Mob Lynchings in Bengal: বছর পঁচাত্তরের ভগবতী মণ্ডল তাঁর নাতি প্রসেনকে (২৬) বিধাননগরের ইলেক্ট্রনিক কমপ্লেক্স থানার পোলেনাইটে স্থানীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাছে একটি গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় দেখেন। প্রথমটায় নাতির রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত শরীরটা যেন চিনতেই কষ্ট হচ্ছিল বৃদ্ধার।
তাঁর আশেপাশে দাঁড়ানো জনা চারেক লোক তখনও যুবককে মেরে চলেছে। সেদিনের সেই ঘটনার বিবরণে বৃদ্ধা বললেন, “আমি তাঁদের থামাতে এবং ওকে রেহাই দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছি। তারা আমার কথায় কান দেয়নি। ওকে গাছের ডাল দিয়ে মারতে থাকে। আমি ছুটে গেলাম প্রতিবেশীদের ডাকতে। আমি যখন ফিরে এলাম, ততক্ষণে ও মারা গিয়েছিল।”
প্রসেন ছিলেন বাংলায় সাম্প্রতিক গণপিটুনির শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যেই একজন। সবই শিশু চুরির গুজব রটে যাওয়ার পর থেকে ঘটতে শুরু করে। প্রসেনের ক্ষেত্রে অবশ্যা মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের অভিযোগ করা হয়েছিল। গত ১৯ জুন থেকে পরবর্তী ১৫ দিনে রাজ্যে এই ধরনের ১৩টি ঘটনায় চারজন নিহত এবং ১০ জন আহত হয়েছেন। বিরোধীরা এই ঘটনায় তৃণমূল নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
তবে রাজ্য সরকারও এই ধরনের ঘটনার প্রতিরোধে সচেতনতামূলক প্রচার শুরু করে দিয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন মহলের তরফে সোশ্যাল মিডিয়ায় এব্যাপারে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে বেশ কয়েকটি জেলায় লিফলেট বিলি করেও সচেতনতার পাঠ দিতে দেখা যাচ্ছে পুলিশ আধিকারিকদের।
এখনও অবধি, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি, বর্ধমান এবং পশ্চিম মেদিনীপুর পাঁচটি জায়গা থেকেই এই ধরনের ঘটনা সামনে এসেছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতে বাড়ির কাছে একটি অব্যবহৃত টয়লেটে পাঁচ দিন ধরে নিখোঁজ থাকা ১১ বছর বয়সী একটি ছেলের মৃতদেহ পাওয়া যায়। তারপরেই সম্ভবত এই ধরনের ঘটনার সূচনা হয়েছিল। প্রথম গত ১৯ জুন বারাসতে বেধড়ক মারধর করা হয় এক মহিলা ও এক পুরুষকে। যদিও বারাসতে নিখোঁজ বালকের মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনায় তার কাকা আনজিব নবীকেই অবশেষে গ্রেফতার করে পুলিশ। জেরায় ধৃত ভাইপোকে খুনের কথা স্বীকার করে বলে দাবি করেছে পুলিশ।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্যাতনে নিহতদের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করেছেন। সেই সঙ্গে গত কয়েকদিনে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এই ধরনের গণপিটুনির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৫০ জনেরও বেশি লোককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
হুগলির (গ্রামীণ) পুলিশ সুপার কমনাশিস সেন বলেন, “সচেতনতামূলক অভিযান এক সপ্তাহ ধরে চলছে। আমরা থানার ফোন নম্বর দিয়েছি এবং সন্দেহজনক কিছু দেখলে অবিলম্বে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে জনগণকে বলেছি।" এদিকে, এই সপ্তাহের শুরুতে রাজ্য বিধানসভায় একটি ভাষণে অধ্যক্ষ বিমান বন্দোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ (লিঞ্চিং প্রতিরোধ) বিল, ২০১৯-এ স্বাক্ষর করতে গিয়ে রাজভবনের হেলদোলহীন আচরণের জন্যই এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা বাড়ছে বলে দাবি করেছিলেন। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে রাজ্য বিধানসভায় মব লিঞ্চিং প্রতিরোধ বিল পাশ হয়েছিল। বিলটি এখনও রাজ্যপালের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। “বিলে রাজ্যপালের স্বাক্ষর করা উচিত ছিল। যদি এটা হতো, আমরা হয়তো বাংলায় মব লিঞ্চিং দেখতে পেতাম না,” এপ্রসঙ্গে এমনই বলেছেন অধ্যক্ষ বিমান বন্দোপাধ্যায়।
তবে বিরোধী দলগুলি রাজ্যে গত কয়েকদিনের এই গণপিটুনির ঘটনায় প্রশাসনকেই কাঠগড়ায় তুলেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বঙ্গ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, “একের পর এক এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। পুলিশ টেলিস্কোপ দিয়েও অপরাধীদের ধরতে পারছে না। তারা কোথায়? কী সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে (এটি প্রতিরোধ করার জন্য)? কেউ জানে না।”
আরও পড়ুন- Chingri Malaikari: ইলিশকে ‘বলে বলে গোল’ চিংড়ির, বিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করল দেশের, জানলে গর্ব হবে!
'তারা তাকে পশুর মতো মারধর করেছে'
ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানার পোলেনাইটে নিহত প্রসেন মণ্ডলের প্রতিবেশী অসীমা সরকার বলেন, “যে তিনজন ছেলেটিকে মারধর করেছে তারা স্থানীয় এবং তাকে চিনত। আমরা যখন সকালে পৌঁছোলাম, ততক্ষণে ও মারা গিয়েছিল।” বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ আধিকারিক জানিয়েছেন, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বারাসতের আমডাঙার প্রভাকরকাটি গ্রামের ৩৪ বছর বয়সী নেহরা বানুকে গত ১৯ জুন শিশু চুরির অভিযোগে বেধড়ক মারধর করা হয়েছিল। তিনি এবং তাঁর এক আত্মীয় কাজিপাড়ায় একটি রেস্তোরাঁ খুঁজছিলেন। তখনই কিছু লোক 'শিশু চোর' সন্দেহে তাদের উপর চড়াও হয়। প্রতিবাদ সত্ত্বেও তাদের বেধড়ক মারধর করে বেশ কিছু লোকজন। নেহরার কথায়, “আমি তাদের বলেছিলাম আমি দুই সন্তানের মা। কিন্তু তারা শোনেনি… তারা আমাকে লাঠি এবং লোহার রেঞ্জ দিয়ে মেরেছিল।” অবশেষে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে বারাসাত হাসপাতালে ভর্তি করে। যেখানে সে পাঁচ দিন ভর্তি ছিল। বারাসতের এই ঘটনায় এক মহিলা-সহ ১৮ জনকে আটক করা হয়েছে। নেহরার বাবা আনসার আলি বলেন, "তারা ওকে পশুর মতো মারধর করেছে। সে এখনও আতঙ্কে রয়েছে।"
এই ঘটনা সম্পর্কে যোগাযোগ করা হলে বারাসতের পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝাড়খারিয়া জানিয়েছেন যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা আমাদের সচেতনতামূলক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি। এই ধরনের গুজব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে বিভিন্ন এলাকায় লাউডস্পিকার ব্যবহার করছি।” এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত মোট ৩৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বারাসত থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ব্যারাকপুরের রুইয়াপাড়া। এখানকার ৩৫ বছরের প্লাম্বার নাজির হোসেন সবেমাত্র হাঁটতে পারছেন। গণপিটুনিতে তাঁর পাঁজর এবং পা ভেঙে গেছে। এছাড়াও মাথার ভিতরেও আঘাত থাকার সন্দেহ রয়েছে। গত ২১ জুন বাড়ি ফেরার পথে বাড়ি থেকে ২০ মিনিট দূরে চক কাঠালিয়া গ্রামের কাছে কিছু যুবক তাকে 'শিশু চোর' বলে সন্দেহ করে।
সেদিনের সেই অভিশপ্ত ঘটনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নাজির বললেন, “হঠাৎই তারা সবাই ‘বাচ্চা চোর, বাচ্চা চোর’ বলে চিৎকার করতে শুরু করল। আমাকে মারতে শুরু করল। আমি বলাম, যে আমার বাড়ি কাছাকাছি। আমি আমার ভাইদের ডাকতে পারি। তারা কোনও কথা শোনেনি। লোহার রড ও লাঠি দিয়ে আমাকে মারতে থাকে।” এই ঘটনায় একজনকে আটক করেছে পুলিশ।
অন্যদিকে, কলকাতার বেলগাছিয়ায় ৩৭ বছরের ইরশাদ আলমের বাড়ির লোকজনও এখনও আতঙ্কের প্রহর গুণছেন। চাঁদনী চকে একটি টিভি মেরামতের দোকানে কাজ করা আলমকে মোবাইল চোর সন্দেহে বউবাজারের একটি ছাত্রাবাসে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ইরশাদের স্ত্রী সালমা বিবি জানান, ২৬ জুন সকালে তিনি কাজে যান এবং আর ফিরে আসেননি। মহিলার কথায়, “সন্ধ্যা নাগাদ আমরা শুনেছি কি হয়েছে। আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম কিন্তু ততক্ষণে ও মারা গিয়েছিল।” বেলগাছিয়ার এই ঘটনায় ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
নিহতের স্ত্রী সালমা নিজের এবং তার দুই সন্তানের জন্য ঘোর উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন। ১১ বছরের একটি মেয়ে এবং ৭ বছরের একটি ছেলে রয়েছে তাঁর। সালমার কথায়, “আমি এবং আমার সন্তানরা এখন কীভাবে বাঁচব? তিনিই একমাত্র উপার্জনকারী সদস্য ছিলেন। আমি কীভাবে ভাড়া এবং স্কুলের ফি দেব।" ঝাড়গ্রামেও একই ঘটনা ঘটে। সেখানে ২২ জুন চোর ভেবে একজন ব্যক্তিকে মারা হয়েছিল। সে মারা গিয়েছিল। এপ্রসঙ্গে ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপার অরিজিৎ সিনহা বলেন, "দুই জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতদের খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।"
তৃণমূলের মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী বলেছেন, “আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। এই ধরনের অপরাধের অপরাধীদের জন্য জিরো টলারেন্স। পুলিশ কোনও রাজনৈতিক রং না দেখে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে এটাও একটা সত্য যে এটা একটা সামাজিক কুফল এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।”
রাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ের এই ঘটনা নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার এবং পশ্চিমবঙ্গ রেলওয়ে পুলিশের প্রাক্তন প্রধান অধীর শর্মা বলেন, “এটা নির্ভর করবে আইন কীভাবে প্রয়োগ করা হয় তার ওপর। এসব ক্ষেত্রে পুলিশের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। কিন্তু আমরা দেখেছি যে পুলিশ ও প্রশাসন এখনও পর্যন্ত খুবই অনিচ্ছুক।”
আরও পড়ুন- Sealdah Division: শিয়ালদহ ডিভিশনের যাত্রীরা এখবর এখনই পড়ুন! দুরন্ত দক্ষতায় দারুণ তৎপরতা রেলের
সাম্প্রতিক সময়ের গণধোলাইয়ের ঘটনা:
১৯ জুন: বারাসতের (উত্তর ২৪ পরগণা জেলা) কাজীপাড়ায় একজন পুরুষ ও একজন মহিলাকে মারধর করা হয়েছে। উদ্ধারে গিয়ে চার পুলিশকর্মী আহত হয়েছেন।
২১ জুন: ব্যারাকপুরের রুইয়াপাড়ার (উত্তর ২৪ পরগনা) এক যুবককে মারধর করা হয়েছে।
২১ জুন: বারুইপুরে, এক প্রতিবন্ধী মহিলা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
২১ জুন: পূর্ব বর্ধমানের একটি মেলার কাছে জনতা এক যুবককে বেধড়ক মারধর করেছে। একটি শিশু নিখোঁজ হওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর ঘটনাটি ঘটে। যুবককে উদ্ধার করেছে পুলিশ।
২২ জুন: বনগাঁ (উত্তর ২৪ পরগনা) স্থানীয়রা একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে মারধর করে। গুরুতর আহত যুবককে উদ্ধার করে বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
২২ জুন: অশোকনগরে (উত্তর ২৪ পরগনা) জনতা এক মহিলাকে মারধর করে। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।
২২ জুন: দুই যুবক, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুরের বাসিন্দা। যারা জামবনিতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ৩০ জুন এক যুবক মারধরে নিহত হয়।
২৫ জুন: হুগলির পাণ্ডুয়ার দরবাশিনীতে স্থানীয়রা এক যুবককে মারধর করে। ৩০ জুন তিনি মারা যান।
২৬ জুন: কলকাতার বউবাজারে একটি টেলিভিশন মেরামতের দোকানে কাজ করা এক ব্যক্তিকে জোরপূর্বক একটি ছাত্র হোস্টেলে ঢুকে ক্রিকেট ব্যাট ও হকি স্টিক দিয়ে মারধর করা হয়। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তার মৃত্যু হয়।
২৬ জুন: উত্তর ২৪ পরগনার বিশারপাড়ায় লোকাল ট্রেনে যাত্রীরা শিশুসহ এক মহিলাকে মারধর করেছে। মহিলাকে উদ্ধার করতে রেল পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে হয়।
২৭ জুন: বিধাননগরের ইলেক্ট্রনিক কমপ্লেক্স থানার অন্তর্গত পোলেনাইট এলাকায় ২৬ বছরের এক যুবককে রাতভর মারধর করা হয়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
২৭ জুন: পেট্রাপোলে (উত্তর ২৪ পরগনা) শিশু চোর সন্দেহে স্থানীয় যুবকরা প্রতিবন্ধী এক ব্যক্তিকে মারধর করেছে। আহত যুবককে উদ্ধার করেছে পুলিশ।
২ জুলাই: কলকাতার শিয়ালদহের এনআরএস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কাছে এক ব্যক্তিকে মারধর করা হয়। কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।