কলকাতায় ১১টি বিধানসভা আসনের সবকটি তৃণমূলের দখলে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ১১টি আসনের মধ্যে বিজেপির জয়ের সব থেকে বড় সম্ভাবনা ছিল উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো কেন্দ্র। এখানে বরাবরই বিজেপির একাধিক পুরকাউন্সিলরও রয়েছে। বিগত ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে মাত্র ৪৯ শতাংশ। নির্বাচনে স্বভাবতই পরাজিত হয়েছে বিজেপি। রাজনৈতিক মহলের মতে, এই কেন্দ্রের ফলাফলেই স্পষ্ট কলকাতায় বিজেপির সাংগঠনিক দৈন্যদশার হার। বিজেপির সর্বভারতীয় সহসভাপতি দিলীপ ঘোষের কলকাতার বাঙালি নিয়ে মন্তব্য বিতর্কের সৃষ্টি করলেও সাংগঠনিক দুর্বলতা থাকলে রাজনৈতিক ময়দানে উতরানো যে সম্ভব নয়, তা মনে করেন অভিজ্ঞ মহল।
৩১ মার্চ ২০১৬, দুপুর ১টা। উত্তর কলকাতায় গিরীশ পার্কে নির্মীয়মান বিবেকানন্দ উড়ালপুল ভেঙে পড়েছে। সামনেই রাজ্যজুড়ে বিধানসভা নির্বাচন। অবাঙালি অধ্যুষিত এই এলাকায় গেরুয়া শিবিরের প্রভাব ছিল। তারওপর সেতু ভাঙার ঘটনায় মৃত, আহত ছাড়াও অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে স্থানীয় মানুষের। রাজনৈতিক বোদ্ধাদের অনেকে ভবিদ্বানী করেছিল জোড়াসাঁকো বিধানসভা নির্বাচনে জয় পেতে পারে প্রার্থী রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতা রাহুল সিনহা। ফল প্রকাশ হতেই পরাজিত বিজেপি।
২০১৮ লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসন লাভ করে বিজেপি বাংলা জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ২০১৬ জোড়াসাঁকো বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল পেয়েছিল শতাংশ ভোট ৪২.৭৯, বিজেপির প্রাপ্তি ছিল ৩৬.৭৭ শতাংশ। ২০২১ -এ তৃণমূলের ৯.৮৮ শতাংশ ভোট বেড়ে হয়েছে ৫২.৬৭ শতাংশ ভোট। বিজেপির ভোট ৩.০৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৩৯.৩০ শতাংশে। এই আসনে ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ১১ বারের মধ্যে কংগ্রেস জিতেছিল ১০ বার। ২০০১ সাল থেকে বিধানসভা নির্বাচনে ৫ বারের মধ্যে একবারও হারেনি তৃণমূল কংগ্রেস। ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্র ২০০১ থেকে ২০২১ অবধি দুবার উপনির্বাচন সহ ৫ বার বিধানসভা ভোট হয়েছে। অবাঙালি ভোটারদের আধিক্য থাকা সত্বেও বিধানসভা ভোটে একবারও বিজেপি দাঁত ফোটাতে পারেনি।
আরও পড়ুন- চ্যালেঞ্জের মুখে মমতা সরকার, আদালতের দুয়ারে পুজোয় সরকারি অনুদানের সিদ্ধান্ত
অভিজ্ঞ মহলের মতে, কলকাতায় বিজেপি অনেকটাই অবাঙালি ভোট নির্ভর হয়ে পড়েছে। তারওপর তৃণমূলের বহিরাগত তত্বও সাড়া ফেলেছে কলকতায়। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গিয়েছে, আলিপুরের মতো অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকায়(৭৪নং ওয়ার্ড) মাত্র ৩০ শতাংশ ভোট পড়েছে। মোদ্দা কথা যে নিজেদের নিশ্চিত ভোটারদের বুথে নিয়ে যাওয়ার মতো সাংগঠনিক ক্ষমতা কলকাতায় গেরুয়া শিবিরের নেই, মনে করছে রাজনৈতিক মহল। সেক্ষেত্রে বিধানসভা নির্বাচন কেন কোনও নির্বাচনেও কলকাতায় ভাল ফল করা কঠিন বিজেপির। যদিও গত পুরনির্বাচনে সন্ত্রাস ও ভোট লুটের অভিযোগ করেছে বিজেপি।
নিজেদের নিশ্চিত ভোটারদের বুথে পৌঁছানোর জন্য বুথ ভিত্তিক সংগঠনের প্রয়োজন। রাজনৈতিক মহলের মতে, সেক্ষেত্রে কলকাতায় তেমন ভোট ম্যানেজার নেই বিজেপির নেই। সেখানে কলকাতার বিভিন্ন বস্তি বা সংখ্যালঘু এলাকায় শতাংশের হিসাবে ভোটদানের হার তুলনামূলক অনেক বেশি। সেই ভোট যে বিজেপির পক্ষে যায়নি তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
রাজনৈতিক মহলের মতে, ইডি, সিবিআই তৃণমূলের শীর্ষ নেতত্বের একাংশের বিরদ্ধে লাগাতার অভিযান চালাচ্ছে নানা ইস্য়ুতে। সাধারণ মানুষের একাংশ প্রকাশ্যে ক্ষোভপ্রকাশও করছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। কিন্তু এর ফলে তৃণমূল বিরোধী পরিবেশ তৈরি হতে পারে কিন্তু ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলতে দক্ষ সংগঠনেরও প্রয়োজন রয়েছে। এর আগে এরাজ্যে সিপিএম বা বামেরা দেখিয়েছে সাংগঠনিক শক্তির জোরে কীভাবে নির্বাচনে জেতা যায়। তা এখন পুরোমাত্রায় ফলো-আপ করছে তৃণমূল কংগ্রেস।
রাজনৈতিক মহলের মতে, সাংগঠনিক ভাবে বিজেপির রাজ্য কমিটি বা নতুন জেলা কমিটিগুলো সেভাবে আশার আলো দেখাতে পারেনি। বরং তা নিয়ে দলের অশান্তি প্রকাশ্যে এসেছে। একাধিক জ্বলন্ত ইস্যু থাকতেও রাজ্য-রাজনীতি ততটা উত্তপ্ত নয়। অভিজ্ঞমহলের মতে, কলকাতার বাঙালি ভোটারদের অধিকাংশকে নিজেদের পক্ষে টেনে আনতে পারছে না বিজেপি। নির্বাচনে একের পর এক পরাজয়। সংগঠনিক ব্যর্থতাকে আড়াল করতে গিয়ে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।