অলনাইন ক্লাসের পাশাপাশি অনসাইট অর্থাৎ একবারে হাতে-কলমে রাহুল স্যারের কোচিং-এ ভোলবদল ঘটছে ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমির (NCA)। এবার আরও বড় দায়িত্ব দ্রাবিড়ের ওপর। যিনি অবসরের পর ভারতীয় এ ও অনূর্ধ্ব ১৯ দলের প্রশিক্ষক ছিলেন। পরে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হয়ে আসার পর দেশের তরুণ প্রজন্মকে পরিচর্যায় দায়িত্ব দিয়েছিলেন দ্রাবিড়কেই। বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির প্রধান করে বসানো হয়েছে দ্রাবিড়কে।
শ্রীলঙ্কায় দ্বিতীয় সারির ভারতীয় দল নিয়ে গিয়ে ওয়ান ডে সিরিজ জয়। এবং টি-টোয়েন্টি সিরিজে করোনা বিদ্ধস্ত অবস্থাতেও হাল না ছেড়ে লড়াই করা। শ্রীলঙ্কা ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতে নিলেও সর্বস্তরে প্রশংসিত হয়েছিল ভারতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার ও কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের মানসিকতার। দ্রাবিড়কে ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমি (NCA) তে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত খুশি ঋষভ পন্থ থেকে মহম্মদ সিরাজ, শ্রেয়স আয়ার থেকে দীপক চাহার। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে এই ভূমিকায় কাজ করছেন রাহুল।
আরও পড়ুন: একের পর এক সুপারস্টার নেই IPL-এ, রং হারিয়ে বেশ বিবর্ণ কোটি কোটির টুর্নামেন্ট
বছরের শুরুতে তাঁর চুক্তি শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি আবার আবেদন করেছেন। আবার এনসিএ শীর্ষ পদে বসতে চলেছেন। ভবিষ্যতে তিনিও দেশের মাটি থেকে একাধিক প্রতিভা তুলে আনতে চান। সেই অভিজ্ঞতা থেকে অনেক প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার মনে করেন রাহুল যেভাবে তরুণ ক্রিকেটারদের আত্মবিশ্বাস তৈরি করেন এবং বড় মঞ্চের জন্য মানসিকতা গড়ে দেন, তার তুলনা হয়না।
রাহুল স্যারের কোচিং পেয়ে মুগ্ধ প্রাক্তন থেকে বর্তমান সকলেই। ইরফান পাঠান যেমন স্পষ্ট জানিয়েছেন, রাহুল দ্রাবিড় ছিলেন বলেই ভারতের তরুণ ক্রিকেটারদের সাপ্লাই লাইন আজ এত মজবুত। কখনও তাড়াহুড়ো করেন না, অত্যন্ত চিন্তাশীল এবং ক্রিকেটের প্রতি দায়বদ্ধ। এটাই রাহুল দ্রাবিড়। আর সেই চিন্তাশীলতাকে কাজে লাগিয়েই দেশের হয়ে আগামীর খেলোয়াড়দের ঘষা-মাজা করে পুরদমে তৈরি করে দিচ্ছেন রাহুল 'স্যার'। এনসিএ বা অনূর্ধ্ব ১৯, রাহুল দ্রাবিড় যতক্ষণ দায়িত্বে, প্রত্যেক ক্রিকেটার ভবিষ্যতের জন্য নিশ্চিন্ত।
আরও পড়ুন: ৪ কোটির তারকাকে হারাচ্ছেন কোহলিরা, আইপিএল শুরুর আগেই ব্যাপক চাপে আরসিবি
ঋষভ পন্থ থেকে মহম্মদ সিরাজ, শ্রেয়স আয়ার থেকে দীপক চাহার। এঁদের সঙ্গে রণদেব বসু, সৌরাশিস লাহিড়ী, অরিন্দম দাস এদের মিল আছে এক জায়গাতে। এক কথায় বললে, ভারতের ভবিষ্যতের ক্রিকেটার হোক বা কোচ, সবাই-ই বেড়ে উঠছেন রাহুল দ্রাবিড়ের পরিচর্যায়। সোজা কথায়, ক্রিকেটার তৈরির পাশাপাশি ভারতের নয়া প্রজন্মের কোচ তৈরির কাজটাও করে চলেছেন জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির প্রধান রাহুল। যিনি নতুন করে এই পদের জন্য আবেদন করেছেন এবং থেকেও যাচ্ছেন এনসিএ প্রধান হিসাবেই।
বেঙ্গালুরুর অ্যাকাডেমিতে সদ্য কোচিং কোর্স করে এলেন রণদেব, সৌরাশিস, অরিন্দমরা। এবং স্বাভাবিক ভাবে প্রত্যেকেই মুগ্ধ। কোর্সের পোশাকি নাম, ফার্স্ট-ট্র্যাক হাইব্রিড লেভেল-২ কোচেস কোর্স। পুরো কোর্সটাই রাহুলের নিজে হাতে সাজিয়েছেন দ্রাবিড় । ৭৫ বা তার বেশি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা ক্রিকেটাররা সরাসরি যোগ দিতে পারবেন এই কোর্সে।
আরও পড়ুন: সিঙ্গাপুরের প্রথম তারকা হিসাবে আইপিএলে! আরসিবির নতুন তারকার প্রোফাইল চোখ ধাঁধাবে
দেশের প্রাক্তন ক্রিকেটাররা আরও বেশি করে যাতে কোচিংয়ে আসেন, সেটাই লক্ষ্য এই কোর্সের। বাংলার তিন প্রাক্তনের পাশাপাশি ঘরোয়া ক্রিকেটে পরিচিত সৌরাষ্ট্রের সাগর জোগিয়ানি, হরিয়ানার উদয় কালরা ছিলেন আগামী দিনে দেশের কোচ হিসেবে নিজের প্রতিষ্ঠা করার দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে এই কোর্স শেষে।
অলনাইন ক্লাসের পাশাপাশি অনসাইট অর্থাৎ একবারে হাতে-কলমে ক্লাস হয়েছে সেই স্কুলের ধাঁচেই। সেই প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসকে বলা হয়েছিল ল্যাব। প্রশ্ন হল, কোচ তৈরির কারখানায় কী ভাবে যোগদান করতেন রাহুল? জবাব হল, সর্বত্রই ছিল রাহুলের উজ্জ্বল উপস্থিতি। হাতে-কলমে সেখানে তো বটেই, প্রায় সব ক্লাসেই চলে আসতেন দ্য ওয়াল। গ্রুপ ডিসকাশনে অংশ নিতেন একেবারে বন্ধুর মতো , হেডমাস্টারের ঢঙে নয়।
আরও পড়ুন: আচমকা পদত্যাগ কোহলির দলের হেড কোচের! বড় খবরে তোলপাড় ক্রিকেট দুনিয়া
যার যা অসুবিধা মন দিয়ে শুনে সেই সমস্যা সমাধানের আপ্রাণ চেষ্টা করতেন রাহুল স্যার। এক তরফা রাহুলই যে নিজের বক্তব্য রেখে যাচ্ছেন তেমন না। উল্টে সবাই মিলে নিজের মতামত দিতে পারবেন। সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে নতুন কোনও দিশা। কখনও সখনও ক্লাসে ছাত্রের মতো বসে পড়তেন দ্রাবিড়। কোর্সে থাকা কোচেদের সঙ্গে টাস্কে মাততেন।
সৌরাশিস লাহিড়ী যেমন বলছিলেন, "রাহুল ভাই এক কথায় অ্যামেজিং। প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি ব্যাপারে ওঁর নজর। পুরো কোর্সটাই ওর তৈরি করা। শুধু তৈরি করাই নয়, সেটা সার্থক ভাবে রূপায়ণ করার কাজটাও করে যাচ্ছে রাহুল ভাই। সত্যি বলতে, পুরো কোর্সের সঙ্গে ওঁকে সামনে থেকে প্রতিটা মুহূর্ত পাওয়াও একটা বড় প্রাপ্তি।"
কোর্স তো নয়, পুরোটাই যেন একটা টিম চালানোর মতো। উপলব্ধি হল রণদেব, সৌরাশিস, অরিন্দমদের। ভিডিয়ো অ্যানালিস্ট, বায়ো মেকানিক্স থেকে ফিজিওদের নিয়ে কী ভাবে কাজ করতে হবে, সেটাও শিখেছেন উঠতি কোচেরা। আবার দেওয়া হয়েছে প্রোজেক্ট। সৌরাশিস এখন বাংলার সহকারী কোচ। আগামী তিন মাসের কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জমা দেবেন নিজের প্রোজেক্ট। কোনও টিমের কোচিং না করলেও ব্যক্তিগত ভাবে কোনও ক্রিকেটারের উপর কাজ করে প্রজেক্ট জমা দিতে হবে রণদেব, অরিন্দমদের। সব মিলিয়ে ক্রিকেটারদের মতো দ্রাবিড়ীয় ঘরানায় একঝাঁক কোচ প্রাপ্তির স্বপ্ন দেখতেই পারে ভারতীয় ক্রিকেট।
রাহুল দ্রাবিড়ের নেতৃত্বে, জাতীয় ক্রিকেট একাডেমি কোচিং ম্যানুয়ালটি সম্পূর্ণ নতুন ভাবে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। প্রশিক্ষণের পদ্ধতিও পাল্টেছে। এখন এনসিএ-র সব থেকে বড় আকর্ষণ সেখানকার 'কর্পোরেট ক্লাস'। নতুন কোচ তৈরির তালিমে নতুন এক প্ল্যাটফর্ম। সম্প্রতি, বিশিষ্ট প্রাক্তন প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটারদের একটি ব্যাচ সেই কোর্সে অংশও নিয়েছিল। কোর্স শেষে একেবারে ছাত্রসুলভ আচরণ মেনে তারা প্র্যাক্টিকাল এবং থিওরি পেপারে পরীক্ষাতেও বসেছিলেন।
আধুনিক কোচদের জন্য কোচিং মডিউলকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য, একটি আনন্দদায়ক বিস্ময়কর বিষয় হল একটি 'কর্পোরেট সমস্যা সমাধানকারী ক্লাস' চালু করা,যেখানে মাঠের মধ্যে এবং মাঠের বাইরের সমস্যাগুলির সহজেই সমাধান সুত্র মেলে।
নতুন এই কোর্সটি ডিজাইন করেছেন মুম্বাইয়ের প্রাক্তন সিমার ক্ষেমাল ওয়াইনংকর। যিনি নিজেও একজন কর্পোরেট জগতের ব্যক্তি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোর্সে অংশ নেওয়া বিশিষ্ট প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার একটি সর্বভারতীয় সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন, “আমি কখনো এইরকম ক্লাস দেখিনি কিন্তু এটা খুবই অনন্য। এবং আমাকে আমার নতুন দিগন্ত বিস্তৃত করতে সাহায্য করেছে, এই কোর্স।"
কর্পোরেট ক্লাস ইস্যুতে তিনি বলেন 'এটি তর্ক এবং আলোচনার মধ্যে পার্থক্য বোঝাতে বিশেষ ভাবে সাহায্য করে'। তার কথায়, "সমস্যার মোকাবিলা করার প্রয়োজন নেই, কিন্তু সেই সমস্যার কারণে আরও কী কী নতুন সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে সেদিকে আলকপাত করার কথা আমাদের বলা হয়েছে এই কোর্সের মাধ্যমে।"
বিস্তারিত জানতে তিনি একটি উদাহরণও সামনে এনেছেন। কী সেই উদাহরণ? “কোর্স ইন্সট্রাক্টর (ক্ষেমাল) দুজন কোচ বেছেছিলেন বোঝানোর জন্য। পার্সন এ এবং পার্সন বি। পার্সন এ কে বলা হয়েছিল তিনি 'কোচ' এবং পার্সন বি কে বলা হয় যে তিনি ‘নির্বাচক’ তিনি তাদের দুজনকেই একটি করে ওয়ার্কশিট দেন। অ্যাসাইনমেন্টটি ছিল, নির্বাচককে দলে তিন নতুন খেলোয়াড়কে বাছতে হবে দলের জন্য”।
“তার ওপর বিভিন্ন দিকের চাপ রয়েছে। সেই চাপ সামাল দিয়ে কীভাবে তিনি তার লক্ষ্যে স্থির থাকবেন! এখন কোচ অর্থাৎ পার্সন এ তিনি জানেন মাত্র দুজনকে দলে জায়গা দিতে পারবেন, এবং একজনকে অনুর্দ্ধ একাদশ দলে জায়গা দিতে পারবেন। এরপর পার্সন এ এবং পার্সন বি উভয়কেই আলোচনার চূড়ান্ত দক্ষতা তুলে ধরতে বলা হয়”।
“উদ্দেশ্য ছিল তারা এইরকম পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করে সেটাই দেখা। এটাই দেখার বিষয় সমস্যা সমাধানের জন্য কোচ কার পরামর্শ নিচ্ছেন, সহকারী কোচ, দলের ক্যাপ্টেন নাকি পারফরম্যান্স বিশ্লেষকের! এবার প্রশ্ন হল নির্বাচক এই বিষয়ে কিভাবে কোচকে বোঝাবেন”
“এই কাজে তিনি কার কার থেকে সাহায্য নেবেন সহকারী নির্বাচক, নাকি প্রশাসকদের! তিনি বলেন কে কিভাবে কার সঙ্গে আলোচনা করলো সেটা বড় বিষয় নয়, কিভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যায় সেটাই এই কোর্সের মুখ্য উদ্দেশ্য”।
“কোর্স শেষে, সবাই যে যার শহরে ফিরে গিয়ে আগামী তিন মাসে কমপক্ষে একজন খেলোয়াড়েকে বেছে নিয়ে তার বিষয়ে একটি প্রোজেক্ট রিপোর্ট বানাতে হবে”। প্রাক্তন এই তারকা বলেন “এটি কোর্সের এক আকর্ষণীয় অংশ। আমাদের সকলকে
একজন খেলোয়াড় বেছে নিয়ে তার বোলিং ব্যাটিং সহ নানাবিধ দিককে খুঁটিয়ে দেখে তা বিশ্লেষণ করে সেটির সম্পূর্ণ এক ভিডিও রেখে এই প্রোজেক্ট রিপোর্ট বানাতে হবে সকলকে”। তিনি আরও বলেন “সেই প্রোজেক্ট থেকে সেই খেলোয়াড়ের ভুলত্রুটির বিভিন্ন দিককে বেছে নিয়ে তা সংশোধন করে আবারও নতুন করে একটি প্রোজেক্ট বানাতে হবে কোর্স অনুযায়ী”।
কোর্সে অংশ নেওয়া কিছু বিখ্যাত অতীত এবং বর্তমান খেলোয়াড় রবিন বিস্ত, জাকারিয়া জুফরি, প্রভঞ্জন মল্লিক, উদয় কউল, সাগর যোগিয়ানি, সর্বজিৎ সিং, অরিন্দম দাস, সৌরাশিস লাহিড়ী, রণদেব বোস, কেবি পবন এবং কোনর উইলিয়ামসের কথায় রাহুল স্যারের এই ক্লাসে তারা সকলেই অভিভুত।
রণদেব বসু যেমন বললেন, "এনসিএ-তে গিয়েই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি। দারুণ সিস্টেমেটিক ভাবে চলছে। আমাদের কোর্সটা কখনওই কোর্সের মতো মনে হয়নি। থিওরিটিক্যাল আর প্র্যাক্টিক্যাল দুইয়ের একটা অদ্ভুত কম্বিনেশনে ছিল কোর্স। এটা ঠিক ক্লাস নয়, আলোচনা বলা যেতে পারে। একটা টিমে যে ভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কোচিং স্টাফরা যে ভাবে আলোচনা করে, সে রকম।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন