Advertisment

ভক্তদের দাপট আসলে একনায়কের লাল কার্পেট, সাবধান করেছিলেন বাবাসাহেব

ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের বহু অভিযোগ উঠলেও, যে অভিযোগ ইন্দিরার বিরুদ্ধে কখনও ওঠেনি, এখন অবশ্য সেই অভিযোগও উঠছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Bhakt, Narendra Modi

ভক্ত্ শব্দটি এখন ইংরেজিতেও ঢুকে পড়েছে

ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার ৪৪-৪৫ বছর পরে, বিরোধীরা গত ছ’বছরে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বার বার বিভিন্ন সময়ে অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি করার অভিযোগ তুলেছেন। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক, জ্ঞান প্রকাশ, তাঁর ‘ইমার্জেন্সি ক্রনিকলস, ইন্দিরা গান্ধী অ্যান্ড ডেমক্র্যাসি’স টার্নিং পয়েন্ট’ বইয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ইমার্জেন্সির সময়ের ইন্দিরা গান্ধীর একটা তুলনামূলক আলোচনা করেছেন।

Advertisment

সেই আলোচনায় তিনি কার্যত বিরোধীদের ওই অভিযোগের উপরেই সিলমোহর দিয়েছেন।  সেখানে তিনি বলেছেন, এখন আমাদের দেশে কোনও আনুষ্ঠানিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়নি। কোনও সেন্সরশিপ চালু নেই। আইনসম্মত ভাবে অন্য সমস্ত আইনকে অকেজো করে রাখা হয়নি, যেমন ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থায় হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও হিন্দু জাতীয়বাদের রাজনীতি নরেন্দ্র মোদীকে এমন এক জায়গায় সফল ভাবে পৌঁছে দিয়েছে, যে জায়গায় ইন্দিরাকে যেতে হয়েছিল জরুরি অবস্থা জারি করে। যখন সাংবিধানিক গণতন্ত্র ইন্দিরার কাছে নতজানু হয়নি, তিনি তখন গণতান্ত্রিক শক্তিকে নত করতে রাষ্ট্রীয় শক্তিকে ব্যবহার করেছিলেন।

শ্রী রঞ্জন গগৈ, সাংসদ

আজ আদালত, সংবাদমাধ্যম, রাজনৈতিক দল কেউই দৃশ্যত আক্রান্ত নয়, কিন্তু দেখে মনে হয় যেন তারা যেন নীরব। গণতন্ত্রের পাহারাদের ভূমিকায় তারা যেন সক্রিয় হতে ইচ্ছুক নন। ইন্দিরার মতোই নরেন্দ্র মোদীও দলের এক এবং অদ্বিতীয় নেতা। বিজেপির মতো একটা রাজনৈতিক দল, যে দলে এক সময় দেশ জুড়ে একগুচ্ছ  প্রথম সারির নেতা ছিলেন, সেই দলটা এখন এই সুপার হিরোর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। জরুরি অবস্থায় যেমন ইন্দিরা ছিলেন সর্বময় কর্ত্রী, এখন ঠিক তেমনই নরেন্দ্র মোদী সর্বময় কর্তা। তাঁরই ছবিতে ছেয়ে আছে দেশ। শুধু তাঁরই নামে স্লোগান। শুধু তাঁরই লাইভ অনুষ্ঠান টিভি জুড়ে। তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করেন না। কোনও প্রশ্নের উত্তর দেন না। তিনি  সরাসরি কথা বলেন রেডিওর মধ্যে দিয়ে, টিভির মাধ্যমে।  ঘন ঘন টুইট করেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো। ইন্দিরার মতোই একজিকিউটিভ পাওয়ার এখনও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।  তার সঙ্গে রয়েছে সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে অসহিষ্ণুতা এবং বিরোধী মতকে দেগে দেওয়া দেশদ্রোহী বলে। এমনই লিখেছেন জ্ঞান প্রকাশ।

সিলমোহর তো দিলেন জ্ঞান প্রকাশ, কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে? বাস্তবে এই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আবহে দেশে তৈরি হয়েছে এক বিরাট ‘ভক্তবাহিনী’। হিন্দি শব্দ ‘ভক্ত্’ এখন ‘BHAKT’ নাম নিয়ে ইংরেজিতেও ঢুকে পড়েছে।  হিন্দুত্ববাদীদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিক্ষোভ, হামলা ইত্যাদির অভিযোগ বিষয়ে রিপোর্ট লিখতে গিয়ে ইংরেজি সংবাদ মাধ্যমে এখন প্রায়ই এই  ‘BHAKT’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে।  বাংলায় আমরা যাকে বলি ‘ভক্ত’। সেটাই হিন্দি ইংরেজিতে এখন ভক্ত্।

আতঙ্কিত দুনিয়ায় ব্রাত্য হোক ক্ষুদ্র রাজনীতি

কথাটা কেন এল? এল এই কারণে, ‘ভক্ত’ এখন একটি রাজনৈতিক শব্দ। এক বিরাট ‘ভক্ত-বাহিনী’ তৈরি হয়েছে দেশ জুড়ে। জেএনইউ-এ রড হাতে তাদের দেখা যায়, তারাই বুন্দেলখণ্ডে পুলিশ মারে, গণপিটুনি মামলায় ধরা পড়ে জামিন পাওয়ার পর তাদেরকেই বাড়িতে ডেকে মিষ্টি খাওয়ান কোনও মন্ত্রী। প্রশ্নশূন্য এক অতিকায় শক্তি।  যারা বিনা প্রশ্নে গোমূত্র পান করে।  যারা বিশ্বাস করে গোরুর মাংস আর সংখ্যালঘুরাই দেশের দারিদ্রের জন্য দায়ী, তার সন্তানের চাকরি না হওয়ার জন্য দায়ী এবং ইয়েস ব্যাঙ্কের পতনের জন্যও দায়ী তারাই, ইত্যাদি ইত্যাদি।

কী ভাবে জন্ম নেয় এই শক্তি?  আর্থিক অসাম্য এবং দেশের বড়ো অংশ নিম্ন মানের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে যে শিক্ষার বৈষম্য তৈরি হয়েছে দীর্ঘ কাল ধরে, তা থেকেই জন্ম নেয় এই ভক্ত-বাহিনী।এই প্রশ্নহীন রাজনৈতিক বাহিনী সম্পর্কে আমাদের বহু দিন আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন বাবাসাহেব আম্বেদকার। আমরা গুরুত্ব দিইনি।

কী বলেছিলেন বাবাসাহেব? বাবাসাহেব ছিলেন আমাদের সংবিধান রচনার খশড়া কমিটির প্রধান। আমাদের ‘কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লি’ বা গণ পরিষদ, যার অধীনে রচিত হয়েছিল আমাদের সংবিধান, সেই কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির শেষ দিনে, ১৯৪৯ সালের ২৪ নভেম্বর বাবা সাহেব বলেছিলেন, ‘একটা চিন্তা আমার মনে আসছে! ভারতের এই গণতান্ত্রিক সংবিধানের ভবিষ্যৎ কী হবে? দেশ কি পারবে তাকে রক্ষা করতে, না কি সে পেয়েও তাকে হারিয়ে ফেলবে? যেখানে আর্থিক এবং সামাজিক লক্ষ্য পূরণে কোনও পথ খোলা থাকে না, সেখানে অসাংবিধানিক পথই হয়ে ওঠে পথ। আর যেখানে সংবিধানের রাস্তা খোলা, সেখানে অসাংবিধানিক পথে হাঁটার পক্ষে কোনও যুক্তি থাকে না। অসাংবিধানিক পথে এগোলে জন্ম হয় স্বেচ্ছাচারিতার। এই পথ যত তাড়াতাড়ি পরিত্যাগ করা যায় ততই আমাদের সবার মঙ্গল’।

অনেকদূরের এক উন্নত দেশে   

এর পর বাবাসাহেব,  ‘নেতা-পুজো’, ‘ব্যক্তি-পূজা’, ‘হিরো ওয়ার্শিপ’, প্রশ্নহীন ভাবে নেতৃত্বকে স্বীকার করে নেওয়া সম্পর্কে বলেন,  ‘বড়ো মাপের মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা দোষের নয়, কিন্তু এই কৃতজ্ঞতার সীমা থাকা উচিত। আমাদের ভারতে ভক্তি, বা আত্মনিবেদনের সংস্কৃতি আছে। সেটা ধর্মের জন্য ঠিক আছে। কিন্তু  রাজনীতিতে ভক্ত, আত্মনিবেদন, বীরপুজো এক নিশ্চিত পতনের রাস্তা এবং যে পথ অনিবার্য ভাবে স্বৈরতন্ত্রের দিকে নিয়ে যায়’।

ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের বহু অভিযোগ উঠলেও, যে অভিযোগ ইন্দিরার বিরুদ্ধে কখনও ওঠেনি, এখন অবশ্য সেই অভিযোগও উঠছে। সেটা হল তথ্যের স্বাধীনতা এবং নাগরিকের গোপনীয়তা নিয়ে সঙ্কট । ‘নাইনন্টিন এইট্টি-ফোর’ বা ১৯৮৪। এই চার সংখ্যাই  জর্জ অরওয়েলের ভয় ধরানো এক উপন্যাসের নাম।

সেই উপন্যাসে  ‘মিনিস্ট্রি অফ ট্রুথ’-এর দেখা পাওয়া যায়, যেখানে লেখা থাকে ‘ওয়ার ইজ পিস’, ‘ফ্রিডম ইস স্লেভারি’ এবং ‘ইগনোরেন্স ইজ স্ট্রেংথ’।  ‘মিনিস্ট্রি অফ ট্রুথ’-এর কাজ সংবাদ বিষয়টি দেখা-শোনা করা, যাতে কোনও অপছন্দের খবর বেরিয়ে না পড়ে। এবং আছে মিনিস্ট্রি অফ লাভ, যেখানে ঘরে একটাও জানলা নেই, তাদের আসল কাজ কঠোর ভাবে আইন শৃঙ্খলা দেখাশোনা করে। যেখানে সবাইকে সাবধান ক’রে দিতে বিভিন্ন দেওয়ালে লেখা থাকে ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং‘। আপনার উপর নজর রাখা হচ্ছে।

COVID-19: ভাইরাস ও মানুষ

আমরা কি সেরকম একটা দেশের দিকে এগোচ্ছি ধীরে ধীরে? প্রশ্নটা উঠেছে,  বিরোধীদল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে। ১‌৮ মার্চ, গত বুধবার  কংগ্রেস মুখপাত্র মনীশ তিওয়ারি অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় সরকার কি দেশের মানুষের অজান্তে তাদের উপর গোপন নজরদারি চালিয়ে দেশটাকে জর্জ অরওয়েলের ‘নাইনন্টিন এইট্টিফোর’-এর জগতে নিয়ে যেতে চাইছে?  মনীশ তিওয়ারি বলেছেন, দেশের নাগরিকদের ব্যক্তিগত পরিসরকে অগ্রাহ্য করে বিজেপি সরকার গণ-নজরদারি বা ‘মাস সারভেইল্যান্স’-এর দিকে এগিয়ে চলেছে? যেখানে নজর রাখা হবে প্রতিটি নাগরিকের উপর? সে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে? কী ব্যবসা করছে? কোন রাজনীতি করছে? মনীশ তিওয়ারি বলেন, এটা একটা ষড়যন্ত্র।

১৮ মার্চ, গত বুধবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি  খবরে দাবি করা হয়েছে, মোদি সরকার সব ক’টি টেলিকম কোম্পনিকে বলেছে, গত কয়েক মাসের নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনের, দেশের সব মোবাইল ব্যবহারকারীর ‘কল-ডেটা-রেকর্ড’ জমা দিতে। প্রশ্নটা উঠেছে এখান থেকেই। মনীশ বলেন, খুবই উদ্বেগের বিষয়। একটা গোপন ষড়যন্ত্র হচ্ছে। মনীশ বলেন, এর আগে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা প্রাইভেসি নিয়ে একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের ৯ সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মত ভাবে রায় দিয়ে বলেছিল, ব্যক্তিগত পরিসর বা ‘প্রাইভেসি’ নাগরিকের স্বীকৃত অধিকার। কোনও সরকার তা কেড়ে নিতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টকে অস্বীকার করে নাগরিকের সেই অধিকারে মোদি সরকার হস্তক্ষেপ করতে চাইছে বলে মনীশ তিওয়ারি অভিযোগ করেছেন। তাঁর মতে এ হল নাগরিকদের উপর সরকারের গুপ্তচরবৃত্তি চালানোর চেষ্টা।

কেন মোবাইল ফোনের তথ্যের উপরে নজরদারি করছে সরকার?

এবারে একটু তাকানো যাক আমেরিকার দিকে। কারণ, সেখানকার গল্পটাও প্রায় একই। এই নামটা খুব অচেনা নয়, এডোয়ার্ড জোসেফ স্নোডেন। বিশ্বের একজন অন্যতম সেরা সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার। যদিও কোনও দিন কলেজে পড়েননি স্নোডেন। ২২ বছর বয়সে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র নজরে পড়েন তিনি। যোগ দেন সিআইএ-তে। কম বয়স, কিছুটা না বুঝেই যুক্ত হন গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাসে সব থেকে ভয়ঙ্কর এক অতিকায় প্রকল্পের সঙ্গে। নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তির উপর নজরদারি নয়, বিশ্বের যে কোনও মানুষের উপর নজরদারি করা এবং গুপ্তচরবৃত্তি চালানোর প্রকল্পের সঙ্গে। এবং সেই তথ্য এমন ভাবে সংরক্ষণ করা, যাতে যদি কখনও আমেরিকা ধ্বংসও হয়ে যায়, তথ্য সব অটুট থেকে যাবে।

কী করে নজরদারি?  যে ব্যক্তি কখনও একবারের জন্যও কোনও মোবাইল ফোন ব্যবহার করেছে, তাকেই আমাদের এই নতুন সিস্টেমে ট্র্যাক করা সম্ভব, বলেছেন স্নোডেন। তিনি লিখেছেন, আমি কাজ করতাম বিরাট প্রকল্পের একটা অংশে। সাত বছর কাজ করার পর আমি বুঝতে পারি আমি একটা মানবতা বিরোধী কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছি। অনেক ভাবনা চিন্তা করে আমি চাকরি ছেড়ে দেই। আমি মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। পরিবারের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। তাই এখন আমার কাজ হল মানুষকে পরামর্শ দেওয়া, কী ভাবে সে আমাদের মতো গুপ্তচরদের হাতে অজান্তে পুতুল হয়ে যাবে না। চাকরি ছেড়ে স্নোডেন এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে ‘পার্মানেন্ট রেকর্ড’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। হৈ চৈ পড়ে যায় ওই বই নিয়ে। ভারতের মনীশ  তিওয়ারির আশঙ্কার সঙ্গে কী অদ্ভুত মিল আমেরিকার ২৯ বছরের এডোয়ার্ড স্নোডেনের। প্রমাণ হয়, রাষ্ট্র সারা পৃথিবীতেই এক ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করছে। বা বলা যায়, রাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বাস এখন বিশ্বজোড়া।

(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)

এই কলামের সব লেখা, এইখানে

Bengal Line
Advertisment