/indian-express-bangla/media/media_files/2025/08/26/narugopal-hait-civic-volunteer-1-2025-08-26-14-48-01.jpg)
ছবিটি প্রতীকী
Narugopal Hait: নাড়ুগোপাল হাইত। এই নামটা আপনাদের অনেকের কাছেই হয়ত পরিচিত। একটা সময় বাংলার বাঘা-বাঘা ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলেছেন তিনি। কিন্তু, অদৃষ্টের কী পরিহাস! সামান্য একটা চোটেই বদলে গেল গোটা জীবন। ফুটবল খেলা আজ তাঁর কাছে বিলাসিতা। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। আর সেকারণেই সিভিক ভলান্টিয়ারের (Civic Volunteer) চাকরি করে কোনওক্রমে দিন কাটাচ্ছেন। বাংলার একজন তারকা ফুটবলার (Bengal Footballer) আজ কীভাবে হলেন একজন সিভিক ভলান্টিয়ার? আসুন, সেই করুণ কাহিনী জেনে নেওয়া যাক।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে নাড়ুগোপাল হাইত বললেন, 'ছোটবেলা থেকেই দারিদ্রতা ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। ছোটবেলা থেকেই বাবা নিরুদ্দেশ। আজ পর্যন্ত তাঁকে চোখে দেখিনি। মা একটা অনাথ আশ্রমে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই বড় হয়ে উঠেছি। ১৯৯৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর থেকে ফুটবলের প্রতি ভালবাসা জন্মাতে শুরু করে। আমি হাড়োয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে থাকি। সেইসময় এখান থেকে প্রতিদিন স্টেশন যাওয়া যথেষ্ট কষ্টসাধ্য একটা কাজ ছিল। প্রতিদিন ৭-৮ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে সেটাও করেছি। একে তো প্রতিদিনের এই কষ্টের জীবন, তার উপর দোসর ছিল আর্থিক অনটন। এভাবেই আমি নিজের ফুটবল কেরিয়ার শুরু করেছি।'
কেরিয়ারে শুরুর কথা
এই প্রসঙ্গে আপনাদের জানিয়ে রাখি, ১৯৯৯ সালে নাড়ুগোপাল হাইত পঞ্চম ডিভিশনের হয়ে খেলা শুরু করেন। সেখান থেকে আসেন ইউনাইটেড স্টুডেন্টে। সেখান থেকে রেওয়াজুল মোস্তাফার হাত ধরে তিনি তালতলা দীপ্তিতে যোগ দেন। এরপর নাড়ুগোপালের জীবন আগের তুলনায় অনেকটাই স্বচ্ছ্বল হয়ে উঠেছিল। তালতলা দীপ্তি থেকে তিনি মহমেডান এসি'তে যোগ দেন। বললেন, 'সেইসময় মহমেডান এসি'তে টাকা-পয়সা একেবারেই যৎসামান্য ছিল। শুধুমাত্র ভাল খেলার তাগিদে, নাম-ডাকের লোভে এই ক্লাবে থেকে যাই। পরের বছর এই দলটার অবনমন হলেও, আমাকে এই দলের অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল।'
Mohammedan Sporting Club: 'নো ইনভেস্টর, নো ভোট...', মুখ্যমন্ত্রীর ছবি হাতে বিক্ষোভ মহমেডান সমর্থকদের
'জর্জ টেলিগ্রাফে কথা পাকা হলেও শেষপর্যন্ত যেতে পারিনি...'
বাংলার এই ফুটবলারের প্রত্যেকটা কথাতেই যেন যন্ত্রণা ফুটে উঠছিল। তাঁর কথায়, 'সেখান থেকে আমি বাংলার হয়ে অনূর্ধ্ব-২১ দলে খেলার সুযোগ পেলাম। সেই বছরই আবার গুরগাঁওয়ে সন্তোষ ট্রফি আয়োজন করা হয়েছিল। আচমকা একদিন নবাব ভট্টাচার্য আমার বাড়িতে হাজির। সেইসময় জর্জ টেলিগ্রাফের সঙ্গে কথাবার্তা প্রায় পাকা হয়ে গেলেও, শেষপর্যন্ত ব্যক্তিগত কারণে সই করতে পারিনি। শেষপর্যন্ত ইউনাইটেড স্পোর্টসে আমি সই করলাম। সেখানে ২-৩ বছর খেললাম। এই সময় একটা প্রীতিম্যাচ খেলতে গিয়ে আমি চোট পেয়েছিলাম। সেকারণে প্রায় ১ বছর খেলাধুলোর থেকে দুরে ছিলাম। তবে নবাব'দা আবারও আমাকে ডেকে নেন। ২০১২-১৩ মরশুমে আবারও মহমেডান ক্লাবে যোগ দিই। সেইসময় মহমেডান দ্বিতীয় ডিভিশন খেলছে। দ্বিতীয় ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম ডিভিশনে তুললাম। এরপর ক্লাব আর আমাদের রাখল না। টাকা-পয়সাও সেভাবে পাইনি। এরপর সাদার্নে যোগ দিলাম। কিন্তু, এই ক্লাবেও টাকা-পয়সা নিয়ে যথেষ্ট টানাটানি চলে।'
মোটরবাইক দুর্ঘটনাই কেড়ে নিল যাবতীয় স্বপ্ন
এমন সময় একটি মোটরবাইক দুর্ঘটনাই কেড়ে নেয় নাড়ুগোপাল হাইতের যাবতীয় স্বপ্ন। শেষ করে দেয় ফুটবল কেরিয়ার। তিনি বললেন, 'সালটা ছিল ২০১৪-১৫। তখন আমি কলকাতায় থাকতাম। সাদার্নের হয়ে খেলে পরদিন সকালবেলা বাড়ি ফিরছিলাম। স্টেশন থেকে বাইক চেপে বাড়ি ফেরার সময় আচমকা দুর্ঘটনা ঘটে। হাঁটুর উপর থেকে একটা বড় মাংসপিণ্ড উঠে গিয়েছিল। এরপর এক বছর ফুটবল খেলতে পারিনি। অবশেষে পুলিশ এসি'তে সই করলাম। ওই বছরই শেষ। এরপর ফুটবল খেলা থেকে সরে এলাম। সেইসময় আয় অনেকটাই কমে গিয়েছিল। অবশেষে ২০১৭-১৮ সাল থেকে ছোটখাট ক্লাবে কোচিং শুরু করি।'
Mohun Bagan Super Giant: বেহালায় বাজল বিষাদের সুর, পাঁচ গোলের মালা পরিয়ে জয় মোহনবাগানের
বাংলার ফুটবলার আজ সিভিক ভলান্টিয়ার
নাড়ুগোপাল হাইত ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে আরও বললেন, 'এরপর পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুন্দরবন কাপ চালু করে। আজ এই টুর্নামেন্টটা কেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে জানি না। তবে এই টুর্নামেন্টের জনপ্রিয়তা ছিল একেবারে চোখে পড়ার মতো। আমি যে জায়গা থেকে ফুটবল খেলা শুরু করেছিলাম, সেই সম্মিলনীর হয়ে এই টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ দুটো মরশুমেই আমরা রানার্স আপ হয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত ফাইনালে হেরে যাই। সেইসময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, ফাইনালিস্ট দুটো দলকেই সিভিক ভলান্টিয়ারের চাকরি দেওয়া হবে। সেই প্রতিশ্রুতি মেনেই ২০২১ সালে আমাদের নিয়োগ হয়। তারপর থেকে এভাবেই চলছে।'
সঙ্গে তিনি আরও যোগ করেন, 'এখন আমি প্রতিদিন নাইট ডিউটি করি। আর নিজের মধ্যে ফুটবলটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রায় প্রতিদিন অনুশীলন করি। যে জায়গা থেকে আমি ফুটবলে এতকিছু পেয়েছি, সেখানেই কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। আমার সীমিত শিক্ষা দিয়ে যদি কাউকে ন্যুনতম কিছু শেখাতে পারি, সে যদি কলকাতায় গিয়ে ফুটবল খেলতে পারে, তাহলেই নিজেকে সফল বলে মনে করব। আমি কোনও কাজকেই ছোট করি না। তবে একজন ফুটবলারের পক্ষে সিভিক ভলান্টিয়ারের চাকরি মেনে নেওয়া সত্যিই খুব কঠিন। পরিবারের দিকে তাকিয়ে আজ এই কাজ করতে বাধ্য হই।'
East Bengal FC: 'পচা শামুকে পা কাটল...', ইস্টবেঙ্গলের হার নিয়ে হতাশ গৌতম সরকার
শেষকালে তিনি বললেন, 'আজ আমার বয়স অনেকটাই হয়ে গিয়েছে। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাকে কে আর চাকরি দেবে? তবুও রাজ্য সরকারকে ধন্যবাদ যে অন্তত এইটুকু অন্ন সংস্থানের জোগাড় করে দিয়েছে। কিন্তু, যে টাকা আমরা হাতে পাই, তাতে একটা সংসার কোনওমতে চালানো সম্ভব হয়। এরথেকে বেশি কিছু করতে হলে অবশ্যই চিন্তাভাবনা করতে হয়। সবমিলিয়ে এভাবেই আপাতত দিন কাটছে।'