তিনি দিল্লি গেলেন। তাঁর উদ্যোগে এক ঝাঁক টলিউড তারকা যোগ দিলেন পদ্মশিবিরে। মঞ্চে উপস্থিত থাকলেন দিলীপ ঘোষ, কিন্তু সেখানে তিনি স্পিকটি নট। কারণ, এই মুহূর্তে তিনি খানিকটা 'প্যাঁচে' পড়েছেন বলে গুঞ্জন। তবে তিনি তো মুকুল রায়, তাই যতই বাউন্সার আসুক 'ক্রিজে থাকলে রান পাওয়া যাবে' (মুকুল তাঁর এই জীবন দর্শনের কথা প্রায়ই বলে থাকেন) বলেই বিশ্বাস তাঁর। কিন্তু, এবার শুধু ক্রিজে টিকে থেকে দু-একটা রান করাই নয়, বৃহস্পতিবার এক ঝাঁক টেলি তারকাদের বিজেপিতে এনে মুকুল রীতিমতো ছক্কা হাঁকিয়েছেন বলেই খবর।
তৃণমূলের একদা 'প্রধান সেনাপতি' দল ছেড়ে পদ্ম শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। আর দল বদলের পর থেকেই পুরানো দল তৃণমূলের ঘর ভাঙাই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। আর এই লক্ষ্যে মোটের উপর 'সিদ্ধকাম' হিসাবে প্রমাণিতও হয়েছেন তিনি। মুকুল বিজেপিতে আসার পর থেকেই তৃণমূলের বড়-মাঝারি একাধিক নেতা ও বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিরা নাম লিখিয়েছে পদ্ম শিবিরে। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির এ রাজ্যে অসাধারণ সাফল্যের পর এই দল বদল ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু, সম্প্রতি দলের অন্দরেই 'ধাক্কা' খেয়েছেন মুকুল। তাঁর হাত ধরে তৃণমূল থেকে বিজেপি-তে আসার প্রক্রিয়ায় 'রেড সিগনাল' দেখিয়েছে দলীয় শীর্ষ নেতৃত্ব। আর এই আবহে টালিগঞ্জের একঝাঁক শিল্পীকে পদ্ম পতাকা তলে এনেই মাস্টার স্ট্রোকটি দিয়েছেন মুকুল, এমনটাই মত পর্যবেক্ষকদের একাংশের।
আরও পড়ুন- ‘জাতীয়’ অস্তিত্বের সংকটে তৃণমূল-সহ আরও দুই দল, কড়া নোটিস নির্বাচন কমিশনের
দ্বন্দ্বটা ঠিক কোথায়?
রাজ্য বিজেপি-র অন্দরে কান পাতলেই দুই লবির কথা শোনা যায়। মুকুলের হাত ধরে একের পর এক তৃণমূল নেতার বিজেপিতে আগমন এবং এর ফলে মুকুলের গুরুত্ব বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ হচ্ছিল বিরোধী পক্ষ। লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলাম বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এক সাংবাদিক বৈঠকে নিজের অস্বস্তির কথা স্বীকারও করেছিলেন। তারপর কাঁচরাপাড়া, হালিশহরের তৃণমূল কাউন্সিলররা দিল্লি গিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই ওই কাউন্সিলরদের একটা বড় অংশ ফিরে যান তৃণমূলেই। এরপরই দলের অভ্যন্তরে মুকুল রায়কে চাপে ফেলার চেষ্টা করে রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ। এমনকী, সম্প্রতি কলকাতায় মুকুলের নেতৃত্বে একটি যোগদান অনুষ্ঠানও বাতিল করে দেন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। এরপর মঙ্গলবার মুকুল বলেন, ‘‘দিল্লিতে আর কোনও যোগদান করানো হবে না। এখন থেকে অন্য দল থেকে বিজেপিতে আসতে চাইলে, তাঁদের রাজ্য বিজেপির সদর দফতরে যোগদান করানো হবে। দলের এই নির্দেশ মেনে চলব’’।
আরও পড়ুন- পদত্যাগ করেই তৃণমূলকে আক্রমণ সব্যসাচীর
মঙ্গলবারের মন্তব্যের আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই অভিনয় জগতের শিল্পীদের সেই দিল্লিতে নিয়ে গিয়েই যোগদান করানোর মধ্যে 'চাণক্য' মুকুলের সাফল্যই দেখছে রাজনীতির কারবারিদের একাংশ। স্বাভাবিকভাবে মুকুলকে রুখতে দলবদলের যে পদ্ধতিতে বাধা দিয়েছিল বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব তা মূলত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জন্যই। মুকুলের নাম না করে সাধারণভাবে বিজেপির সাংগঠনিক সম্পাদক জানিয়েছিলেন, এখন থেকে রাজ্যস্তরে যোগদান রাজ্য দফতরেই করাতে হবে এবং তা রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের অনুমোদন সাপেক্ষে। অর্থাৎ এতদিন সরাসরি দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে যোগদান করিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের যে বাহবা মুকুল কুড়াতেন এবং রাজ্য নেতৃত্বকে গুরুত্ব না দেওয়ার যে বার্তা দেওয়া হত তা আর হবে না। কিন্তু, সম্পূর্ণ 'অরাজনৈতিক' তারকাদের হাতে দলের পতাকা তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে তো আর বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের 'নিষেধাজ্ঞা' লাগু নয়। তাই এই রাস্তাই নেন 'চাণক্য' মুকুল, এমনটাই মত পর্যবেক্ষকদের একাংশের। এছাড়া, সেই যোগদান মঞ্চে যখন উপস্থিত স্বয়ং রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, তখন মুকুল যে বার্তা দিতে চান, তাও সবচেয়ে স্পষ্টভাবেই দেওয়া গিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন- 'মুকুলদার সঙ্গে আমায় মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করুন'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুকুলঘনিষ্ঠ এক বিজেপি কর্মীর বক্তব্য, "দাদাকে ওভাবে কি আটকানো যায়। টলিউডের তারকারা দিল্লি গিয়ে বিজেপিতে যোগ দিলেন তো! দলে অনেকেই অনেক কথা বলেছিলেন। তাঁরা এখন কী বলছেন জানি না।" রাজনীতির কারবারিদের একাংশ মনে করছে, ঘুরপথে ছক্কা হাঁকালেন মুকুল রায়। কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তাঁর নেতৃত্বে দিল্লি গিয়ে যোগ দিলে ফের বিতর্ক শুরু হত দলের ভিতর ও বাইরে। কারণ, যেই যোগ দিতেন সেক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলা খুব স্বাভাবিক ছিল। সেই বিতর্ক এখনই চাইছেন না মুকুল। এক্ষেত্রে তাই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ঢাল করলেন তিনি। সব দেখে শুনে গেরুয়া শিবিরের বহুদিন কাটানো এক নেতার মন্তব্য, ঘরে হোক বা বাইরে মুকুল তাঁর বিশ্বাসে অবিচল, 'ক্রিজে থাকলে রান পাওয়া যাবে'।