ছোটবেলায় একটা খেলা খেলতাম না আমরা? 'ট্রু অর ফলস?' সত্যি না মিথ্যে? চলুন, আর এগোনোর আগে রানাঘাটের রানু মণ্ডলের সাম্প্রতিক জীবন নিয়ে সেই খেলাটা খেলা যাক।
হিমেশ রেশমিয়ার সঙ্গে প্লেব্যাক করেছেন। গানের রেকর্ডিং হয়ে গেছে - সত্যি
একটি রিয়ালিটি শো-তে অতিথি রূপে হাজির হয়েছেন - সত্যি
তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হিমেশ একটা মোটা অঙ্কের টাকা তুলে দিতে চেয়েছেন রানুর হাতে। রানু আবার সে টাকা ফিরিয়েও দিয়েছেন - মিথ্যে
সলমন খান নাকি আস্ত একটা বাড়িই উপহার দিচ্ছেন তাঁকে। বিগ বসেও ডাক পাচ্ছেন রানু - মিথ্যে
পুজোর থিম সং গাইছেন - সত্যি হতেও পারে, গানটা শুনতে পেলে জানাবেন
মিডিয়ার স্টার - সত্যি
সোশ্যাল মিডিয়ায় সুপারস্টার, ফেসবুক সেনসেশন - সত্যি
আগামী বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন তিনি। এ নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে রাজ্যের প্রথম সারির দলগুলি - মিথ্যে
বুঝতেই পারছেন, সত্যি-মিথ্যে মিলিয়ে রানু-কাহিনি আপাতত 'মিথ'। ভিখারিণী থেকে রাজরানি, থুড়ি গানের রানি। না তো কী, 'নাইটিঙ্গেল' খেতাব কী চাট্টিখানি কথা!
আরও পড়ুন: রানাঘাট ছাড়িয়ে ‘ভাইরাল’ রানু, তাঁর নিউ লুকে ছেয়ে গেছে নেটপাড়া
রানাঘাটের রানুকে এখন শুধু দেশ নয়, বিদেশও চেনে। আরে, ইন্টারনেটের জমানা বলে কথা! চিনবে না কেন? চেনানোর জন্যই তো এত কিছু। বস্তুত, রানু-ঝড়ে এখন সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল। বলা ভালো, দ্বিধাবিভক্ত। একদল মনে করছে এটা ফালতু হুজুগ। বাড়াবাড়ি হচ্ছে ওঁকে নিয়ে। ওঁর মতো গায়িকা দেশের বহু বাড়িতেই (পথেঘাটেও) পাওয়া যাবে। আবার একদল রানুর স্বীকৃতিতে বেজায় খুশি। তাদের কথা, রানু তাঁর যোগ্যতা দিয়েই অর্জন করেছেন এই স্বীকৃতি। এতে সমালোচনা যারা করছে, তারা আসলে ঈর্ষাকাতর।
একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, রানুর গাওয়া সম্পূর্ণ একটি গান যত না, তার থেকে অনেক বেশি ভাইরাল হয়েছে তাঁকে কেন্দ্র করে ঘটনা পরম্পরার ভিডিও। আমি নিজেই তো অনেক খুঁজে ওই 'এক পেয়ার কা নাগমা' আর রেকর্ডিং-এর 'তেরি মেরি কাহানি' (তাও শুধু মুখড়া ) ছাড়া আর কিছু শুনতে পাইনি। নিঃসন্দেহে ওই বিশেষ চ্যানেলের রিয়ালিটি শো-টি সব থেকে বেশি ফুটেজ খেয়েছে, সে যেদিক থেকেই হোক। একই সঙ্গে রানুকে ব্যঙ্গ করেও প্রচুর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তার মধ্যে বেশিরভাগই অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ। বিশেষত একজন ওড়িয়া অভিনেতা রানুর গাওয়াকে প্যারোডি করে যেভাবে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন, তা একান্তই ন্যক্কারজনক।
বিষয়টা রানুর গান গেয়ে নাম করা নয়, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিও নয়। বিষয় হলো, খেলাটা আসলে কী? খেলছেই বা কারা? আর এতে রানু সত্যি আখেরে কতটা লাভবান হবেন? প্রতিটি উত্তরণেরই একটা শুরু থাকে। যদি অবশ্য রানুর ক্ষেত্রে এটাকে উত্তরণ বলা যায়। বলতে আপত্তি ছিল না, যদি না খ্যাতি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই রানু অতীন্দ্রকে 'ভগবানের চাকর' বলার ভুলটা করে বসতেন। রানু এটাও বলেছেন, তিনি তাঁর ভিক্ষে-সাথীদের কাছ থেকে দূরেই থাকেন। কারণ তাদের সবার মাথায় উকুন! রানু কি সত্যি ভিখারিণী ছিলেন? অতীন্দ্র ভালো মানুষ। তাঁর চোখ রানুকে চিনতে ভুল করেনি তো?
আমি এখানে এথিকসের প্রশ্ন তুলছি না। এটা স্ট্র্যাটেজির প্রশ্ন। আলোচনায় যাওয়ার আগে দেখা যাক, কে এই অতীন্দ্র? অতীন্দ্র চক্রবর্তী। এই তরুণ ইঞ্জিনিয়ারই প্রথম রানুকে পাদপ্রদীপের আলোয়, থুড়ি ফেসবুকের পাতায়, আনেন। রানাঘাট স্টেশনে ভিক্ষারত রানুর গান ভিডিও রেকর্ড করে পোস্ট করেন অতীন্দ্র। ব্যাপারটায় চমক ছিল। একজন ভিখারিণী এমন মিঠে গলায় গান গাইছেন, ভিডিও ভাইরাল হতে দেরি হলো না স্বভাবতই। সেই অতীন্দ্র সম্পর্কে এতখানি রূঢ় না হলেও পারতেন রানু।
আর পুরোনো সঙ্গীদের নিয়েও তাঁর মন্তব্য অনুধাবনযোগ্য। উদ্ধত শুধু নন, তিনি যে একেবারেই কৌশলী নন, এ ঘটনা তার প্রমাণ। তাঁর মেকওভারের পুরোটাই বাহ্যিক, বোঝাই যায়। যাঁরা এই মহৎ দায়িত্বটি পালন করেছেন, তাঁরা এ বিষয়ে গুরুত্ব দিলেন না কেন কে জানে। তাঁরা কি পেশাদারিত্ব কথাটা জানেন না? নাকি রানু তাঁদের জন্য নিছকই এক গিমিক, তাৎক্ষণিক টিআরপি তোলার উপকরণ?
আরও পড়ুন: রানাঘাট স্টেশনে এই মহিলার গলায় গান শুনে তাজ্জব নেটপাড়া
এখানে একটা কথা প্রযোজ্য। অতীন্দ্রর করা ভিডিওতে রানুর গান শুনে স্পষ্টই বোঝা যায়, তাঁর একটা জন্মগত প্রতিভা রয়েছে। গান গাইতে ভালোবাসেন, সেটাও। কিন্তু প্রথাগত শিক্ষা তাঁর নেই। হয়তো সুযোগ পাননি বলেই। এহেন রানুর গান ভাইরাল হওয়ার ক্ষেত্রে যত না তাঁর গুণের কদর, তার থেকেও বেশি কাজ করেছে জনতার হুজুগ। বলা বাহুল্য, হুজুগ জিনিসটা সব সময়ই কিন্তু সর্বনাশের কারণ। কেন্দ্রবিন্দু তৈরি করে, তাকে মাথায় তুলে, ফেলে দিতে একেবারে দেরি করে না। এমন অতীতে প্রচুর ঘটেছে। রানুর ক্ষেত্রেও সেটা হবে না তো?
ইতিমধ্যেই টাকার গন্ধে মাছি ভনভন করছে। রোজগার যত বাড়বে, ততই বাড়বে ভনভনানি। যে আর্থসামাজিক স্তর থেকে উঠে এসেছেন রানু, সেখানে টাকাপয়সার ঘোরপ্যাঁচ বোঝার অবকাশ নেই বললেই চলে। দিন এনে দিন খেয়ে গুজরান। জীবনের পঞ্চাশটি বছর পার করে রানু কি পারবেন সেই কৌশল ও চাতুর্য আয়ত্ত করতে? যারা তাঁকে এতদিন অবহেলা করেছে, টাকা আসায় আজ তারা ঘুরঘুর করছে। টাকা শেষ হলে তারা থাকবে? না থাকলে কী হবে রানুর? আর তো তিনি পুরোনো লড়াইয়ের জীবনে ফিরতে পারবেন না। সেটা কাম্যও নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে রানুকে কিছু কৌশল শিখতেই হবে।
রিয়ালিটি শো-তে রানুর অ্যাপিয়ারেন্স বা হিমেশ রেশমিয়ার সঙ্গে ডুয়েট গাওয়া রানুর এই বয়সে পৌঁছে কেরিয়ার নির্মাণে কতটা সাহায্য করবে, সে তো সময়ই বলবে। যাঁরা জানেন তাঁরা জানেন, প্রতিষ্ঠা এত সোজা নয়। প্রতিষ্ঠা ফানুশের মতো জ্বলে ওঠা নয়, তারা হয়ে আলো বিকিরণ। তার একটা লম্বা ও ধারাবাহিক জার্নি আছে। রাতারাতি হয় না। সেই ধৈর্য রাখেন রানু? ভাগ্য তাঁকে রেল স্টেশন থেকে বলিউডের স্টুডিওতে পৌঁছে দিয়েছে। সেই ভাগ্যকে ধরে রাখতে হলে মেকআপ, মেকওভারে কাজ হবে না। গানের প্রথাগত চর্চাটাও করতে হবে। জরুরি আজকের প্রযুক্তিনির্ভর গানবাজনা বোঝার ব্যাপারটাও।
আরও পড়ুন: রানুর মন্তব্য বেফাঁস! কী জানালেন তাঁর ঘনিষ্ঠরা?
সবার আগে বন্ধ করতে হবে, তাঁকে নিয়ে হুজুগের এই চূড়ান্ত মাতামাতি। যাঁরা সত্যি রানুর ভালো চান, ফেসবুকে রানুর গানের গুণ নিয়ে গলা ফাটান, এক্ষেত্রে তাঁদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। এই যে সলমন খান বাড়ি দিচ্ছেন রানুকে, এবং তার দাম ৫৫ লক্ষ টাকা। এটা কিন্তু এখনও পর্যন্ত রটনাই। রানুর কন্ঠ পছন্দ করেছেন সলমন, সেই সূত্রেই 'দাবাং ৩'-তে প্লেব্যাক গাইবার সুযোগ পাবেন রানু, এই তথ্যও সত্যি নয়। 'বিগ বস' নিয়েও কোনও কথা হয়নি। সলমনের অফিসিয়াল সোর্স এর সত্যতা অস্বীকার করেছে।
এই রটনার পরপরই একটি ছবি ভাইরাল হলো, যেখানে রানুর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করছেন স্বয়ং লতা মঙ্গেশকর। ছবিটা দেখলেই ফোটোশপের কারসাজি ধরা পড়ে। এরই পাশাপাশি রানুর এহেন উত্থান নিয়ে লতাজির প্রতিক্রিয়া কী? না, তাঁর সাফ কথা, তিনি রানুর জন্য খুশি। কিন্তু নকলনবিশি কোনও শিল্পীকেই বেশি দূর নিয়ে যেতে পারে না। এক সংবাদ সংস্থাকে কিংবদন্তি শিল্পী জানিয়েছেন, "আমার নাম এবং কাজ যদি কোনও মানুষের ভালো করে তবে সেটা আমার সৌভাগ্য।” এটা তাঁর আভিজাত্য ও রুচিশীলতার পরিচয়।
আসল কথা হলো, রানাঘাটের নাইটিঙ্গেলকে কোন বার্তা লতাজি দিলেন! রানু নিজে এবং 'রানু প্যাকেজ' যাঁরা তৈরি করেছেন, তাঁরা এই বার্তাটি পেলেন কি? রানু কি বুঝলেন, এগুলোতে কিন্তু তাঁর ইমেজ খারাপই হচ্ছে। তাঁর গান চাপা পড়ে আজেবাজে গল্প বড় হয়ে উঠছে। কথা হলো, এসব কারা, কী উদ্দেশ্যে করছে? রানু নিজে কি জানেন এসব? বুঝতে পারছেন এসবের প্রতিক্রিয়া?
পেশাদার জগতটা আসলে খুব কঠিন। রানুর মতো মানুষদের ক্ষেত্রে এই কঠিনতা জয় করা বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। একথা রানুর হয়ে যাঁরা হাওয়াযুদ্ধে নেমেছেন, তাঁরা আশা করি ভুলবেন না। রানুকে এখনও অনেক কিছু শিখতে হবে। গান তো বটেই, কথাবার্তা, আচারব্যবহারও। একটি ভিডিও দেখছিলাম, যেখানে রানুকে প্রশ্নের নামে উত্যক্ত করা হচ্ছে। প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছেন তিনি। প্রশ্নকর্তারা নিঃসন্দেহে রানুকে ছোট করতেই চাইছেন। এগুলো দৃঢ়ভাবে না আটকালে রানু হারিয়ে যাবেন। সব জায়গায় সব ধরনের মানুষকে ইন্টারভিউ দিলে চলবে না। এরও একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার। নিজের মাপটা বোঝাও জরুরি। চ্যানেল তাঁকে কিভাবে কাজে লাগাচ্ছে বা লাগাবে, এটা হয়তো বোঝা কষ্টকর। কিন্তু মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়া যে হুজুগে চলছে, তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই! এই হুজুগের রসদ কিন্তু তিনিই তুলে দিচ্ছেন মানুষের হাতে। যার মাতন ফুরিয়ে গেলেই বেলুন ফুসসস!