বৃহস্পতিবার করোনাভাইরাসকে মহামারী ঘোষণা করে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সমস্ত সিনেমা হল, স্কুল, এবং কলেজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দিল্লি সরকার, যদি না সেখানে পরীক্ষা চালু থাকে। আগামীকাল থেকে দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে রাষ্ট্রপতি ভবনও।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছেন, করোনার মোকাবিলায় "সম্পূর্ণ সজাগ" রয়েছে ভারত সরকার, এবং দেশবাসীর সুরক্ষার জন্য নেওয়া হয়েছে একাধিক পদক্ষেপ। টুইট করে তিনি এও জানিয়েছেন, ভারতের কোনও মন্ত্রী আগামী দিনে বিদেশযাত্রা করছেন না, এবং দেশবাসীকে অনুরোধ জানান যেন খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ সফর না করেন।
বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রক জানিয়েছে, ভারতে নিশ্চিতভাবে নভেল করোনাভাইরাসে (COVID-19) আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩। তাদের ওয়েবসাইটে মন্ত্রকের তরফে আরও বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে পরীক্ষা করা হয়েছে ১০ লক্ষ ৫৭ হাজার ৫০৬ জন যাত্রীকে। বুধবার রাতে করোনাভাইরাসকে 'বিশ্বব্যাপী মহামারি' (pandemic) ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)। এই ভাইরাস এখন ছড়িয়ে পড়েছে অ্যান্টার্কটিক ছাড়া বাকি ছ’টি মহাদেশেই। তবে দেশবাসীকে অযথা আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রক জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় ভ্যাকসিন তৈরি হতে লাগবে দেড় থেকে দু'বছর।
# দিল্লিতে ছ'জন ভারতীয়ের দেহে মিলেছে COVID-19, হরিয়ানায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৪ জন বিদেশি
# দক্ষিণের পাঁচ রাজ্যের মধ্যে কেরালায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ জন ভারতীয়, তামিলনাড়ু থেকে এখন পর্যন্ত খবর পাওয়া গিয়েছে একজন আক্রান্তের। তেলঙ্গানা থেকেও একজন ভারতীয়ের আক্রান্ত হওয়ার খবর এসেছে, এবং কর্ণাটকে চারজন ভারতীয়ের দেহে মিলেছে ভাইরাস
# রাজস্থানে COVID-19 মিলেছে একজন ভারতীয় এবং দু'জন বিদেশির দেহে, উত্তর প্রদেশে ১০ জন ভারতীয় এবং একজন বিদেশির দেহে
# মহারাষ্ট্রে আক্রান্ত ১১ জন ভারতীয়, ওদিকে পাঞ্জাবে একজন
# জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখে যথাক্রমে একজন এবং তিনজন ভারতীয়ের দেহে পাওয়া গিয়েছে COVID-19
দেশে বর্তমানে প্রায় ১ লক্ষ COVID-19 'টেস্টিং কিট' রয়েছে, এবং আরও 'কিট' সংগ্রহ করছে স্বাস্থ্যমন্ত্রক। সারা দেশে এই মুহূর্তে চালু হয়েছে ৫২টি করোনাভাইরাস পরীক্ষাকেন্দ্র, সঙ্গে ৫৬টি নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্র। স্বাস্থ্যমন্ত্রকের যুগ্মসচিব লব আগরওয়াল জানিয়েছেন, ৭৩ জন আক্রান্তের সংস্পর্শে আসার ফলে নজরদারিতে রয়েছেন দেড় হাজারের বেশি মানুষ।
ভারতে 'লকডাউন'
অন্যদিকে, বুধবার থেকে আগামী ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ভারতে প্রবেশ করার সমস্ত ভিসা স্থগিত রাখার নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। একমাসের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সীমান্তও। স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "কূটনৈতিক, অফিশিয়াল, ইউএন/আন্তর্জাতিক সংস্থার ভিসা বাদে সকল ভিসা ১৫ এপ্রিল ২০২০ অবধি স্থগিত করা হয়েছে। এমনকী, ভারতের বিদেশি নাগরিকত্ব পাওয়া কার্ডহোল্ডারদের (ওসিআই) দেওয়া ভিসা-বিহীন ভ্রমণের সুবিধাতেও আনা হয়েছে স্থগিতাদেশ। ১৩ মার্চ থেকে কার্যকর হবে এই নির্দেশ। যে কোনও বিদেশী নাগরিক যদি বিশেষ কারণে ভারতে ভ্রমণ করতে চান, সেক্ষেত্রে তাঁরা নিকটতম ভারতীয় হাইকমিশনে যোগাযোগ করতে পারেন।"
করোনা আতঙ্কের প্রভাবে গোটা দুনিয়ার শেয়ার বাজারেও নেমেছে ধ্বস। বৃহস্পতিবার সকালে ২৭,০০০ পয়েন্ট পড়েছে ভারতের সেনসেক্স। বিগত ১৭ মাসে সেনসেক্সের এটি রেকর্ড পতন। ১০,০০০ পয়েন্ট পড়েছে নিফটি-ও, গত দু'বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ পতন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সূচক ডাও জোনস পড়েছে ১,৬০০ পয়েন্ট, এবং ২০১৬ সালের পর সর্বাধিক পতন দেখা গিয়েছে ইউরো স্টক্স ৫০-তেও। জাপানের নিক্কেই খুইয়েছে ৩.৩ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ার সূচক ৩.৭ শতাংশ, এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কোসপি-তে দেখা গিয়েছে গত চার বছরের মধ্যে সর্বাধিক পতন।
আতঙ্ক খেলার জগতেও
মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৮ মার্চ ওই মাঠে অনুষ্ঠিত মহিলাদের টি-২০ বিশ্বকাপে উপস্থিত থাকা একজন দর্শক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের চলতি সিজন অনির্দিষ্টকালের জন্য বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বহুল জনপ্রিয় NBA বা ন্যাশনাল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশন। ইতিমধ্যে করোনাভাইরাস পাওয়া গিয়েছে মার্কিন রাজ্য ইউটা-র এক বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের দেহে।
ভারতেও ভিসা-সংক্রান্ত নির্দেশিকা জারি হওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ (IPL) নিয়েও, যা শুরু হওয়ার কথা আগামী ২৯ মার্চ থেকে। এছাড়াও সঙ্কটে পড়েছে ইন্ডিয়া ব্যাডমিন্টন ওপেন। আজ থেকে শুরু হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে পুরুষদের একদিনের আন্তর্জাতিক সিরিজ। প্রথম ম্যাচ হচ্ছে হিমাচল প্রদেশের ধরমশালায়। শোনা যাচ্ছিল, ফাঁকা মাঠে খেলা হবে এই সিরিজ, যদিও ধরমশালায় মাঠে পৌঁছে যান শ'য়ে শ'য়ে দর্শক।
এবার আতঙ্কের কেন্দ্রবিন্দু ইউরোপ
COVID-19'এর প্রকোপে মৃতের সংখ্যা ৪,৩০০ ছুঁই ছুঁই, এখন পর্যন্ত পৃথিবীর অন্তত ১১৮টি দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লক্ষ ২০ হাজারের বেশি। এই মহামারী গত বছরের শেষে চিন থেকে ছড়াতে শুরু করলেও, বর্তমানে তার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ইউরোপ, বিশেষ করে ইতালি, যেখানে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৮২৭।
"যেভাবে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে ও তার মারাত্মক প্রভাব বাড়ছে", তার ভিত্তিতেই করোনাভাইরাসকে 'বিশ্বব্যাপী মহামারি' ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। রোগের বিস্তার রুখতে বিদেশীদের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে একাধিক দেশ।
ব্রিটেন বাদে অন্য কোনও ইউরোপীয় দেশের নাগরিক আগামী ৩০ দিন পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারবেন না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বুধবার মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান, এই নিয়ম কার্যকর হবে শুক্রবার মধ্যরাত থেকে। ইউরোপ থেকে আসা মার্কিন নাগরিকদের একাধিক পরীক্ষার পরই দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে তাঁর প্রশাসনের মতো "পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ" হয়েছে, সেকথাও জানিয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। তাঁর আরও বক্তব্য, "আমাদের কাছে আছে পৃথিবীর উন্নততম অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, এবং সবচেয়ে প্রতিভাবান ডাক্তার এবং গবেষক।"
উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা ১,০০০ ছাড়িয়েছে। এই তালিকায় যোগ হয়েছে হলিউডের তারকা টম হ্যাঙ্কস এবং তাঁর স্ত্রী রিটা উইলসনের নামও।
চিনে কমেছে করোনার প্রকোপ, দেখা দিয়েছে নতুন সমস্যা
করোনাভাইরাসের উৎস দেশ চিনে ২৪টি নতুন সংক্রমণের খবর পাওয়া গিয়েছে। মহামারীর শুরুর সময় থেকে এখন পর্যন্ত সেদেশে আক্রান্ত হয়েছেন ৮০ হাজার মানুষ, মৃতের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। নতুন করে আক্রান্তদের মধ্যে পাঁচজন চিনে আসেন ইতালি থেকে, একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এটিই আপাতত চিনের নতুন সমস্যা: বিদেশ থেকে করোনাভাইরাসের 'আমদানি' বন্ধ করা। বেইজিং শহরের প্রশাসন ঘোষণা করেছে, সমস্ত আন্তর্জাতিক পর্যটককে চিনে প্রবেশ করার পর ১৪ দিন বিচ্ছিন্ন (কোয়ারান্টিন) করে রাখা হবে।
ওদিকে চিনে এই মারণ রোগের প্রকোপ কমার সঙ্গে সঙ্গে মহামারীর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দেখা দিয়েছে ইউরোপ। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইতালি, যেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ১২,৪৬২, মৃতের সংখ্যা ৮২৭। ইটালির অধিকাংশ অঞ্চলেই যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যার ফলে আটকে পড়েছেন প্রায় ৬.২ কোটি মানুষ। করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় ২৮ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠন করেছে ইতালির সরকার। "চাঁচাছোলা ভাষায় বলতে গেলে, ইউরোপ এখন নতুন চিন," বলেন ইউএস সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-এর অধিকর্তা রবার্ট রেডফিল্ড।
মৃতের খবর এসেছে সুইডেন, আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, এবং অ্যালবেনিয়া সমেত ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকেও। স্পেনে আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়েছে। করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় ৩৯ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে ব্রিটেন। জার্মানির ৮৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ পর্যন্ত করোনাভাইরাসের শিকার হতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপ্রধান অ্যাঞ্জেলা মের্কেল। এখন পর্যন্ত জার্মানিতে আক্রান্তের সংখ্যা আন্দাজ ১,৩০০।
ইরানে আক্রান্ত প্রায় ১০ হাজার, মৃত ৪২৯
ভাইরাসের আরেক কেন্দ্রবিন্দু ইরানে প্রায় ১০ হাজার আক্রান্তের মধ্যে রয়েছেন দেশের উপ-রাষ্ট্রপতি ইশাক জাহাঙ্গিরি। এছাড়াও আক্রান্ত হয়েছেন ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিষয়ক মন্ত্রী, হস্তশিল্প ও পর্যটন মন্ত্রী, এবং শিল্প, খনি, তথা বাণিজ্য মন্ত্রী। দেশে মৃতের সংখ্যা আপাতত এক লাফে বেড়ে ৪২৯। পরিস্থিতির মোকাবিলায় লক্ষ লক্ষ ডলার ঋণের আবেদন করেছে ইরান।
ওদিকে করোনা প্রতিরোধে দু'সপ্তাহের জন্য প্রবেশ নিধেশ ঘোষণা করেছে কুয়েইত। সৌদি আরবে আক্রান্ত হয়েছেন ২৪ জন, কাতারে ২৬২ জন।