গা শিউরে ওঠার মতো ঘটনা রামপুরহাটের বগটুই পূর্ব পাড়া গ্রামে। তৃণমূল নেতা খুনের পরেই একের পর এক বাড়িতে আগুন। পুড়ে মৃত্যু মহিলা, শিশু-সহ আটজনের। গতকাল রাতের এই ঘটনার পর আজ দিনভর থমথমে গোটা গ্রাম। নেতা-মন্ত্রী, পুলিশ, সংবাদমাদ্যমের কর্মীদের ভিড়েও যেন এক অদ্ভুত বিষন্নতা। ঠিক কী ঘটেছিল গতকাল রাতে? প্রকাশ্যে বিশেষ কেউ কিছুই বলতে রাজি নন।
প্রায় পুরুষশূন্য বগটুইয়ে মঙ্গলবার দিনভর মহিলাদের উপচে পড়া ভিড়। চোখে-মুখে একরাশ আতঙ্ক। গতকালের রাতের ভয়াবহ সেই স্মৃতি তাড়া করে বেড়াচ্ছে গোটা বগটুইকে। এখনও পর্যন্ত আটটি অগ্নিদগ্ধ দেহ উদ্ধার হয়েছে। রামপুরহাট হাসপাতালের মর্গে রাখা আছে দেহগুলি। সন্ধে পর্যন্ত সেই দেহগুলির কোনও দাবিদারের হদিশ মেলেনি। একমাত্র এক মহিলা ছাড়া আর কারও দেহ শনাক্তও করা যায়নি।
সোমবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বগটুই মোড়ে খুন হন বড়শাল পঞ্চায়েতের উপ প্রধান ভাদু শেখ। বছর আটত্রিশের এলাকার দাপুটে তৃণমূল নেতা ভাদুকে লক্ষ্য করে বোমা ছোড়ে বাইকে চেপে আসা দুষ্কৃতীরা। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ভাদুর। ভাদু খুনের পরেই এলাকায় ক্ষোভের আগুন জ্বলতে থাকে। বগটুই মোড়ে কয়েকশো গ্রামবাসী জড়ো হয়ে যায়। এরপরই শুরু 'অপারেশন'। অভিযোগ, ভাদু অনুগামীরা চড়াও হয় অভিযুক্তদের বাড়িতে। তৃণমূল নেতা ভাদু শেখকে খুনের অভিযোগ তাঁরই প্রতিবেশী সোনা শেখ, ফটিক শেখ-সহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে। গতরাতে ভাদু খুনের পরপরই সোনা, ফটিক-সহ কয়েকজন অভিযুক্তের বাড়িতে চড়াও হয় নেতার অনুগামীরা। পরপর বেশ কয়েকটি বাড়িতে তারাই আগুন ধরিয়ে দেয় বলে অভিযোগ।
আগুনে ভস্মীভূত বগচুই গ্রামের সোনা শেখের বাড়ি। নিহত তৃণমূল নেতার বাড়ির উল্টোদিকের একটি বাড়ি পরেই এই সোনার বাড়ি। মঙ্গলবার সকালে সোনা শেখের বাড়ি থেকেই পুলিশ সাতটি অগ্নিদগ্ধ দেহ উদ্ধার করেছে। গোটা বাড়িটি পুলিশ দড়ি দিয়ে ঘিরে রেখেছে। সোনা শেখের বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। আইজি পশ্চিমাঞ্চল-সহ পুলিশের শীর্ষকর্তারা বাড়িটি ঘুরে দেখেছেন।
আরও পড়ুন- ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্র, রাজ্যকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা’, রামপুরহাট কাণ্ডে বললেন পার্থ
গতরাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় ফটিক শেখের বাড়িতেও। ফটিকের বাড়িতে আজ সকালেও আগুনের উত্তাপ টের পাওয়া গিয়েছে। এই বাড়ি থেকেই আরও একটি দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সকালে ফটিকের বাড়িতে ব্যবহার হওয়া একটি সুতলি বোমা পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। পুলিশ এদিন মোট আটটি অগ্নিদগ্ধ দেহ উদ্ধার করেছে বগটুই পূর্ব পাড়া গ্রাম থেকে।
নাম প্রকশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ আধিকারিকের বক্তব্য, ''দমকল আগুন নিভিয়ে আসার পরেও কিছু বোঝা যায়নি। আজ সকাল ৬টার পর ওই বাড়িগুলি থেকে দেহগুলি উদ্ধার করা হয়েছে। সম্ভবত রাতভর আগুনে পুড়েছে দেহগুলি।'' এদিকে, ফটিকের বাড়িতে বোমা পড়ে থাকতে দেখে অনুমান, আগুন লাগানোর সময় সম্ভবত বোমাও ছোড়া হয়েছে।
আরও পড়ুন- রামপুরহাট-কাণ্ডের রিপোর্ট তলব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের, বাংলায় আসছে কেন্দ্রীয় দল: সুকান্ত
অন্যদিকে, এদিন দুপুরেই গ্রামে ফেরে নিহত তৃণমূল নেতা ভাদু শেখের দেহ। ভাদুর বাড়িতে তাঁর নিথর দেহ আনা হলে উত্তপ্ত হয় পরিস্থিতি। যদিও প্রবল ভিড় সামাল দেন পুলিশকর্মীরা। ফিরহাদ হাকিম, অনুব্রত মণ্ডলরা গিয়ে নিহত তৃণমূল নেতার স্ত্রী, বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। দোষীদের কোনওভাবেই রেয়াত করা হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন ফিরহাদ হাকিম।
আরও পড়ুন- রামপুরহাট ‘গণহত্যা’: ‘বাংলায় প্রতিদিন খুন, তৃণমূলের ঝাণ্ডা ধরেও নিরাপদ নন কেউ’, তোপ সেলিমের
ভাদু শেখের বাবা মারফত হোসেন। চুরাশি বছরের এই বৃদ্ধ এখনও আমিনের কাজ করেন। গত বছর তাঁর বড় ছেলে বাবরও খুন হয়েছিলেন। বাবরকে খুনে অভিযুক্তরাই তাঁর আর এক ছেলে ভাদুকে খুন করেছে বলে দাবি বৃদ্ধের। তিনি এদিন বলেন, ''এর আগে এরাই গত বছরের ৫ জানুয়ারি আমার আরও এক ছেলে বাবর শেখকে খুন করেছিল। এবার ভাদুকে মারল। আমার দুই ছেলে ছাড়াও রাজেশ শেখ ও বাপি মণ্ডলকেও এরাই খুন করেছিল। ওরা তৃণমূল করে।'' ছেলেকে খুনে অভিযুক্তদের ফাঁসি চান বৃদ্ধ বাবা।
প্রথম জীবনে গাড়িচালক ছিলেন নিহত ভাদু শেখ। পরবর্তী সময়ে পোল্ট্রির ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে শাসকদলের নেতা হয়ে বেশ কয়েকটি ব্যবসাও বাড়িয়েছিলেন তিনি। বড়শাল পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ভাদু শেখকে খুনে অভিযুক্ত সোনা শেখ, পলাশ শেখ, ফটিক শেখ, মিল্টন, মাসাদ শেখ, সঞ্জু শেখ, মাহি শেখ। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এরা তৃণমূলেরই একটি অন্য গোষ্ঠী। তবে ঘটনার পর থেকে কারও হদিশ নেই। এদিকে, বাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনায় মোট ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি মনোজ মালব্য।