কেজরিওয়ালের পক্ষে বিপুল জনসমর্থনের কারণ কি শুধুই উন্নয়ন?
কথা কম বলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। মাথা খুব ঠাণ্ডা। পোশাকে, হাবভাবে, একেবারে মফঃস্বলের মধ্যবিত্তের মতন। কিন্তু তাঁর ক্ষুরধার মস্তিষ্ক এবং অসীম মনঃসংযোগ প্রশংসনীয়, লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল
কথা কম বলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। মাথা খুব ঠাণ্ডা। পোশাকে, হাবভাবে, একেবারে মফঃস্বলের মধ্যবিত্তের মতন। কিন্তু তাঁর ক্ষুরধার মস্তিষ্ক এবং অসীম মনঃসংযোগ প্রশংসনীয়, লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল
কেজরির প্রভাব সর্বত্রই। ছবি: তাশি তোবগিয়াল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
কথা কম বলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। মাথা খুব ঠাণ্ডা। পোশাক একদম মফঃস্বলের মধ্যবিত্তের মতন। বুশশার্ট আর খাটো প্যান্ট। শীতে ফুলহাতা সোয়েটার। লাল বা নীল। পায়ে চটি। কিন্তু অসম্ভব চতুর! গত এক বছর, হয়তো দু'বছর ধরেই, ভোটের নিখুঁত রণকৌশল রচনা করেছেন। পরামর্শ নিয়েছেন প্রশান্ত কিশোরেরও। ২০১৭ সালে তিনটি পুরসভার মোট ২৭২টি আসনে বিজেপি জিতেছিল বিপুল ভোটে। ২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সাতটি আসনের সাতটিই পেয়েছিল দিল্লিতে। 'আপ' সেবার হয়েছিল তৃতীয় শক্তি।
Advertisment
চুপচাপ কেজরিওয়াল রণকৌশল বদলে ফেলেন। ২০১৪ সালে যে কেজরিওয়াল নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হন বেনারসে, যে কেজরিওয়াল পাঞ্জাব, হরিয়ানা, এমনকি গোয়াতে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ে 'সর্বভারতীয়' চরিত্র হয়ে উঠতে চান, মোদীর তীব্র সমালোচনা করেন, তাঁকে 'সাইকোপ্যাথ'-ও বলেন, সেই কেজরিওয়ালের নতুন চিত্রনাট্য হলো মোদী-বিরোধিতা থেকে সরে এসে কেন্দ্রের সঙ্গে সহযোগিতা করে মহাভারতের অর্জুনের মতো শুধু পাখির চোখ, অর্থাৎ দিল্লি দর্শন।
দিল্লি-কেন্দ্রিক রাজনীতির প্রধান তাস: উন্নয়ন। বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জল দেওয়া। রাস্তা নির্মাণ। হাসপাতালের পরিষেবা। স্কুল নির্মাণ। মহিলাদের জন্য বাসে যাতায়াতের ফ্রি পরিষেবা। এই অস্ত্রে কেজরিওয়াল এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে, মনে হয় তিনি আবার পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসবেন। প্রাথমিক সমীক্ষা বলছিল তিনি 'সুইপ' করবেন।
Advertisment
অন্যদিকে কংগ্রেস হালভাঙা, পালছেঁড়া। শীলা দীক্ষিত নেই। কংগ্রেসের রাজ্য নেতারা নেই। রাহুল গান্ধী প্রধান কাণ্ডারি, তিনিও ইস্তফা দিয়েছেন। পরাজয় একরকম অবধারিত জেনে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথ বা রাজস্থান-পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীরাও প্রচারে এলেন না। গা-ই লাগালেন না। আর তাই কংগ্রেসের ফলাফল শূন্য। শতকরা ভোটের হার চোখে জল এনে দেয়।
রাজ্য বিজেপিতে নেতা অনেক, কিন্তু রেষারেষি, মারামারি ছাড়া মুখ্যমন্ত্রী মনোনয়ন সম্ভব হলো না। একদিন রাজ্য বিজেপি অফিসে গিয়ে দেখেছিলাম, মোদী আর অমিত শাহর পাশাপাশি রাজ্য সভাপতি মনোজ তিওয়ারির ছবি পোস্টারে দেওয়া হলেও, কেন অন্য নেতাদের ছবি নেই - তা নিয়ে কলহ চলছে। নরেন্দ্র মোদী যত বড় 'ব্র্যান্ড'ই হোন, রাজ্যস্তরে নেতা ও সংগঠন না থাকলে কীভাবে তাঁর বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছনো সম্ভব হবে?
এভাবেই যখন বিজেপি হতাশাগ্রস্ত, তখন জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়ায় আন্দোলন শুরু হলো, এবং হঠাৎই এলো শাহিনবাগের ঘটনা। এবং অমিত শাহর মনে হলো অন্য কোনও পথ যখন নেই, তখন শাহিনবাগকেই প্রচারের প্রধান হাতিয়ার করে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মেরুকরণের পথে হাঁটলে দলের লাভ হতে পারে। এই কাউন্টার-কৌশল তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকল। এক ডজন শীর্ষ মন্ত্রীকে এনে 'কার্পেট বম্বিং' শুরু করা হলো।
এর মধ্যে আচমকাই দিল্লির উপ-মুখ্যমন্ত্রী মনীশ সিসোদিয়া বলে বসলেন, "উই আর উইথ শাহিনবাগ"। এই মন্তব্যে বিজেপি আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল। ওদিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর বুঝিয়ে দিলেন, দেশদ্রোহীদের কী করতে হবে। বিজেপি সমর্থকরা বললেন, মেরে দাও। যোগী আদিত্যনাথও রক্ত গরম করা বক্তৃতা দিলেন।
এই সময় দেখছিলাম, কেজরিওয়ালও বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলেন। এটা ভোটপর্বে কেজরিওয়ালের রণকৌশলের দ্বিতীয় অধ্যায়। যার ফলে কেজরিওয়াল একবারও শাহিনবাগ গেলেন না। স্থানীয় সংখ্যালঘু বিধায়ককে দায়িত্ব দিলেন পরিস্থিতি সামলানোর। এ সময় তিনি শাহিনবাগ কেন, সিএএ বা 'ক্যা' নিয়েও কোনও মন্তব্য করতে চাইছিলেন না। বিজেপি কিন্তু তাঁকে বারবার প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেই চলেছে। কেজরিওয়াল জবাব দিচ্ছেন না। বলছেন, "জবাব চান অমিত শাহর কাছ থেকে।"
বিজেপির ফাঁদে পা না দিলেও একটা সময় কেজরিওয়ালকে মুখ খুলতেই হলো। এটা তৃতীয় অধ্যায়। কেজরিওয়াল এবার বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মুখ খুললেন। বিজেপি তখন আহ্লাদিত। তাহলে মেরুকরণের তাস কাজ করছে! প্রধানমন্ত্রী সংসদে অযোধ্যার ট্রাস্টি বোর্ডও ঘোষণা করলেন। চতুর কেজরিওয়াল এবার হনুমান মন্দিরে যাওয়ার রাজনীতি শুরু করলেন। 'হনুমান চালিসা' শোনালেন জনসভায় মুখস্থ - যেমনভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় মুখস্থ চণ্ডীপাঠ করেন।
কংগ্রেসের অস্তিত্ব বিপন্ন, তাই এই 'নরম হিন্দুত্বের' কৌশলে কেজরিওয়ালের লাভ হলো। দিল্লির দু'কোটি মানুষের মধ্যে মুসলমান জনসংখ্যা শতকরা ১০ থেকে ১২ ভাগ। তাঁরা একযোগে ভোট দিলেন কেজরিওয়ালকে। কংগ্রেসের শক্তি থাকলে এই ভোট ভাগাভাগি হয়ে বিজেপির লাভ হতো। তাও হলো না।
তবে বিজেপির এহেন পরাজয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এটা কি শুধু কেজরিওয়ালের পক্ষে ভোট, নাকি বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট? দেশের অর্থনীতি, মোদী সরকারের বিরুদ্ধেও জনমত? বিজেপির হিন্দুত্ববাদি মেরুকরণের রাজনীতি কি তবে কাজ করছে না? এ জন্যই কি শেষদিনে আরএসএস নেতা ভাইয়াজি যোশী বললেন, "বিজেপি মানেই আরএসএস নয়। আরএসএস মানেই বিজেপি নয়। বিজেপির বিরোধিতা মানেই আরএসএস বিরোধিতা নয়।
একের পর এক রাজ্যে পরাজয়ের পর দিল্লির এই বিপর্যয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবার বিহার ও বাংলার জন্য কি নতুন রণকৌশল নেবে বিজেপি?