি থাকলেও কোনও নিরাপত্তা নেই। অনেকেই বাড়িতে থাকতে পারছে না। মিথ্যা কেসে জর্জরিত। এখানে আবাস যোজনার বাড়ি পায়নি বেশিরভাগ লোকই। যারা তৃণমূল নেতাদের পিছনে ঘুরছে তাঁরা পেয়েছে। আমাদের বিশ্বাস নরেন্দ্র মোদীর হাত আমাদের মাথার ওপর আছে। আমরা বিচার পাবই।"
সন্দেশখালির দোতলা তৃণমূল কার্যালয় তালাবন্ধ। নির্বাচন উপলক্ষ্যে বাজারের মধ্যে দোকান ভাড়া নিয়ে অস্থায়ী দলীয় কার্যালয় করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। দুপুরে সেই অফিসে গিয়ে দেখা গেল সন্দেশখালি অঞ্চলের তৃণমূল কংগ্রেসের আহ্বায়ক অচ্যুতানন্দ নস্কর, সন্দেশখালি ২ পঞ্চায়েত সমিতির সহসভাপতি মহেশ্বর সরদাররা বসে আছেন। ডাঁই হয়ে আছে দলীয় পতাকা। তবে এই তৃণমূল নেতৃত্বকে দীর্ঘ দিন দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল দলের কার্যক্রম থেকে। একথা স্বীকার করেছেন অচ্যুতানন্দ থেকে মহেশ্বরবাবু সকলেই। দলের দুর্দিনে ফের নির্বাচনের মুখে দায়িত্ব নিয়েছেন এই আদি তৃণমূলীরা।
এখানে তৃণমূল নেতৃত্ব জেলবন্দি। অত্যাচার থেকে নানা অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের বিরুদ্ধে। মহেশ্বর সরদার বলেন, "তিন মাস আগে যা ঘটেছিল তা মেরামত করেছি। আমরা পুরনো টিম কাজ করছি। দুয়ারে দুয়ারে যাচ্ছি। এখানে ১৫টা বুথ। মহিলাদের সাড়া পাচ্ছি। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের ভূমিকা আছে। বিজেপি মানে জব কার্ডের টাকা বন্ধ করে দেওয়া। কারও সঙ্গে চড়া ভাবে কথা বলিনি। ওরা নেতাদের বাড়িতে গিয়ে মারধর করেছে। বিধায়ক সুকুমার মাহাতোকে হেনস্থা করা হয়েছে।"
প্রথম দিন থেকে তৃণমূলে আছেন অচ্যুতানন্দ নস্কর। মাঝে দলের কোনও কর্মসূচিতে ডাকও পাননি, দলীয় নেতৃত্ব কোনও পাত্তাই দিত না তাঁকে। তিনিও নেমে পড়েছেন দলের কার্যক্রমে। তিনি দলে বঞ্চিত ছিলেন সেকথা স্বীকারও করেছেন অচ্যুতানন্দ। তিনি বলেন, "মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসকেই ভোট দেবে। প্রথম আন্দোলনে তৃণমূলের লোকজন ছিল। সাদা কাগজে সই করিয়ে নিচ্ছে মিথ্যা কেস হয়েছে। দলকে ভালোবাসি। দল বিপদে পড়েছে তাই ফের এলাম। দলের যে ক্ষতি হচ্ছিল তার জন্য কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু দুঃখ আক্ষেপ নেই। তাই দুর্দিনে আমরা সবাই আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছি দলকে সঠিক পথে আনার জন্য।"
এদিকে, দ্বীপাঞ্চলে সিপিএম কার্যালয় আগলে রেখেছেন সন্দেশখালি ২ এরিয়া কমিটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সুভাষ সরদার। তাঁর দাবি, "প্রথম দিকের গণ আন্দোলনে বিজেপি, তৃণমূল ও সিপিএম সবাই ছিল। ১০ ফেব্রুয়ারির পর রাজনৈতিক রং লাগে। আমাদের প্রার্থী নিরাপদ সরদারকে তখন গ্রেফতার করা হয়েছিল। আমিও জামিন নিয়ে নির্বাচনে কাজ করছি। আমাদের প্রচার চলছে।" তবে মহিলাদের ওপর অত্যাচারের বিষয় নিয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করেননি।
আরও পড়ুন- Suvendu on Arjun: অর্জুনকে হঠাৎ সাবধানে থাকার পরামর্শ শুভেন্দুর, কেন জানেন?
সন্দেশখালি দ্বীপের তিন দিকে খেয়া ঘাট রয়েছে। এখানকার ত্রিমনী বাজার জমজমাট। পাশেই রয়েছে সন্দেশখালি থানা। দিনভর ভিড় লেগেই থাকে সন্দেশখালি খেয়া ঘাটে। বাইরের লোক দেখলে এখানকার মানুষজন এখন একটু সন্দেহের চোখেই দেখছে। কাউকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। অমানুষ, বান্ধবীসহ বিভিন্ন বাংলা সিনেমার শুটিং হয়েছে উত্তর ২৪ পরগণার এই দ্বীপেই। পরিবেশের অমোঘ আকর্ষণে চোখ টানবেই সন্দেশখালি। কিন্তু মহিলাদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ থেকে ভাইরাল ভিডিও, গ্রেফতার থেকে সংঘর্ষ, নিরাপত্তার অভাব বোধ সব মিলিয়ে ঘেঁটে গিয়েছে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের দ্বীপ সন্দেশখালি। এখন সেখানে শুধুই সন্দেহের বাতাবরণ। এমন আবহেই আগামী ১ জুন এই দ্বীপে নির্বাচন। ওই দিন কতটা শান্তিতে ভোট সম্পন্ন হয় সেদিকে তাকিয়ে আছে প্রশাসন থেকে সন্দেশখালির সাধারণ মানুষ।