ভরত সুন্দর্শন
‘বল বিকৃতি’! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শিরোনামে এখন এই শব্দবন্ধটাই জ্বলজ্বল করছে। বল বিকৃতির মাস্টার প্ল্যানে যুক্ত থেকে নিজেকে তো বটেই, অস্ট্রেলিয়া দেশকেও অসম্মানিত করেছেন স্টিভ স্মিথ। এই মুহূর্তে তাঁর আন্তর্জাতিক কেরিয়ার দোদুল্যমান। ক্রিকেট থেকে আজীবন নির্বাসিত হওয়ার খাঁড়াও ঝুলছে স্মিথের মাথার উপর।কেপ টাউনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তৃতীয় টেস্টের তৃতীয় দিনে অজি ক্রিকেটার ক্যামেরন ব্যানক্রফট শিরিষ কাগজ জাতীয় কিছু দিয়ে বল ঘষছিলেন। ব্যানক্রফটের এই কীর্তি তৎক্ষণাৎ টিভি ক্যামেরায় বন্দি হয়ে যায়।কিন্তু এই বল বিকৃতি কেন? সে সম্পর্কিত খুঁটিনাটি এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হল।
আরও পড়ুন, জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে কোচ নিযুক্ত করল অস্ট্রেলিয়া
কেন ফিল্ডিং সাইড বলের একটা প্রান্ত চকচকে ও অপর প্রান্ত অমসৃণ রাখতে চায়?
প্রথম ১০-১৫ ওভারে বোলাররা প্রথাগত সুইংয়ের দিকেই ফোকাস করেন, এরপর বলটা অপেক্ষাকৃত অনুজ্জ্বল ও জেল্লাহীন হয়ে পড়ে। ইনসুইংয়ের ক্ষেত্রে সিম মুভমেন্ট লেগ স্লিপের দিকেই থাকে। আউটসুইংয়ের ক্ষেত্রে প্রথম স্লিপের দিকে। বাতাসে বলের গতিবিধি ঠিক রাখার জন্য গ্রিপ বদল করতে হয় বোলারদের। চলতি দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়া সিরিজে মেশিনে সেলাই করা কোকাবুরা বলে খেলা হচ্ছে। এই বলে দ্রুত সেলাই উঠে গিয়ে চামড়ার সঙ্গে মিশে যায়। হাতে সেলাই করা ডিউকস বা এসজি-র বলে এ ব্যাপারটা ঘটে আরও বেশ কিছু সময় পরে। বলের দুদিকই মসৃণ হয়ে গেলে হাওয়ায় বল সুইং করাতে সমস্যায় পড়েন বোলাররা। যে কারণে বলের একটা দিক চকচকে ও অপরপ্রান্ত অমসৃণ রাখতে হয়।
আরও পড়ুন, কোচিং ছাড়তে চান লেহম্যান, কাঁদলেন স্মিথ, নিজেকে মিথ্যাবাদী বললেন ব্যানক্রফট
রিভার্স সুইং কী?
ক্রিকেটে ইন সুইং ও আউট সুইংকে প্রচলিত সুইং হিসেবেই পরিচিত। অপ্রচলিত সুইং হলো রিভার্স সুইং। যখন ম্যাচের বল পুরনো হয় আসে তখন বলের চকচকে প্রান্ত বরাবর বল মুভ করে। ঘর্ষণের জন্য অমসৃণ প্রান্তের তুলনায় বলের চকচকে প্রান্তের উপর দিয়ে বাতাস দ্রুত প্রবাহিত হয়। পুরো বিষয়টাই নির্ভর করবে বলের চকচকে দিকটা যত বেশি ভারি হবে তার উপর ভিত্তি করে। বলে ক্রমাগত থুতু বা ঘাম লাগিয়েই বলের চকচকে দিকটা ভারি রাখা হয়।
বল কি রুক্ষ হলেই রিভার্স সুইং করতে শুরু করে দেয়?
না, বিষয়টা একেবারেই সেরকম নয়, এরকমটা হলে ওয়াসিম আক্রম ও ওয়াকার ইউনিসের মতো কিংবদন্তি ক্রিকেটাররা সব দলে থাকতেন। রিভার্স সুইং করানোর জন্য বলের গতিবেগ ৮৫ মাইল (১৩৭ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়) বা তারও বেশি হতে হবে। বলের লেট মুভমেন্টের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য ব্যাটসম্যান কোনও সময়ই পাবে না। বোলিং অ্যাকশন হতে হবে অনেকটাই ক্ষিপ্র, যেমনটা ওয়াকার ইউনিসের ছিল।একমাত্র থুতু বা ঘাম ব্যবহার করেই বলকে চকচকে রাখার নিয়ম আইনসিদ্ধ।
আরও পড়ুন. শাস্তি কমানোর আবেদন করবেন না স্টিভ স্মিথ-ব্যানক্রফট
কোন কোন জিনিস ব্যবহার করে বলকে রুক্ষ করা হয়?
ক্রিকেটাররা এক প্রকারের ছোট ব্লেড ব্যবহার করেন, যা আঙুলের মধ্যে প্রোটেকটিভ টেপের ভিতর লুকানো থাকে। ট্রাউজারের চেইন, বোতলের ছিপি, শিরিষ কাগজ ও জুতোর স্পাইক দিয়েও বল বিকৃতি করা হয়, অনেকে নখ দিয়েও করেন। ব্যানক্রফট এক ধরণের হলুদ টেপ ব্যবহার করেছিলেন, যাতে খুব ভালো মানের আঠা ছিল। এর আগে ক্রিকেটে এরকম টেপ ব্যবহৃত হয়নি। সাধারণত দলের চার-পাঁচ জনের হাত ঘুরেই বোলারের কাছে বল পৌঁছে যায়। তেমন তেমন ক্ষেত্রে সবাই বল বিকৃতিতে অবদান রাখতে পারেন। অনেক সময়ে বোলাররা ইচ্ছা করেই স্পাইক জুতো পরে বলের উপর দাঁড়িয়ে পড়েন। ব্যানক্রফটের আগে এই সিরিজে অজি বোলার প্যাট কামিন্স এরকম ঘটনা ঘটিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন, স্টিভ স্মিথের হয়ে ব্যাট ধরলেন সৌরভ, বললেন অজি ক্যাপ্টেন প্রতারক নন
বেআইনি ভাবে কীকরে বলকে চকচকে রাখা হয়?
খেলোয়াড়রা মিন্টের সঙ্গে থুতু লাগিয়ে বলের চকচকে প্রান্তটাকে ভারি করেন। এর ফলে দুরন্ত রিভার্স সুইং হয়। লালা লাগিয়ে বল বিকৃতির পদ্ধতি ইংল্যান্ডে আবিষ্কৃত হয়েছ বলে মনে করা হয়। এরপর ক্রমে তা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।ভারতীয় ক্রিকেটাররা এই পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য শুরুতে পপিন্স ও পরে অ্যালপেনলিবে ক্যান্ডি ব্যবহার করেন।২০০৫-এর অ্যাশেজ সিরিজে প্রাক্তন ইংল্যান্ড ওপেনার মার্কাস ট্রেসকোথিক বল চকচকে করার জন্য মারে মিন্ট ব্যবহার করেছিলেন। ২০০৮-এ সেকথা স্বীকার করেন তিনি। ২০১৬-তে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক ফাফ দু প্লেসিস এভাবে মিন্ট লাগিয়ে বল বিকৃত করে জরিমানা দিয়েছিলেন। এছাড়াও বল চকচকে রাখার জন্য হেয়ার জেল, স্যান ট্যান লোশন, লিপ বাম, জেলি বিনস ও ভ্যাজলিন ব্যবহার করা হয়। এসবের ব্যবহার বেআইনি জেনেও এমনটাই দস্তুরমত অভ্যাস করে ফেলেছেন ক্রিকেটাররা।
অনুলিখনঃ শুভপম সাহা