বেশিদিন নয়। গত সপ্তাহের ঘটনা। ৩০ ডিসেম্বর। আসন্ন সৈয়দ মুস্তাক আলির জন্য অনুশীলন সারছিল বাংলার ক্রিকেট দল। রাজ্য ক্রিকেট সংস্থার বার্ষিক বৈঠকে যোগ দেওয়ার পর সিএবি থেকে বেরোনোর আগে সৌরভ ঠিক করলেন ইডেন ঘুরে যাবেন। যে ইডেন তাঁকে বিশ্ব ক্রিকেটের মহারাজ বানিয়েছে। সেই ইডেন।
সেই সময়েই সৌরভের মুখোমুখি পড়ে যান তাঁর একসময়ের সতীর্থ এবং বাংলা অনুর্দ্ধ ২৩ দলের বতর্মান কোচ সৌরাশিস লাহিড়ী। তিনি জিজ্ঞাসা করে বসেন, "দাদা, আপনি তো এখনো ট্রেনিংয়ের মধ্যেই রয়েছেন, আশা করি।"
আরও পড়ুন তিনটে ব্লক সৌরভের ধমনীতে, পারিবারিকভাবেই হৃদরোগের শিকার মহারাজ
সৌরভের জবাব ছিল সংক্ষিপ্ত। তিনি জানান, প্রশাসনিক কাজে এত বাঁধা পড়ে গিয়েছেন যে নিয়মিত ট্রেনিংটাই করে উঠতে পারেন না। তারপর ইডেনে ঘুরে রণদেব বোস, মনোজ তিওয়ারিদের সঙ্গে কথা বলেই পরের এসাইনমেন্টের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান।
ঠিক তাঁর তিন দিন পরেই সৌরাশিস লাহিড়ী বাড়িতে বসেই সংবাদ চ্যানেলে দুপুরে দেখেন প্রিয় দাদা হাসপাতালে ভর্তি। মৃদু হৃদরোগ নিয়ে। দুরুদুরু বুকে সৌরাশিস সঙ্গেসঙ্গেই একজন পরিচিতকে ফোন করে বিষয়টি কনফার্ম করেন।
আরো পড়ুন: অসুস্থ সৌরভকে দেখতে হাসপাতালে মমতা, দিদির শরীর কেমন জানতে চাইলেন ‘দাদা’
বাংলার প্রাক্তন রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক এবং জাতীয় নির্বাচক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক দুপুর ১.১৫ নাগাদ একই ধরণের একটি ফোন পান। আট বছর বয়স থেকে সৌরভকে চেনেন সম্বরণ। মহারাজের উত্থান দেখেছেন নিজের চোখে। প্রিয়জনের এমন দুঃসংবাদ পেয়ে আর চুপ থাকতে পারেননি। সরাসরি পাড়ি দেন উডল্যান্ডসে। সেখানে গিয়ে দেখেন ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চলে এসেছেন।
মুখ্যমন্ত্রী তারপরে তো বিস্মিত গলায় বলেই দেন, "একজন স্পোর্টসপার্সনের এমন হার্ট এটাক ভাবতেই পারছি না। সৌরভের মত একজন এথলিটের হৃদরোগ, মেলানো যাচ্ছে না!" সেদিন সন্ধেতেই হাসপাতাল চত্ত্বরে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। উদ্বেগে থাকা গোটা ক্রিকেট বিশ্বকেই জানানো হয়, আপাতত উনি স্থিতিশীল রয়েছেন। দ্রুত হাসপাতালে আসায় বিপদ এড়ানো গিয়েছে।
সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানালেন, "উপর থেকে দেখলে সৌরভের হার্ট এটাক অবাস্তব মনে হয়। তবে অনেক ক্রীড়াবিদরাই রয়েছেন যারা হৃদরোগের শিকার হয়েছেন- ক্রিশ্চিয়ানো জুনিয়র, ইয়ান চ্যাটফিল্ডের কথাই ধরা যাক।"
আরো পড়ুন: সৌরভের অসুস্থতার খবরে উতলা হলেন নাগমা, মুখ খুললেন টুইটে
কিছুদিন আগেই ডিন জোন্সের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এরপর সম্বরণ, "আইপিএলের সময় মুম্বইয়ে যখন ডিন জোন্স হৃদরোগে আক্রান্ত হন, সেইসময় আমি ছিলাম। আমরা একই ধারাভাষ্যকারদের প্যানেলে ছিলাম। একই হোটেল শুধু নয়, সেদিন সকালেও একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট সারি। সেইসময় কেউ ভাবতেই পারেনি উনি হৃদরোগে আক্রান্ত হবেন। উনি দারুণ ফিট ছিলেন। প্রতিদিন সকালে দৌড়াতেন। পরিমিত আহার করতেন।"
এরসঙ্গে বাংলার প্রাক্তন তারকার আরো সংযোজন, "আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি সৌরভ কখনো ধূমপান করে না। ড্রিংকস তো দূরের কথা। নিজের ফিটনেস নিয়ে সবসময় সচেতন থাকেন। যখনই সময় পান ট্রেনিং করেন। তবে হয়ত ইদানীং স্ট্রেসের শিকার হচ্ছিলেন। একবার ও আমাকে বলেছিল, কখনো রাজনীতিতে যোগ দেবে না। আমারও মনে হয় ওঁর ব্যক্তিত্বের কারোর রাজনীতিতে যোগ দেওয়া উচিত। তবে হয়ত সাম্প্রতিককালে যেভাবে ওঁকে নিয়ে রাজনীতির প্যাজপয়জার কষা হচ্ছিল, তাতে চাপ অনুভব করতে পারে।"
আরও পড়ুন সৌরভের অসুস্থতার খবরে চরম উদ্বিগ্ন অমিত শাহ, ফোন করে নিলেন খোঁজ
সম্বরণ আরো জানান, "এখন চিকিৎসকরা কী বলেন, সেটাই দেখার। হয়ত ওঁকে দু-একদিনের মধ্যেই ছেড়ে দেওয়া হবে।"
সৌরভকে নিয়ে সাম্প্রতিক কালে উত্তাল হয়েছে রাজনীতি। চলতি বছরেই বিধানসভা ভোট। তার আগে রাজনৈতিক দলে সম্ভাব্য যোগদান নিয়ে ঝড় উঠেছে গোটা দেশে। ওয়াকিবহাল মহলের তরফে বলা হচ্ছিল বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হতে পারেন তিনি। এর মধ্যেই এমন ঘটনা। উডল্যান্ডস চত্ত্বরে তাই আনাগোনা বেড়েছে ক্রীড়াবিদদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদেরও।
সৌরভের সঙ্গেই একসঙ্গে ট্রেনিং করতেন একসময় সৌরাশিষ লাহিড়ী। তিনি বলেছিলেন, সৌরভ কার্ডিও এবং এন্ডুরেন্স ট্রেনিংয়ে বরাবর নজর দেন, "ভীষণ শৃঙ্খলাপরায়ন জীবন যাপন করেন সৌরভ। দলের বাকিদের মত উনিও ফিটনেস নিয়ে বরাবর পরিশ্রম করতেন। শনিবার এমন খবর ভেসে আসতেই আমরা সবাই অবাক হই। তবে উনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছেন। এটা খুব ভালো খবর।"
কলকাতার বর্ষীয়ান সাংবাদিক সুমিত মুখোপাধ্যায় সৌরভকে অনুর্দ্ধ-১৫ সময় থেকে চিনতেন। তিনি বলে দিলেন, সৌরভের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর গোটা শহরটাকেই তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে। তিনি বলছিলেন, "একদম আদর্শ বাঙালি বলতে যা বোঝায় তাই সৌরভ। উত্তম কুমারের পর বঙ্গসমাজের আইকন। উনি একজন যোদ্ধা। আমরা সকলেই স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। কিন্তু সবাই স্বপ্নপূরণ করতে পারি না। লর্ডসের ব্যালকনি থেকে জামা ওড়ানোর সাহস কতজনের রয়েছে? সেই কারণেই উনি আমাদের হৃদয়ে থাকবেন। ঘটনা হল, সৌরভের হৃদপিণ্ডেই আসল সমস্যা, যা আমাদের সকলকে চিন্তিত করেছে।"
আর সৌরভকে বহুদিন চেনা সাংবাদিকের গলাতেও স্ট্রেসের প্রসঙ্গ। বলছিলেন, "উনি বিজেপি, টিএমসি কিংবা সিপিএম- যেকোনো দলে যোগ দিলেও আমরা সকলেই ওঁকে ভালোবাসব। আমাদের চোখে উনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি কোনো ভুল করতেই পারেন না। তবে উনি স্ট্রেসের মধ্যে রয়েছেন। এটা সত্যি।"
Read the full article in ENGLISH
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন