২০ সেপ্টেম্বর ইসলামপুরের দাড়িভিটে শহিদ দিবস পালন করবে বিজেপি। রাজ্যজুড়ে মাতৃভাষা দিবস পালন করবে গেরুয়া শিবিরের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি। অন্যদিকে নিহত দুই ছাত্রের পরিবার এক বছরেও কোনও বিচার না পাওয়ায় ছাড়তে চাইছে বিজেপি-সঙ্গ।
বছর ঘুরতে চললেও ইসলামপুরের দাড়িভিটের তাপস, রাজেশের ‘ঘাতক’রা এখনও অধরা। তাপসের মা মঞ্জু বর্মনের বক্তব্য, ‘‘বিজেপির সঙ্গে দিল্লি, কলকাতা ঘুরে বেড়ালেও ছেলে খুনিদের বিচার পাচ্ছি না। প্রয়োজনে বিজেপি ছেড়ে গ্রামবাসীদের নিয়ে ফের আন্দোলনে নামব। স্কুল আটকাব, রাস্তা অবরোধ করব’’। নিহত রাজেশের বাবা নীলকমল সরকার বলেন, ‘‘রাজ্যে বিজেপির সাংসদ হয়েছে ২ থেকে ১৮। আমাদের ছেলে দুটোকে নিয়ে ওদের ১০০ শতাংশ লাভ হয়েছে। আমরা খুনের বিচার চাই’’। এদিকে দুই নিহতের পরিবারের সদস্যদের ক্ষোভের কথা শুনে বিজেপির দাবি, ‘‘আমরা ওদের পরিবারের সঙ্গে আছি, ছিলাম, থাকব। ওদের উসকানি দিচ্ছে বিরোধীরা। আমরাও তো খুনিদের বিচার চাই’’।
আরও পড়ুন: ‘রাজীব কুমারের পরিণতির জন্য মমতাই দায়ী’
গত বছর ২০ সেপ্টেম্বর উত্তর দিনাজপুরের দাড়িভিট হাইস্কুলে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটেছিল। দুই শিক্ষকের নিয়োগকে কেন্দ্র ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন। তারপর স্কুলের দুই প্রাক্তন ছাত্রের গুলিতে মৃত্যু। খবরের শিরোনামে উঠে আসে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া দাড়িভিট গ্রাম। নিহত দু’জনের পরিবারের সদস্যরা দাবি করেন, পুলিশর গুলিতে মৃত্যু হয়েছে দুই যুবকের। কিন্তু রাজ্য সরাসরি সেই দাবি উড়িয়ে দেয়। সিআইডি তদন্ত চলে, কিন্তু এক বছর হতে চললেও তার রিপোর্টে কী আছে তাও রাজ্যবাসীর অজানা। এদিকে নিহতের পরিবার সিবিআই তদন্তের দাবিতে অনড়। হাইকোর্টে চলেছে সেই মামলা। এখনও পর্যন্ত কাদের গুলিতে তাপস ও রাজেশের মৃত্যু হয়েছে সেই রহস্য অধরা। এবার বিজেপির ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না তাদের পরিবার।
আরও পড়ুন: মোদীর সঙ্গে কথা বলে খুশি মমতা, আজ শাহর সাক্ষাতের অপেক্ষা
তাপসের মা মঞ্জু বর্মন বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত বিচারের কোনও লক্ষ্মণ দেখতে পাচ্ছি না। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হচ্ছে, আপনাকে ২০২১ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। ২০২১ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে করতে আমি যদি মারা যাই! আমার ছেলের বিচার কে দেখবে? আমি এই অপেক্ষায় থাকব না। ২০ সেপ্টম্বরে শহিদ দিবস পালন হবে। ওই দিন দেবশ্রীদির(কেন্দ্রীয়মন্ত্রী দেবশ্রী চোধুরী, রায়গঞ্জের সাংসদ) সঙ্গে কথা বলব। ৬ মাসের মধ্যে যদি সিবিআই তদন্ত শুর হয় বা বিচারের ভরসা পাই, তাহলে ঠিক আছে। তা না হলে আমি বিজেপি পার্টিতে থাকব না। আমি আর কোনও দলেই যাব না’’।
এখনও নিহত তাপস ও রাজেশের মরদেহ গ্রামে দলঞ্চা নদীর পাড়ে মাটির নীচে শায়িত রয়েছে। ঘটনার পর নানা আন্দোলন দেখেছে দাড়িভিট। দিনের পর দিন দাড়িভিট হাইস্কুল বন্ধ ছিল। বিজেপির বাংলা বনধে উত্তপ্ত হয়েছিল ইসলামপুর। নিহতের পরিবারকে নিয়ে বিজেপি নেতৃত্ব রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হয়েছে। গ্রামে গিয়েছিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। দ্বিতীয়বার মোদি সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও হাজির হয়েছিল দুই পরিবার। তারপর তাঁরা দেখা করেছিলেন সুষমা স্বরাজের সঙ্গেও।
আরও পড়ুন: ‘বৈশাখীর অভিমানের কারণ কি শোভনের পুরনো বান্ধবী?’
তাপসের মায়ের আক্ষেপ, ‘‘বিজেপি কিচ্ছু বলছে না। আজ এখানে, কাল ওখানে। আমার তো আর ঘোরার সময় নয়। দিল্লি বা কলকাতায় ঘুরতে যাচ্ছি না। ওদের সঙ্গে ঘুরছি ছেলের বিচার পাব বলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখছি কিছুই হচ্ছে না। সুষমা সরাজের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনি আমাদের ভরসা দিয়েছিলেন ১ মাসের মধ্যে তোমার ছেলের বিচারের ব্যবস্থা করব। আমি দেখা করার ১৪ দিন পরে মারা গেলেন’’। বিজেপির সঙ্গ ছেড়ে কি আন্দোলন করতে চাইছেন মঞ্জুদেবী? তিনি বলেন, ‘‘আর অন্য কোনও দলের কাছেও যাব না। ফের গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়ে আমি আন্দোলন করব। স্কুল আটকাবো, রাস্তা অবরোধ করবো। যা মন চাইবে তখন তাই করব’’।
নিহত রাজেশের পরিবারও বিজেপির ওপর বিতশ্রদ্ধ। তাঁরাও বিচারের আশায় বিজেপির সঙ্গে রয়েছেন বলে জানিয়ে দেন। রাজেশের বাবা নীলকমল সরকার বলেন, ‘‘এক বছর হয়ে গিয়েছে। এখনও কিছু হয়নি। বিচার তো যে ভাবেই হোক নিতে হবে। আমাদের শুধু যাওয়া-আসাই সার। এখনই কোনও সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না। কিছু দিন দেখব। আমাদের ছেলে দুটোকে নিয়ে ১০০ শতাংশ লাভ করেছে বিজেপি। রাজেশ ও তাপসের জন্য ২ থেকে ১৮টা সাংসদ হয়েছে। এখন যদি বিজেপি মনে করে ধীরে চলব, তা মানব না। একটাই দাবি বিচার চাই’’।
আরও পড়ুন: সারাদেশেই এনআরসি হবে, তালিকাছুটদের তাড়াব: অমিত শাহ
দাড়িভিট গ্রামের অনেকেই মনে করেন একটা বছরে কিছু হল না। গ্রামবাসী পবন সরকার বলেন, ‘‘গ্রামের লোক সুবিচারের আশায় আছে। ভোট রাজনীতির জন্য ওদেরকে ব্য়বহার করা হচ্ছে। রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য ওদের ব্যবহার করছে। এসেছিল মানবাধিকার কমিশন। সিআইডি তদন্তেরও কোনও রিপোর্ট আসেনি। স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের ঘটনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত স্কুলের পরিচালন সমিতিও শাস্তি এড়াতে পারেন না’’।
নিহতের দুই পরিবারের সদস্যরা তাঁদের ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন বিজেপি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। এদিকে উত্তর দিনাজপুর বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সুরজিত্ৎ সেনের দাবি, ‘‘বিরোধীরা ওদের বাড়িত গিয়ে উসকাচ্ছে। ওদের বিভ্রান্ত করছে। ওরা সাধারণ গ্রামের নাগরিক। ওঁরা রাজনীতির মারপ্যাঁচ বোঝেন না। ওঁদের যে যা পারছে বোঝাচ্ছে। আমরা পাহারা দিলে অনেকেই দেখা করতে পারতেন না। তৃণমূল দাঁড়াতে পারছে না, ওখানে সিপিএমকে কাজে লাগাচ্ছে’’। সুরজিত্ৎবাবুর মতে, ‘‘ওঁদের ক্ষোভ হওয়া স্বাভাবিক। ছেলেটা ওঁদের মারা গিয়েছে, বিজেপির মারা যায়নি। আমরা ওঁদের সমবদেনায় ব্যাথিত। ওঁদের পাশে থেকে ওঁদের আন্দোলনে সামিল হয়েছি। যে কারণেও হোক বছর ঘুরতে গেলও বিচার হয়নি’’।