Advertisment

লকডাউনে বীরভূমের গ্রামে বসে পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘মসিহা’ সাদিকুল

"জনপ্রতিনিধি, বিডিও, জেলাশাসক, মুখ্যমন্ত্রীর দফতর, প্রধানমন্ত্রীর দফতর প্রয়োজনে আমরা রাষ্ট্রপতির দফতরেও যোগাযোগ করে অনেক সমস্যার সমাধান করেছি।"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
team sadikul

বাদিক থেকে নাসিরুদ্দিন আনসারী, সাদিকুল ইসলাম ও মহম্মদ নুর আলম।

পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে রাজ্য-রাজনীতি উত্তাল। তৃণমূল,বিজেপি, কংগ্রেস ও সিপিএম প্রতিটি রাজনৈতিক দল যখন এঁদের নিয়ে নানা দাবি-পাল্টা দাবিতে ব্যস্ত, তখন দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে নীরবে পরিযায়ীদের জন্য কাজ করে চলেছেন বীরভূমের মুরারইয়ের প্রত্যন্ত গ্রাম কাশিমনগরের সাদিকুল ইসলাম। সঙ্গে সাজ-সরঞ্জাম বলতে দুটো ল্যাপটপ, ইন্টারনেট, মোবাইল, কিছু কাগজ। ব্যস। নিজেরা এক টাকা খরচ না করেও সারা ভারতে প্রায় ১ লক্ষ পরিযায়ীর মুখে অন্ন তুলে দিয়েছেন এই তিন ‘মসিহা’’।

Advertisment

মম্বাইয়ের ভিরার ইস্ট নলেশ্বরনগরের ৮ মাসের দুধের শিশুর খাবার জুটছে না। লকডাউন শুরুর পর বেশ কিছু দিন ধরেই তাঁদের পরিবারে খাবারের সংকট চলেছে। সাদিকুলের বন্ধু নুর আলমকে ফোন করে বিষয়টি জানায় রিঙ্কি বিবি। তৎপর হয়ে ওঠে টিম সাদিকুল। সাদিকুল বলেন, "আমরা জানতে পারি শিশু সহ ওই পরিবারের খাবারের সমস্যার কথা। কমিউনিটি কিচেন ছিল বেশ দূরে। বাচ্ছা নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। বিষয়টি নিয়ে সেখানকার জোনের জেলাশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সরকারের কাছে ল্যাকটোজেন ছিল না। একটা এনজিও ল্যাকটোজেন ও দুধ দিয়ে আসে। তখনকার মত ক্ষুধা মেটে কোলের শিশুটির।" রামপুরহাটের তারাপীঠ থানা এলাকার বাসিন্দা রিঙ্কি বিবি বলেন, "স্বামী দিনমজুরের কাজ করেন। লকডাউনে খাবার প্রায় জুটছিল না। বাচ্চার খাবারও জুটছিল না। এঁদের যোগাযোগের মাধ্যমে লকডাউনে দুবার ল্যাকটোজেন দিয়েছিল। আমার দুটো বাচ্চা- আট মাসের ও তিন বছরের।"

আরও পড়ুন- ‘মমতাকে যত মুসলিম বানাবে তৃণমূলের তত ভোট বাড়বে’

"ওয়ার্ক ফ্রম হোমের সঙ্গে লকডাউনে পরিযায়ীদের জন্যই কাজ করেছি", বলেন সাদিকুল। সঙ্গী ছিলেন নুর আলম ছাড়াও নাসিরুদ্দিন আনসারী। সাদিকুল জানান, প্রথম ফোন আসে হাওড়ার আমতা থানা এলাকা থেকে। সেখানে কর্মরত শ্রমিকরা জানায়, তাঁদের সুপারভাইজাররা চাল, ডাল নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক কেউ খেতে পারছে না। আমতার বিডিও ও হাওড়ার এসডিওকে বিষয়টা জানানো হয়। সেদিন দুপুরে তাঁরা খেতে পায়নি। বিকেলেও কেউ সেখানে যায়নি। পরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট জানিয়ে দেয় তাঁদের খাবার পৌঁছানো গিয়েছে।

কীভাবে বাইরের শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়? সাদিকুলের কথায়, "প্রথমত সোশাল মিডিয়ার পোস্ট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে যোগাযোগ করেছি। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে জানিয়েছি। পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে ডেটা সংগ্রহ করেছি। তাছাড়া আমাদের তিন জনের ফোন নাম্বার ভিন রাজ্যের শ্রমিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। কাজের জন্য হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপও করে ফেলেছিলাম।"

আরও পড়ুন- অন্ডালের কোলিয়ারিতে ধস, হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল বাড়ি, আটকে এক মহিলা

এই রাজ্য ছাড়াও কেরালা, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কর্নাটক, তেলেঙ্গানা, ওড়িশা, আসাম, দিল্লি থেকে ফোন এসেছে সাদিকুলদের কাছে। সাদিকুল বলেন, "ফোন আসতেই আমরা সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করি। জনপ্রতিনিধি, বিডিও, জেলাশাসক, মুখ্যমন্ত্রীর দফতর, প্রধানমন্ত্রীর দফতর প্রয়োজনে আমরা রাষ্ট্রপতির দফতরেও যোগাযোগ করে অনেক সমস্যার সমাধান করেছি। প্রয়োজনে স্বরাষ্ট্র দফতর, ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট-এ যোগাযোগ করেছি।" সাদিকুলের কথায়, "সারা দেশের মধ্যে সব থেকে কাজ করতে সুবিধা হয়েছে কেরালায়। বেশি অসুবিধা হয়েছে তামিলনাড়ু ও মহারাষ্ট্রে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে অসহযোগিতা পেয়েছি। কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি। সব মিলিয়ে প্রায় ১ লক্ষ পরিযায়ীকে পরিষেবা দিতে পেরেছি।"

সাদিকুল কেরালার প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন, "সেখানে একবার বিধায়ক বা সাংসদদের ফোন করেই কাজ হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয়বার কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়নি। পরিযায়ীরা পঞ্চায়েতে হাজির হলেই তাঁরা যত জনের কথা বলত ততজনের খাবার দিয়ে দিত। কোনও প্রশ্ন করত না। শ্রমিকরা ফোন করলেও একই ভাবে সাড়া পেত বিধায়ক-সাংসদদের কাছ থেকে। কান্নুর জেলা সহ অন্যত্র বাংলার শ্রমিকরা রয়েছে। সেখানে শুধু লিষ্ট পাঠাতাম আর খাবার পৌঁছে যেত।"

সাদিকুলরা দেড় বছর আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সাধারণ মানুষ সরকারি পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হলে তাঁদের পাশে দাঁড়াবে। সে আধার কার্ডের সমস্যা হোক বা থানায় অভিযোগ না নেওয়াই হোক। বীরভূমের কাশিমনগর দক্ষিণ পাড়ার আদিল হোসেন ব্যাঙ্গালুরু আরবান এলাকার জিএনএম ইন্সটিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কোথানুর পুলিশ স্টেশনের কাছে তাঁদের ইন্সটিটিউট। আদিল বলেন, "বাড়ি ফেরার সময় সাদিকুলরা যোগাযোগ করে আমাদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করেছিল। আমাদের কর্তৃপক্ষও অবাক হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা সেখানে থেকে যা করতে পারেনি, মুরারইয়ের প্রত্যন্ত গ্রামে থেকে সে কাজ হয়েছে। বিশ্বাস হয়নি বলে স্কুল কর্তৃপক্ষ থানায় গিয়েছিল বিষয়টা সত্যি না মিথ্যা তা জানতে। সেই পরিস্থিতিতে সাদিকুলদের ভূমিকা কোনও দিন ভুলতে পারব না।"

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Birbhum corona Lockdown Migrant labourer
Advertisment