বাংলার রাজনৈতিক চর্চায় এখন নয়া নাম অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিন বা এআইএমআইএম এবং দলের সভাপতি তথা সাংসদ আসাউদ্দিন ওয়াইসি। তেলেঙ্গানা ভিত্তিক দল হিসাবে পরিচিত এআইএমআইএম বাংলার বিধানসভা ভোটের এক বছর আগে অর্থাত্ৎ ২০২০ সাল থেকে সংগঠন ও জনভিত্তি গড়তে ঝাঁপিয়ে পড়তে চলেছে বাংলার রাজনীতিতে। এদিকে তৃণমূল সুপ্রিমো তথা রাজ্যের মুখ্য়মন্ত্রী তোপ দেগে ও বিজেপি বিরোধিতা করে বাংলার মাটিতে পা রাখার আগেই ওয়েইসির দলের কিছুটা গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, 'বিজেপির দালাল' বলেও সমালোচিত হয়ে থাকে আইএমআইএম। কিন্তু, তা কি সত্যি? মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষা করাই কি একমাত্র উদ্দেশ্য এই দলের? বাংলায় তারা নির্দিষ্টভাবে কী চায়? তাদের কর্মসূচি কী? এখনই এআইএমআইএম কতটা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে এই রাজ্যে? একান্ত সাক্ষাৎকারে সব প্রশ্নের জবাব দিলেন এ রাজ্যে সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত জমিরুল হাসান।
প্রশ্ন- মুখ্যমন্ত্রী আপনাদের বিজেপির দালাল বলছেন.......
বিজেপির দালাল কারা তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। আপনারা দেখেছেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির কার্যকর্তারা কোথা থেকে এসেছেন। মুকুল রায়, অর্জুন সিং, শোভন চট্টোপাধ্যায়, সব্যসাচী এঁরা কোন দলে ছিলেন? এমন নাম বলে শেষ করা যাবে না। হাজার হাজার তৃণমূল কর্মী বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। আমাদের দলের একটা লোকও বিজেপিতে গিয়েছে নাকি? তাহলে দালাল কারা?
গত লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্যে আমাদের ৩৫ জন প্রার্থীর নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু আসাউদ্দিনসাহেব বললেন, এখানে আমরা প্রার্থী দিলে বিজেপি লাভ করবে। তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষতি হবে। তিনি যদি বিজেপির দালাল হতেন তাহলে তখনই প্রার্থী দিতে পারতেন। আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে ২২জন সাংসদ রয়েছেন তাহলে তাও থাকত না। তৃণমূলের ২জন বা ১ জন সংসদে যাওয়ার ছাড়পত্র পেতেন। বরং দালাল তো মমতাই। দু'বার এনডিএ-র সঙ্গে ঘর করেছেন উনি। কাল যে ফিরে যাবেন না, সে গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে?
এ রাজ্যে মুসলিমরা বেশিরভাগই তো তৃণমূলকে সমর্থন করছে। তাহলে আপনারা কাদের ভরসায় আসছেন?
এখানে মুসলিমদের বোকা বানানো হচ্ছে। খালি ইনসা আল্লা, মাসা আল্লা করে পেট ভরে না, তাতে ভাতও জোটে না। কাজ চাই, চাকরি চাই। জেনে রাখুন, প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি হল। সেখানে ৬৫ জন মুসলিম ছেলে লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছে। কিন্তু ৬৫ জনকেই ইন্টারভিউতে কেটে দিয়েছে। মাদ্রাসাতে আড়াই হাজার শিক্ষক নিয়েছে। তাঁরা সঠিক বেতন পাচ্ছেন না। এখন তাঁরা বেতনের দাবিতে অনশন করেছেন। মুকুল রায় গিয়েছিলেন, মমতাও গিয়েছেন। এবার ফিরহাদও গিয়েছেন। কিন্তু এক পয়সাও বেতন পায়নি। সব পুজো কমিটিকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। ক্লাবে ২ থেকে ৬ লক্ষ টাকা করে দিয়ে নষ্ট করা হচ্ছে। এই টাকা যদি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে দেওয়া হত, তাহলে উন্নতি হত। এখানে কাজ নেই, তাই তো কাশ্মীরে কাজে গিয়ে বাংলার মানুষ গুলি খাচ্ছে। রাজস্থান, বিহারে গিয়ে মারা পড়ছে। মুসলিমদের ধোকা দিয়েছে তৃণমূল।
আরও পড়ুন: ব্রিগেডে ওয়াইসি, তৃণমূলকে গুরুত্ব দিচ্ছে না এআইএমআইএম
আপনাদের পরিচিতি কিন্তু মুসলিমদের দল বলেই?
এটা একেবারেই ভুল ধারণা। এটা শুধু মুসলিমদের দল নয়। আমারা শুধু মুসলিমদের ক্ষমতায়ন চাই না, মুসলিম-সহ দলিত, আদিবাসীদেরও ক্ষমতায়ন চাই। মূল নিবাসীদের সঙ্গে নিয়েই আমাদের লড়াই। এরজন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনাও আছে। হায়দরাবাদ, মহারাষ্ট্রে অমুসলিম বিধায়ক রয়েছে আমাদের। ঝাড়খণ্ডে বিধানসভা নির্বাচনে আদিবাসী, দলিত প্রার্থী করেছে এআইএমআইএম।
এনআরসি নিয়ে এমআইএম কী ভাবছে?
আমরা এনআরসি করতে দেব না। তবে এর ফলে প্রয়োজনীয় নথি ঠিক করে নিয়েছেন মুসলিমরা। আর এনআরসি হলে আমরাই থাকব এদেশে। কারণ আমরা মূলবাসী। ডিএনএ পরীক্ষা করলে তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। বরং নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা এই দেশে থাকতে পারবেন না।
২০২১ বিধানসভা নির্বাচন আপনাদের লক্ষ্য কী? মুখ্যমন্ত্রী পদ নিয়ে কোনও আলোচনা হয়েছে?
২০২১ সালে বাংলায় দলিত মুখ্যমন্ত্রী হবে। আমাদের লক্ষ্য এ রাজ্যে দলিত মুখ্যমন্ত্রী করা। ইতিমধ্যে ১০ জন উচ্চশিক্ষিত দলিতের নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাঁরা আগামী দিনে দলের সভাপতির সঙ্গে বৈঠক করবেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী থেকে স্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা রয়েছেন।
২৯৪ আসনে মুসলিম ছাড়া আর কাদের প্রার্থী করবেন?
মুসলিম ছাড়া দলিত ও আদিবাসীদের প্রার্থী করা হবে। অনেক আসন রয়েছে যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা বেশি থাকলেও তা সংরক্ষিত আছে। সেখানে দলিত প্রার্থী দেওয়া হবে।
আরও পড়ুন: মমতাকে ফের বার্তা মুসলিম সংগঠনের নেতার
কী ভাবে জয় পাবেন মনে করছেন?
দেখুন আমাদের দল শুধু মুসলিমদের জন্য নয়। আমাদের দল সবার সঙ্গে ন্যায় করবে। বাংলায় মুসলিম ভোটারের সংখ্যা নিয়ে সবাই ভুল বলছে। যে যাই বলুক, এখানে মুসলিম ভোট রয়েছে ৪০ শতাংশ। সরকারও ভুল বলছে।
রাজনীতিতে আরএসএস কী চাইছে?
আরএসএসের একটা 'গেম' আছে। কংগ্রেস, তৃণমূল ও বিজেপির উচ্চবর্ণের মানুষকে ক্ষমতায় বসায় আরএসএস। এক দল ক্ষমতা না পেলে অন্য দলকে কাজে লাগায়। এটাই ওদের কাজ।
২০২১ সালে তাহলে কাদের বিরুদ্ধে লড়াই এআইএমআইএম-এর?
২০২১ সালে বিজেপি বনাম এআইএমআইএম। সেখানে তৃণমূল কোনও পিকচারে থাকবে না। তৃণমূল ভোট কেটে বিজেপির রাস্তা পরিস্কার করবে। জেনে রাখুন, আমরা কাটছি না ওরা কাটছে।
লড়াইটা তাহলে বিজেপির সঙ্গে?
মানুষ দেখবে লড়াই হবে আমাদের সঙ্গে বিজেপির। কংগ্রেস-সিপিএম কেউ থাকবে না।
বাংলা তাহলে তো অন্য রাজনীতি দেখবে?
দেখুন, পরিস্থিতি এমন না হয় যে তৃণমূল-কংগ্রেস-সিপিএম সব এক সাথে থাকে। ওরা চার-পাঁচটা সিট পেলে পাবে। এর বেশি পাবে না। যদি কিছু আসন আমরা কম পাই, তাহলে ওদের সমর্থন নিয়ে সরকার গড়ব। সিপিএম, কংগ্রেস শুধু নয়, দিদিও তখন আমাদের সমর্থন করবেন সরকার গড়তে। দিদি সমর্থন করতে বাধ্য হবেন। এখন মনে হচ্ছে বড় বড় কথা। কিন্তু এটাই বাস্তব হবে।
কলকাতায় রানি রাসমনি রোডে আপনারা একবার প্রকাশ্য সভা করেছিলেন.....
আসলে ২৮ জুলাই নজরুল মঞ্চে আমাদের সভা করার জন্য় অনুমতি নেওয়া ছিল। এর ঠিক দুদিন আগে সেই সভার অনুমতি বাতিল করে দেওয়া হয়। আমরা তড়িঘড়ি রানি রাসমনি রোডে সভা করার জন্য প্রস্তুতি নিই। ২৮ জুলাই রানি রাসমনি রোডে সভা করা হয়। সেখানে হাজার হাজার মানুষ বৃষ্টির মধ্যে সভা শুনেছিলেন। একজনও উঠে যাননি। এরপরই চিন্তায় পড়ে যান তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: মমতার কপালে চিন্তার ভাঁজ, বাংলায় আসছে নতুন রাজনৈতিক দল
আপনি তো আগে তৃণমূলেই ছিলেন?
১৯৯৩-৯৮ এ রাজ্য়ে এআইএমআইএম ছিল। এরপর দীর্ঘদিন এখানে সক্রিয় ছিল না। আমি নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় তৃণমূলের সঙ্গেই ছিলাম। তবে সিঙ্গুর আন্দোলন আমি সমর্থন করতে পারিনি। একটা শিল্প-কারখানাও হয়নি তৃণমূলের আমলে। আমি নিজে বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কোনও পাত্তাই দেয়নি। এরা মানুষের জন্য কিছু করছে না।
সংগঠনের কাজ প্রাথমিকভাবে কতটা এগিয়েছে?
ইতিমধ্যে রাজ্যের ২০০ ব্লকে আমাদের সংগঠনের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। প্রতি বুথে আমরা সদস্য করছি। বাকি ব্লকেও সাংগঠনিক কাজ চলছে। বেশ কয়েকটি জেলায় আমার মিছিল-মিটিং করেছি। সেই সব কর্মসূচিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ হাজির হয়েছেন। ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। এখানে পর্যবেক্ষক রয়েছেন সৈয়দ ওয়াসিম ওয়াকার। তিনি যা নির্দেশ দিচ্ছেন, আমি তা পালন করছি।
আরও পড়ুন: মমতাকে চরম জবাব মুসলিম সংগঠনের নেতার
আসাউদ্দিন ওয়াইসি কবে আসছেন কলকাতায়?
জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ওয়াইসিসাহেব কলকাতায় আসবেন। সেই সময় ব্রিগেডে সামবেশ করার কথা রয়েছে। আমাদের রাজ্য দফতরেরও উদ্বোধন হবে।
শুধু কি বিধানসভাতেই আপনারা প্রার্থী দেবেন?
আমরা কর্পোরেশন বা পুরসভাতেও প্রার্থী দেব। সে ক্ষেত্রে আমাদের ফল বেশ ভালই হবে। এখনই অনেক কাউন্সিলর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তাঁরা এআইএমআইএম-এ যোগ দিতে চাইছেন।