Ranjan Palit interview: প্রবীণ সিনেম্যাটোগ্রাফার রঞ্জন পালিত অনেক বছর পরে আবারও একটি বাংলা ছবির চিত্রগ্রাহকের ভূমিকায়, রাজর্ষি দে-র ছবি 'পূর্ব পশ্চিম দক্ষিণ, উত্তর আসবেই' ছবিতে। '৭ খুন মাফ' ও 'পটাকা' ছবির চিত্রগ্রাহকের সঙ্গে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র সঙ্গে দীর্ঘ একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে এল সাম্প্রতিক বাংলা ছবি নিয়ে তাঁর বিপুল হতাশার কথা।
সাম্প্রতিক কালে বাংলা ছবির মান পড়ে গিয়েছে, এমন কথা প্রায়ই শোনা যায়। আপনারও কি এই বিষয়ে একই মত?
আমি দেখি না বাংলা ছবি। আমার ভাল লাগে না।
কবে থেকে দেখা বন্ধ করলেন বাংলা ছবি?
তা প্রায় পনেরো বছর হবে।
হতাশ হয়েই এই সিদ্ধান্ত?
হ্যাঁ, জেনারালি, ভাল লাগে না।
এই ইন্ডাস্ট্রির তবে কী হবে? এটা কি এখানে আটকে যাবে?
আসলে ছবি অনেক হচ্ছে কিন্তু মান খুব খারাপ। স্ট্যাগনেট করে গেছে। একদম রাবিশ। অনেক ছবি হচ্ছে তাই বলা যাবে না যে ডাইং ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু কোয়ালিটি আনওয়াচেবল। দেখতে ভাল লাগে না। আমার লাস্ট দশ বছরে হয়তো একটা ছবি ভাল লেগেছে... আসা যাওয়ার মাঝে।
'জোনাকি' ভাল লাগেনি, তাই তো?
কলকাতায় যা বাংলা ছবি হয়, সেই অনুযায়ী তুলনা করলে তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। 'জোনাকি' স্ট্যান্ডস আউট। 'আসা যাওয়ার মাঝে'-র সঙ্গে যদি তুলনা করা যায়, তবে 'জোনাকি' ভাল লাগেনি। কিন্তু আদিত্যর কাজ আমার খুব ভাল লাগে। নো ওয়ান ক্যান টাচ হিম। কলকাতায় ওর মতো ফিল্মমেকার নেই।
আরও পড়ুন: ‘জোনাকি’ রিভিউ: জোনাকিরা নিভে যায়, স্ফুলিঙ্গ হন ললিতারা
নতুন প্রজন্মের সিনেম্যাটোগ্রাফারদের মধ্যে মধুরা পালিতের কাজ খুবই প্রশংসিত। তাছাড়া আর কাদের কাজ আপনার ভাল লাগছে?
জানি না ঠিক। এখন যারা কাজ করছে, তাদের মধ্যে গৈরিক কাজ শুনেছি ভাল। শুভঙ্কর ভড়ের কথাও শুনেছি।
আপনার কি মনে হয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে সঠিক লোকেদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না?
আমার মনে হয় লোকজনের টেস্ট আর ডিমান্ড ফর সিনেমা যেটা আমরা আগে দেখতাম, সেটাও বোধহয় চলে গিয়েছে। সবাই রাবিশ আর ননসেন্স দেখতেই পছন্দ করছেন। আর আমার মনে হয় ওয়েব সিরিজ এসে ওই ব্যাপারটা আরও বেড়ে গিয়েছে। ওয়েব সিরিজের প্রভাবটা সিনেমায় এসে পড়ছে। ওয়েব সিরিজ যা বাংলায় হচ্ছে তা একেবারেই গারবেজ! খুব লঘু এবং সফ্ট পর্ন, সুড়সুড়ি দেওয়া, হাস্যকর... ওই ব্যাপারটাও সিনেমায় চলে এসেছে। ভাল লাগছে না।
আরও পড়ুন: ওয়েব সিরিজ রিভিউ: ভালবাসা ও বিপ্লবের নিষিদ্ধ ইশতেহার ‘সুফিয়ানা’
বাংলা ছবির উপর তো আপনার ভরসা চলে গিয়েছে। তার পরে রাজর্ষি দে-র 'পূর্ব পশ্চিম দক্ষিণ উত্তর আসবেই' ছবির সিনেম্যাটোগ্রাফি করতে রাজি হলেন কেন?
আমার রাজর্ষি, সুচন্দ্রার সঙ্গে কথা বলে খুব ভাল লাগল। আর চিত্রনাট্যও অন্যরকম লেগেছিল একটু। নট টিপিকাল, নট রিয়েলি কমার্শিয়াল। আর আমার কাজের সুযোগ ছিল, তাই...
একটু আগে বললেন যে দর্শকও রাবিশ জিনিস দেখছে। সেই চিরাচরিত বিতর্ক টেনে বলি, দর্শকের চাহিদা অনুযায়ী কি সিনেমার মানোন্নয়ন হবে নাকি ভাল সিনেমা বানালে দর্শকের মানোন্নয়ন হবে?
বলা খুবই শক্ত, এটা সেই চিকেন অর দি এগ... জানি না সামহাউ ফিল্মমেকাররাও 'দর্শক এটা চাইবে' বলে এক ধরনের প্যাকেজে, ফর্মুলায় ছবি বানাচ্ছেন। কমার্শিয়াল সিনেমা তো দেখার অযোগ্য হয়ে উঠেছে। সেই একই থিম... একটা লেগে গেল 'বেলাশেষে' তো আবার ওই একই থিমে 'বসু পরিবার', এই রকম আর কী। তার পরে থ্রিলার করলেই গান-টান, লাফালাফি... জানি না আমি একদম দেখতে পারি না।
আরও পড়ুন: অস্তিত্ব এবং উপলব্ধির অন্তহীন চক্রব্যূহ ‘সামসারা’
সেই তুলনায় বলিউড কি অনেকটা এগিয়ে?
ডেফিনিটলি। আমি বলিউডের যে বড় ফ্যান তা নয় কিন্তু বাংলা সিনেমার থেকে তো অনেক এগিয়ে রয়েছে। তামিল সিনেমা, মালয়ালি সিনেমা এবং বলিউড এগিয়ে রয়েছে, অনেক অন্য রকম কাজ হচ্ছে।
বাংলায় এই প্রজন্মের যারা ভাল সিনেম্যাটোগ্রাফার বা সিনেমার অন্যান্য দিকের পেশাদার যাঁরা, তাঁরা বেশিরভাগই বলিউড চলে যাচ্ছেন। এই ড্রেনটা কি আরও হবে?
অবশ্যই, এটা বরাবরই ছিল। এখনও আছে। শীর্ষ রায়, খুব ভাল সিনেম্যাটোগ্রাফার। ও তো বম্বে চলে গেছে।
আপনার কি মনে হয় আপনাদের প্রজন্মে সাহিত্য ও শিল্পচর্চার যে আগ্রহ ছিল, এই প্রজন্মের মধ্যে সেই জানার বা দেখার আগ্রহটা কমে গিয়েছে?
হতে পারে। সেটা সত্যিই দুঃখজনক। এখন তো অনেক বেশি সুযোগ বেড়ে গেছে অনেক কিছু দেখার। কিন্তু বই পড়ার আগ্রহ কমে গেছে। আইডিয়াজ নিড টু কাম ফ্রম সামহোয়ের। এইখানে আর একটা জিনিস দেখেছি, বলিউডে এবং কলকাতায় খুব বেশি। খুব ছবি দেখে টোকে, অ্যাডাপ্ট করে, কপি করে। নিজেদের আইডিয়াজ নেই, অন্য ছবি কপি করো। অনেকেই করছে।
আরও পড়ুন: ফের সেরা আঞ্চলিক ছবির সম্মান পেল ‘অব্যক্ত’
যে কোনও সমাজ-রাজনৈতিক অস্থিরতা তো সেই সময়ের ছবিতে ধরা পড়ে। এদেশে এই মুহূর্তে যথেষ্ট অস্থিরতা রয়েছে, সেটা সাম্প্রতিক বাংলা ছবিতে আসছে না কেন?
লোকে ভয় পায়। ভবিষ্যতের ভূত একটা উদাহরণ। অনীক আমার বন্ধু, আমিও প্রোটেস্ট করেছিলাম। একটা কোনও প্রতিবাদ করল, ছবিটা ব্যান হয়ে গেল। তাই মনে হয় যে পলিটিকালি কিছু করতে লোকে ভয় পায় বোধহয়। লোকেদের আর আগেকার মতো দমটা নেই, লড়াই করার সাহসটা নয়। আমার মনে হয় সেটা আগে বেশি ছিল।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু বলবেন? নতুন প্রজন্মের সিনেম্যাটোগ্রাফার-ফিল্মমেকার-স্ক্রিনরাইটাররা অনেকেই তো রয়েছেন যাঁরা এই মুহূর্তে দিশা হারিয়ে ফেলছেন। ঠিক যে কারণে আপনিও বাংলা ছবি দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন।
ভাল ছবি দেখো। বিদেশি সিনেমা, আন্তর্জাতিক ছবি দেখো। এখন সে সব দেখার সুযোগ অনেক বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু টুকো না। ছবি দেখে প্রভাবিত হও কিন্তু টুকো না। আমি একটা ছবি বানিয়েছি সম্প্রতি লর্ড অফ দি অরফ্যানস। ওটার প্রিমিয়ার হল চিত্রবাণীর ফেস্টিভালে। ঢাকাতেও সবার ভাল লেগেছে। আমি এখন পাঠাচ্ছি ছবিটা নানা জায়গায়। এটা একটা পরিবারের গল্প, বলতে পারো আমার নিজের পরিবারের গল্প। আমি সেন্সর করে এই বছরের শেষে রিলিজ করার চেষ্টা করছি। অবশ্যই আর্টহাউস ছবি, হয়তো সবার জন্য নয়। তবে সবার জন্য নয় এটা বলাও আবার ঠিক নয়, সিনেমা সবার জন্য কেন হবে না। তবে দর্শক এখন যা দেখেন, সেরকম টিপিকাল কমার্শিয়াল কিছু নয়।
আরও পড়ুন: আলগা চিত্রনাট্যের বাঁধন যিশু-আবির
নতুন প্রজন্ম আশা করি এই ছবিটা দেখে অনুপ্রাণিত হবে। আপনার কি মনে হয় ডিজিটালি রিলিজ করলে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছবে নাকি আপনি হল রিলিজই চাইছেন?
আমি এখনও হল রিলিজেই বিশ্বাসী। ওই ফোনে দেখার আইডিয়াটা ঠিক এখনও নিতে পারছি না। যদিও ওটাই ভবিষ্যত কিন্তু আমি এখনও ঠিক ভাবতে পারি না। কম্পিউটারেই ছবি দেখতে কেমন একটা লাগে। তবে নিশ্চয়ই ডিজিটালে অনেক সুযোগ বেড়ে গিয়েছে... নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন। আমিও যদি হল রিলিজ না পাই তখন এদের কাছেই যেতে হবে।